সংসদ ও বিচার বিভাগের দ্বন্দ্ব গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়
বিশ্বজুড়ে সংসদ ও বিচার বিভাগ এক বিতর্কের মুখে রয়েছে। এর শুরু হয়েছে ইউরোপের পোল্যান্ড থেকে, যেখানে বিচারকদের বয়স কমিয়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া বিচারকদের বিচারালয় থেকে অপসারণ করা হয়েছিল।। এর ধারাবাহিকতা চলছে পৃথিবীর নানান দেশে।
পৃথিবীর আরো কয়েকটি দেশে একই অবস্থা চলছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের পার্লামেন্টে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আইন পাস করতে চেয়েছে যে, পার্লামেন্টের আইনই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সুপ্রিম কোর্ট তাতে কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারবেনা।
ইসরাইলি সুপ্রিম কোর্ট সরকারের বিভিন্ন সময়ে গৃহীত কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে: যেমন কিছুকাল আগে ফিলিস্তিনিদের উপর লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ, কোর্ট এর বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। আবার বলপূর্বক বসতি স্থাপনের বিষয়ে কখনোই তেমন মুখ খোলেনি ইসরাইলি সুপ্রিম কোর্ট।
সরকার ও বিচার বিভাগ ঘিরে বিতর্ক চালু রয়েছে পৃথিবীর নানান দেশে। কতগুলো দেশ অবশ্য বিতর্ক নিষ্পত্তি করে নিয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানিসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র।
ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আমরা দেখেছি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পার্লামেন্টের বিভিন্ন বিষয়ে কোর্টের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সেই সময় তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে বলেছেন। সুপ্রিম কোর্টের এ ব্যাপারে কিছু করার নেই।
ভারতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিতর্ক চলছে বহুদিন যাবৎ। ইন্দিরা গান্ধীর সময় ভারতীয় বিচার বিভাগের নির্দেশের ফলে ভারতে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে কংগ্রেস দল দাবি করে। যদিও রাজনীতির এক বিরাট অংশ তখনকার সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনকে বেআইনি ঘোষণা করার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনকে বেআইনি ঘোষণা করেছিল।
ভারতে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত বিচারক নিয়োগের আইনকে পাল্টে দিয়ে বিজেপি সরকার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহায়তায় সংবিধানের সংশোধনী ৯৯ কায়েম করেছিল। কিন্তু ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এই নতুন সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছে। তারপর থেকেই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাথে দ্বন্দ্ব চলছে বিজেপি সরকারের। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ করার ক্ষমতা বিচার বিভাগেরও নেই আবার নির্বাহী বিভাগেরও নেই।
ভারতের ব্যবস্থা একটি যৌথ ব্যবস্থা। বিচার বিভাগ কর্তৃক বিচারকদের মনোনয়ন দান করার পরে নির্বাহী বিভাগ তা বাস্তবায়ন করে। সংবিধান সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে দীর্ঘদিন বিচারক নিয়োগ সংকটে ভুগছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তথা রাজ্যের হাইকোর্টগুলো। ক্ষমতাসীন দল তাদের পছন্দ মত বিচারকের নাম না পাওয়া পর্যন্ত বিচারক নিয়োগ করছে না। এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল বিভিন্নভাবে। বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সংসদীয় গণতন্ত্রের বহু দেশেই বিরাজমান। এক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সত্যিকারভাবে হয়তো পাকিস্তান কিছুটা এগিয়ে আছে। পাকিস্তানের বিধান খানিকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা রাখেন কিন্তু সেই বিচারকের নিয়োগ চূড়ান্ত হয় সিনেটে। পাকিস্তানেও এমনই একটি বিধান সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে পাকিস্তান সরকার চাইলেও তার পছন্দমত বিচারক আদালতে নিয়োগ করতে পারেন না।
ভারতের বিচার বিভাগ বহু সিদ্ধান্ত দিয়েছে যা জনগণের খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগের এই হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রকে কতটা শক্তিশালী করে সে প্রশ্ন সমাধান হওয়া দরকার। ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলো গ্রহণ করেছে। সে কারণে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে ক'বার ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে ততই ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়েছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরী আবার নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার উপর বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধরনের নানা বিষয় আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি। আমাদের নিজ দেশেও নানা বিতর্ক আছে এ নিয়ে।