শুধু ভালো বিয়ে দেয়ার জন্য কন্যাকে প্রস্তুত করা কেন?
একজন মেয়ে পড়াশোনা শিখে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, মাথা উঁচু করে চলবেন, বাবা-মা ও পরিবারের প্রতি দায়িত্বপালন করবেন, সমাজের উপকারে লাগবেন, বই পড়বেন, গবেষণা করবেন, নিজের ইচ্ছামতো চলবেন, গল্প করবেন, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াবেন---মেয়ের এই জীবনটার কথা অভিভাবকরা যেমন ভাবতে পারেন না, মেয়েটি নিজেও সেটা ভাবেন না বা তাকে ভাবতে শেখানো হয় না।
নিজ নিজ কন্যাকে ভালবেসে আমরা রাজকন্যার আসনে বসাই। কিন্তু রাজ্যপাট কিভাবে চালাতে হয়, কিভাবে সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে, রাজকন্যাকে সেটা শিখাই না। আদরে, সোহাগে, ভাব-জৌলুসে রাজকন্যার জীবনটা যে সবসময় নাও কাটতে পারে, এই দিকটা নিয়ে ভাবি না। আর ভাবি না বলে 'জীবনযুদ্ধ' সম্পর্কে কোন ধারণা দেই না।
আমাদের দেশে অধিকাংশ উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারে মেয়েটিকে বড় করা এবং পড়াশোনা ও কাজকর্ম করতে শেখানো হয় একটি ভালো বিয়ে দেয়ার জন্য। বড় হতে হতে মেয়েটির মাথায় ঢুকানো হয়, তুমি একজন মেয়ে কাজেই তোমাকে অনেক নিয়ম-কানুন শিখতে হবে, সহবত মানতে হবে, সংসারে মানিয়ে চলার মতো করে মনকে তৈরি করতে হবে এবং শেষপর্যন্ত বিয়ে করে ভালো বউ হতে হবে। সেইসাথে মা হয়ে নারী জীবন পূর্ণ করতে হবে।
পরিবারের কন্যা সন্তানটিও ভাবতে শেখে একদিন সে বড় হবে, পড়াশোনা করবে, ভালো বিয়ে হবে, প্রতিষ্ঠিত স্বামী হবে, সুখের সংসার হবে এবং সে সন্তানের মা হবে। বিবাহিত নারীর সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, নারী যদি সন্তান জন্ম দিতে না পারেন, তবে তার জীবন ব্যর্থ বলে মনে করা হয়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, নারী নিজেও তাই মনে করেন।
গ্রাম বা শহরের, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-নিরক্ষর, চাকুরিজীবি-গৃহবধূ যাই হন না কেন, একজন নারীর জীবন সেই মাতৃত্বেই সীমাবদ্ধ করে দেয় সমাজ ও পরিবার। শুধু সন্তান নেই বলে তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় এবং অর্জন সবই তুচ্ছ হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই নারীকে এমনভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয় যে শুধু সমাজ নয়, নারী নিজেও তার এই মা না হতে পারাটাকে চরম ব্যর্থতা বলে মনে করেন। কারণ তিনি মনে করেন মা হতে না পারলে তার জীবন অনিরাপদ হয়ে উঠবে, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করবে, বৃদ্ধ বয়সে কেউ দেখার থাকবে না। তাই মেয়েটি সব রকমভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান মা হওয়ার জন্য। তখন বয়স, শারীরিক সুস্থতা, ক্লান্তি, চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদি কোনকিছু নিয়ে তিনি ভাবেন না।
বিয়েটা মানুষের জীবনে নিঃসন্দেহে খুব জরুরি বিষয়, কিন্তু বিয়েটাই শেষ কথা নয়। আর শেষ কথা নয় বলেই একজন মেয়ে বা নারীকে এমনভাবে তৈরি করা উচিৎ যেন সে নিজের জীবনকে ভালবাসে, নিজের সুখ, দুঃখ, আনন্দ ও পূর্ণতাকে অনুভব করতে শেখে। অথচ অধিকাংশ মেয়েকে ঠিক এর উল্টোটাই শেখানো হয়।
সংসারে প্রবেশ করার পর অধিকাংশ মেয়ের কাছে তার নিজ জীবন, নিজ ভাবনা, আনন্দ, সুখ এবং নিজস্ব সময় বলতে কিছু থাকে না। সবই সংসার ও পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। সাহিত্য, নাটক, গল্প, উপন্যাস পড়া, সিনেমা দেখা, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর কোন অবকাশ থাকে না। গ্রামীণ নারীর জীবন আরো কঠোর, আরো ম্লান, আরো অনেক বেশি সংকটে ভরা। 'নিজস্ব পরিসর' বা 'বিনোদন' বা 'ইচ্ছা' শব্দটার সাথে তাদের পরিচয় নেই বললেই চলে।
অনেক মেয়ে নিজেরা যেমন জানেন না কোনটা তাদের প্রায়োরিটি, কিসে প্রকৃত সুখ বা তাদের জীবনে প্রকৃত আনন্দ কোথায়? ঠিক তেমন অনেকে সুখকে উপভোগ করার মতো মানসিকতা নিয়ে তৈরিও হয় না। নারীর সুখের পথে সবচাইতে বড় অন্তরায় হচ্ছে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে না পারার কষ্ট। তাকে সবসময় অন্যের চাহিদা, সুবিধা-অসুবিধা, পছন্দ-অপছন্দের কথা মাথায় রেখে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটা হতে পারেন বাবা-মা, নিজের পরিবার, প্রেমিক, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন এবং শেষ পর্যন্ত সন্তান।
একজন মেয়ে যদি কাউকে ভালবাসেন সেটাও জোর দিয়ে বলা সম্ভব হয় না। তেমনি অভিভাবকের পছন্দসই ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছেন না, এটাও সবসময় বলতে পারেন না। এভাবে অনেক মেয়ে একজনকে ভালবেসে অন্যের সাথে সংসার করতে চলে যান। অভিভাবকের পছন্দের বাইরে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো ক্ষমতা খুব অল্প কিছু মেয়ের আছে।
এমনকি কোন মেয়ে যদি বিয়ে না করে নিজের একক জীবন কাটাতে চায়, তাকেও সেই চিন্তা থেকে সরে আসতে বাধ্য করা হয়। একা জীবন চালানো ঝামেলাপূর্ণ, সমাজ কী বলবে, মা-বাবা না থাকলে অভিভাবক কে হবেন এইসব অজুহাতে। বাবা মায়েরা ভাবেন তারা বেঁচে থাকতে থাকতে তাদের কন্যার ভালো থাকার জন্য আরেকজন অভিভাবক ঠিক করে দেয়া উচিৎ। স্বামীই হবেন সেই অভিভাবক। অথচ স্বামীর কাছে কতজন মেয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছেন, বিয়ের পর স্বামীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে কতজন নারীকে বাচ্চা নিয়ে একা জীবন কাটাতে হচ্ছে, কতজন নারী শ্বশুরবাড়িতে বিভিন্ন কারণে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সে তথ্য আজ আর অজানা নয়।
শুধু বিয়ের কথা বলছি কেন? কর্মজীবনে মেয়েটি কোন জায়গায় চাকরি করবেন, সেটাও নির্ধারিত হয় অভিভাবক বা স্বামীর দ্বারা। অনেক মেয়েই আছেন যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশ করে, সেখানে চাকরি পাওয়ার পরেও কাজে যোগ দিতে পারেন না, স্বামীর বা শ্বশুরবাড়ির মত নেই বলে। পরিবার নারীর এমন কোন পেশায় যোগ দেয়ার পক্ষে নন, যেখানে স্টেশন ছেড়ে বাইরে যেতে হয় বা ফিল্ড ভিজিটে যেতে হয়, পুরুষ সহকর্মীর সাথে কাজ করতে হয়, রাতে ডিউটি করতে হয়, বেশি সময় অফিসে থাকতে হয়। নারীর জন্য তাই স্কুলে ও সরকারি ব্যাংকের চাকরিই সবচাইতে নিরাপদ বলে তারা মনে করেন।
মেয়েরা হয়তো অনেকেই এখন বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন কিন্তু এজন্য এদের অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়েই তা করতে হয়। যেমন সংসারের কোন দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যাহতি পাবেন না, সংসারে কারো কোন অসুস্থতা দেখা দিলেই তাকেই ছুটি নিতে হবে, ঘর গুছিয়ে তবেই নিজের ক্যারিয়ারের দিকে তাকাতে হবে। কোন অযত্ন-অবহেলা বরদাস্ত করা হয় না এবং অন্য কেউ কোন দায়িত্ব ভাগাভাগি করতেও সহসা রাজি নন।
একজন মেয়ে ক্যাফেতে বসে কফি খেতে ভালবাসেন বা টঙের দোকানের চা, অথবা অফিসের পরে বা ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে পছন্দ করেন, কিন্তু কতজন পারেন স্বাধীনভাবে এই কাজগুলো করতে? অফিসের পর এক কাপ কফি খেতে বন্ধুদের বা সহকর্মীদের সাথে কোথাও যাওয়া একজন নারীর জন্য চরম চ্যালেঞ্জিং। অথবা মেয়েটি চাইছেন একা একা কোথায় বসে সময় কাটাবেন, চা খাবেন, বই পড়বেন, সেটাও অবান্তর কল্পনা হবে একজন নারীর জন্য। কারণ আমাদের পরিবার ও সমাজ মেয়েদের নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে নয় এবং সাধারণত মেয়েকে শেখানোও হয় না প্রয়োজন হলে একা কেমন করে বাঁচতে হবে?
পেন স্টেট ইউনির্ভাসিটির একদল গবেষক ১২২ জন কর্মজীবী বিবাহিত নারীর ওপরে সপ্তাহব্যাপী এক জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, নারীরা আসলে কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরেই বেশি মানসিক চাপে থাকেন। আর এজন্য ঘরের তুলনায় তারা কর্মক্ষেত্রে থাকার সময়টাই বেশি সুখের মনে করেন। এটা বিদেশী নারীদের উপর করা গবেষণা হলেও একথা এদেশের নারীদের জন্যও প্রযোজ্য।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত দু'জন নারীর কথা জানি, যারা মনে করেন অফিসের তুলনায় বাসায় তাদের উপর নানাধরণের চাপ অনেক বেশি থাকে। আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পুরুষরা বলেছেন তারা কর্মক্ষেত্রের তুলনায় ঘরেই বেশি সুখী। এর কারণও সহজেই অনুমেয়। ঘরে ফিরে তিনি অনেক রিল্যাক্সড ফিল করেন। এদিকে নারীকে বাইরের কাজ করে ঘরে ফিরে পুরো সংসার সামলাতে হয় প্রায় এক হাতে। এই চিত্র বিশ্বের অনেক দেশেই দেখতে পাওয়া যায়।
শিশুকাল থেকেই নারীর মাথায় সেই ধারণাটাই ঢুকিয়ে দেয়া, যা সমাজের জন্য সুখকর। যেমন "আমি নারী, আমিই সব পারি।" অথবা "আমি বাসা সামলাই, আবার আমিই ব্যবসা বা অফিস সামলাই।" তাই অধিকাংশ নারী প্রশ্নই করেন না, কেন নারীকেই সব সামলাতে হবে? কেন তাকেই সব সামলানোর মতো করে পারঙ্গম হতে হবে? কেন কিছু না পারলে তাকেই সমালোচিত হতে হবে? অথবা কেন তাকেই সংসার সামলাতে গিয়ে চাকরি ছাড়তে হবে বা ছুটি নিতে হবে?
নারী বা পুরুষ যখন একসাথে সংসার শুরু করেন, সংসারের জন্য আয় করেন, তখন তাদের দু'জনেরই উচিৎ দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া। যেসব সংসারে শুধু পুরুষ একা টাকা আয় করেন, সেইসব সংসারে সাধারণত নারীই গৃহের সকল দায়িত্ব পালন করেন। এরমধ্যে বাচ্চার স্কুল, পড়ানো, রান্নাবান্না, বাজার করা, অসুস্থ মানুষের দেখাশোনা করা, বয়স্কদের দেখাশোনা করা, মেহমানদারি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ সবই আছে। কপাল ভালো হলে গৃহ সহযোগী পান, নয়তো নিজেকেই টানতে হয় এই হাল। আর যেসব নারী "সব পারি" মতবাদে বিশ্বাসী, তারা ঘর-দুয়ার, বাচ্চাকাচ্চা সব সামলে অফিসের কাজও সামলান। অনেকে পরিবারকে ভালবেসে সবকিছু গুছিয়ে করতে চান। এই গ্রুপটি বাইরের কাজের পাশাপাশি গৃহের কাজও করেন যত্ন নিয়ে, তবে তাকে চাপ সামলাতে হয় দ্বিগুণ।
আজকের এবং আগামী দিনের মানুষের জন্য মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিজ্ঞানের কথা হলো সুখী হতে হলে সচেতন প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এই প্রয়োজন বুঝতে হবে এবং সেইভাবে কাজও করতে হবে, একথা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান এবং কগনিটিভ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লরি স্যান্টোস। নারীর সুখ আলাদা করে খোঁজার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
জীবনে সুখী হতে চাইলে মনোবিজ্ঞানীরা কতগুলো পথ বাৎলে দিয়েছেন, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করতে হবে, দিনের একটা সময়ে কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে একা থাকতে হবে বা ধ্যানমগ্ন হতে হবে এবং আরো বেশি করে ঘুমাতে হবে। একবার ভেবে দেখুন তো বাংলাদেশে কতজন নারী সুখী হওয়ার এই পথগুলো ধরে চলতে পারবেন বা তাদের পক্ষে চলা সম্ভব?
অধ্যাপক লরি স্যান্টোস বলেছেন প্রকৃত অর্থে সুখী হওয়ার জন্যে 'সময় সম্পর্কে' নারী ও পুরুষ উভয়েরই ধারণা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত সুখী হওয়ার জন্য কার কাছে কতো অর্থ আছে সেটা নিয়েই মানুষ ভাবেন ও সম্পদের হিসাব করেন। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, সম্পদ বলতে আসলে বোঝানো হয়েছে মানুষের হাতে থাকা সময় এবং সময়ের হিসাবের সাথে সম্পর্কিত বিষয়। একজন নারীকেও প্রকৃত সুখী হতে হলে তার হাতে থাকা সময়টাকে উপলব্ধি ও ব্যবহার করতে হবে। সেইসাথে নিজের জীবন সম্পর্কে ধারণাতেও পরিবর্তন আনতে হবে।
মানুষের জীবন যেমন বহুমাত্রিক, তাদের জীবনদর্শনও একেক রকম। সেই অনুযায়ীই ওঠানামা করে সুখের সূচক। কেউ সুখ পান টাকা কামিয়ে, কেউ দায়িত্বপালন করে, কেউ উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে, কেউ পড়াশোনা করে, কেউবা সংসার করে, আবার কারো সংসার না করেই সুখ। কাজেই সুখের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নাই। যে যেভাবে জীবনকে উপভোগ করেন, তার সেটাতেই সুখ। সে যাক, আমরা শুধু বলতে চাইছি, নারী বা মেয়েরা যেন নিজের মতো করে 'সুখ' নিয়ে ভাবার স্বাধীনতা পান। তাদের উপর 'সুখের ধারণা' চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা বন্ধ হোক।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী