চীনের ক্রমবর্ধমান পানিসংকট কি ঝুঁকিতে ফেলতে যাচ্ছে তার প্রতিবেশীদের
ইয়াংসিকিয়াং আর হোয়াংহো নদীকে বলা হয় চীনের মাতৃনদী। আর সব প্রাচীন সভ্যতার মতো চৈনিক সভ্যতাও গড়ে উঠেছে নদীর তীরে, নদীর আশীর্বাদে। তবে বর্তমানে চীনের মাতৃনদী শুকিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, আরও শুকিয়ে যাচ্ছে দেশটির অনেকগুলো নদী। এক সময় বলা হতো, চীনে পঞ্চাশ হাজার নদী আছে। গত বিশ বছরে শুকিয়ে গেছে আটাশ হাজার নদী। আর তার ফলে চীনে দেখা দিয়েছে তীব্র পানিসংকট, যা দেশটির খাদ্য সুরক্ষা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবেশের ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে; একইসাথে ঝুঁকির মুখে ফেলছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে।
জলবায়ু পরিবর্তন, বিপুল জনসংখ্যা, নগরায়ন ও শিল্পায়নের চাপে চীনের নদীগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করেছে আরও আগে থেকেই। তবে ২০২২ সালের খরা ছিল চীনের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ খরা। কয়েকমাস স্থায়ী এ খরায় ইয়াংসিকিয়াং নদী অববাহিকা তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে চীনের ১২ শতাংশ আবাদি জমি পানির অভাবে পড়ে। পঙ্গপালের উপদ্রব বেড়ে যায়; চীনের সবচেয়ে বড় স্বাদু পানির দুটো লেক পোয়াং ও ডংটিং শুকিয়ে যায়। ইয়াংসিকিয়াং ও তার শাখানদীতে স্থাপিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যায়। লোডশেডিংয়ের ফলে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, সিমেন্ট ও কয়লা কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, চীনে বিশ্বের মিঠা পানির সম্পদের মাত্র ৭ শতাংশ রয়েছে; কিন্তু পৃথিবীর জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বাস করে সেখানে। তার ওপর, পানির বণ্টন অত্যন্ত অসম, ৮০ শতাংশ পানি সম্পদ দক্ষিণে এবং মাত্র ২০ শতাংশ উত্তরে অবস্থিত।
এর ফলে উত্তর চীন সমভূমিতে পানিসংকট সৃষ্টি হয় — এ অঞ্চলে ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি লোক বাস করে এবং দেশের অর্ধেক গম এবং ভুট্টা উৎপাদিত হয়। চীনের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের হারও দক্ষিণে বেশি, উত্তরে অত্যন্ত কম। জিয়াংজিয়াং প্রদেশের আশপাশের অঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম শুষ্কতম অঞ্চল।
চীনের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০১৯ সালে চীনের মোট পানির ব্যবহার ৬০৪ বিলিয়ন ঘনমিটারে পৌঁছেছে, যা তার শোষণযোগ্য পানিসম্পদ ৫৫৭ বিলিয়ন ঘনমিটারকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৯ সালে চীনে মাথাপিছু পানির প্রাপ্যতা ছিল মাত্র ২০৬৩ ঘনমিটার, যা বিশ্বব্যাপী গড়ের এক তৃতীয়াংশেরও কম এবং পানির চাপের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মাত্রার নিচে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের পানির চাহিদা ২৩ শতাংশ বেড়ে ৭০০ বিলিয়ন ঘনমিটারে পৌঁছাবে। একই সময়ের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে চীনের পানিসম্পদ ১০ শতাংশ হ্রাস পাবে।
চীন তার পানির চাহিদা মেটাতে নদী থেকে পানি সরিয়ে ফসলের সেচ, কারখানা সরবরাহ এবং নগর উন্নয়নে সহায়তা করছে। এর ফলে পরিবেশগত অবক্ষয়, ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস এবং পানির উৎসের দূষণ ঘটেছে। চীনের নদী শুকিয়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো অতিরিক্ত বাঁধ, যা নদীসমূহের প্রাকৃতিক প্রবাহ এবং পলিকে পরিবর্তন করে। চীন দেশটির নদীগুলোতে ৮৭ হাজারের বেশি বাঁধ নির্মাণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম থ্রি গর্জেস বাঁধ। বাঁধ বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জলবিদ্যুৎ সরবরাহ করলেও তা ক্ষতিগ্রস্ত করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ, বাস্তুতন্ত্র ও পানির বণ্টনকে।
অন্যদিকে, চীন ব্যাপক পানিদূষণের সম্মুখীন, যা মানব স্বাস্থ্য এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। ২০১৯ সালে পর্যবেক্ষণ করা ভূপৃষ্ঠের পানির মাত্র ৭৪ শতাংশ পানীয় বা কৃষি ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত ছিল; যেখানে ১৯ শতাংশ মানুষের যোগাযোগের জন্য অনুপযুক্ত এবং ৭ শতাংশ কোনো ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থা আরও খারাপ ছিল, মাত্র ৭০ শতাংশ পানীয় বা কৃষি ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত, যেখানে ৩০ শতাংশ মানুষের যোগাযোগের জন্য অনুপযুক্ত এবং ১৬ শতাংশ কোনোপ্রকার ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত।
পানিসংকট মোকাবিলায় চীন কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় উভয় পর্যায়েই একাধিক নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল 'থ্রি রেড লাইন' নীতি, যা ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট পানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, পানি ব্যবহারে দক্ষতার উন্নতি এবং পানির গুণমান রক্ষা করার জন্য বাধ্যতামূলক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আরেকটি বড় উদ্যোগ হলো দক্ষিণ থেকে উত্তরে পানি স্থানান্তর প্রকল্প, যার লক্ষ্য ইয়াংসিকিয়াং নদীর অববাহিকা থেকে বার্ষিক ৪৪.৮ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি উত্তরের খরাপ্রবণ অঞ্চলে তিনটি রুটের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া। প্রকল্পটি ২০০২ সাল থেকে চালু হয়েছে এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত উত্তর চীনের ১২ কোটির বেশি মানুষের কাছে ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি পানি সরবরাহ করেছে।
তবে এ ব্যবস্থাগুলো নানাবিধ সংকটে পূর্ণ। যেমন, দক্ষিণ থেকে উত্তরে পানি স্থানান্তর প্রকল্প উচ্চ আর্থিক ও পরিবেশগত ব্যয়ের জন্য সমালোচিত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করেছে, জ্বালানি ব্যবহার এবং কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি করেছে এবং বিভিন্ন অঞ্চল ও সেক্টরের মধ্যে পানির বরাদ্দ নিয়ে নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।
চীনের নদী শুকিয়ে যাওয়ার পরিণতি মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। এটি শুধু চীনের খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, এর সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও হুমকির মুখে ফেলেছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে আছে ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া। এ দেশগুলো চীনের পানি সম্পদের একতরফা ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
হিমালয়ের হিমবাহগুলো এশিয়ার একশ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য পানির একটি অত্যাবশ্যক উৎস। এর পানির ওপর নির্ভরশীল এশিয়ার তিনটি বৃহৎ অর্থনীতি — চীন, ভারত ও বাংলাদেশ। এ হিমবাহগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ, বন উজাড় এবং বাঁধ নির্মাণের কারণে হুমকির মধ্যে রয়েছে। হিমবাহ গলে যাওয়া এবং সংকুচিত হওয়ার কারণে ভারত ও চীনের পানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং শক্তি নিরাপত্তার পাশাপাশি এ অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
তিব্বতের মালভূমিতে হিমালয়ের অনেক হিমবাহ অবস্থিত। ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সরবরাহ হ্রাসের মুখে চীন এ হিমবাহগুলোর পানি নিয়ন্ত্রণ করে। দেশটি ইতোমধ্যেই তিব্বতীয় মালভূমি যেমন ইয়ারলুং সাংপো (ব্রহ্মপুত্র), সিন্ধু এবং মেকং থেকে উৎপন্ন প্রধান নদীগুলোর ওপরে বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। এমব বাঁধ চীনের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন — যেমন জলবিদ্যুৎ, সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর ফলে ভাটির দেশ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম পানিসংকটে পড়ছে।
চীনের বিরুদ্ধে এ নদীগুলোর পানি নিজের ব্যবহারের জন্য প্রবাহকে পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ইয়ারলুং সাংপো-ব্রহ্মপুত্র নদী প্রণালী থেকে চীন পানি সরিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। ইয়ারলুং সাংপো দক্ষিণ দিকে একটি তীব্র বাঁক নিয়ে ব্রহ্মপুত্র হিসাবে ভারতে প্রবেশ করার আগে তিব্বত জুড়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর এটি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গায় মিলিত হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ গঠন করেছে। যদিও চীন এ নদী প্রণালী থেকে পানি সরানোর কোনো পরিকল্পনা অস্বীকার করেছে, তবে কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে চীন একটি বিশাল প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করছে যার মাধ্যমে নদীর বাঁকে একটি সিরিজ বাঁধ এবং টানেল নির্মাণ করে পানি সরানো হবে। এ ধরনের একটি প্রকল্প শুধু নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ এবং বাস্তুসংস্থান পরিবর্তন করবে না, বরং ভারত ও বাংলাদেশের জন্য এর পানির প্রাপ্যতাও কমিয়ে দেবে, যা সম্ভাব্য সংঘাত এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
ঐতিহাসিক ও জাতিগত ভিত্তিতে চীন অরুণাচল প্রদেশকে তার ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দাবি করে। চীন সরকারের মতে, এ অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকেই চীনের একটি অংশ এবং তিব্বতি ও মনপারাদের মতো সংখ্যালঘু জাতিরা সেখানে বাস করে। বিগত বছরগুলোতে অরুণাচল প্রদেশে চীনা আগ্রাসন বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। অরুণাচল প্রদেশে চীনের আগ্রহের পেছনে কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো এর প্রচুর পানিসম্পদ — বিশেষ করে হিমবাহ। চীন হিমালয়ের হিমবাহের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তার পানি সরবরাহ এবং ভাটির দেশগুলোর ওপর প্রভাব সুরক্ষিত করতে। অরুণাচল প্রদেশ দখল করলে চীন হিমালয়ের কয়েকটি বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিমবাহ যেমন সিয়াচেন, জেমু এবং কাংটোতে অধিকার পেতে পারে। চীন ব্রহ্মপুত্র, লোহিত এবং সুবানসিরির মতো অরুণাচল প্রদেশ থেকে উৎপন্ন কিছু নদীকেও ডাইভার্ট করতে বা বাঁধ দিতে পারে। তাই অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পানি।
চীনের ক্রমবর্ধমান পানিসংকট সামনের দিনগুলোতে আরও তীব্র হতে যাচ্ছে। এটি যে কেবল চীনের জন্য মাথাব্যথার কারণ, তা নয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্যও চীনের পানিসংকট অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।