যারা ঘরে ফেরেনি
অনেককাল আগে প্রেমেন মিত্তিরের একটা গল্প পড়েছিলাম। নাম নিরুদ্দেশ। সে চমক কাটতে বেশ অনেকটা সময় লেগেছিল আমার। যারা এখনও গল্পটা পড়ে উঠতে পারেননি, তাঁদের সংক্ষেপে বলি — এক জমিদার তনয় স্বভাব বাউন্ডুলে। বাড়িতে তার মন বসে না। সে নিতান্ত অকারণেই বাড়ি থেকে পালায়। বন্ধনহীন গ্রন্থি বেঁধে চলতি হাওয়ার পন্থী হতেই সে বাবা-মাকে ছাড়ে। পত্রপত্রিকায় নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা প্রকাশ পায়। তাঁর চোখে পড়ে। কিন্তু সে ফিরে আসে না। প্রায় আর্তনাদের মতো প্রতি সপ্তাহে সে ঘোষণা প্রকাশ হতে হতে বন্ধ হয়ে যায় একসময়। এদিকে কেটে যায় বেশ ক'টা বছর। একদিন কোনো অমোঘ আকর্ষণে সে বাড়ি ফেরে। বাড়ির ভগ্নপ্রায় দশা। বাগানের বুড়ো মালি, নায়েব মশাই, কেউ যেন তাঁকে চিনেও চিনতে পারে না। অবশেষে সদ্য পূজো সেরে আসা বৃদ্ধ পিতার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি জানান, বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছেন তাঁর পালিয়ে যাওয়া ছেলেটি দুর্ঘটনায় মারা গেছে কিন্তু সে সংবাদ তাঁর স্ত্রীকে জানানো হয়নি, এই বলে ছেলেটিকে তিনি বলেন, 'তুমি দেখতে অনেকটা আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলের মতো। আমার স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়, তুমি কি একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবে?' যেন এক ঘোরের মধ্যে সে তাঁর মায়ের কাছে যায়। মা তাকে জড়িয়ে ধরেন। ঘর থেকে বেরোবার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর বাবা তাঁর পায়ের কাছে একটা টাকা ভরা থলি নামিয়ে রাখেন।
ঘরে না ফেরার করুণ কাহিনির থেকেও ঘরে ফেরার এ কারুণ্যের অভিঘাত যেন তীব্রতর। আসলে ঘর আর ঘরে ফেরার সাথে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এক চিরন্তন নষ্টালজিয়া। কি মজা দেখুন, এই নস্টালজিয়া শব্দটিও গড়ে উঠেছে গ্রিক Nostos শব্দ থেকে যার মানে ঘরে ফেরা। এই Nostos থেকেই ইংরাজিতে এসেছে Nest বা পাখির বাসা। আর জীবনানন্দ তো সে কবেই বলে গেছেন, সব পাখি ঘরে ফেরে। প্রথমবার বনলতা সেন পড়বার সময় চমকে উঠেছিলাম, এর ঠিক পরের লাইনটা পড়ে, 'সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন'। পাখির ঘরে ফেরা তবু বুঝি, নদী কীভাবে ফিরে যায় তার উৎস মুখে? নাকি এ কথা নেহাতই সেই 'নদী কোথা হতে আসিয়াছ?' বলা বাঙালি যুবকের ব্যাখ্যার মতো, যা সূর্যের প্রখর কিরণে বাষ্প হয়ে ঊর্ধ্বপানে যায়, তারপর শীতল হয়ে বিন্দু বিন্দু জলকণা রূপে ঝরে পড়ে আবার তার উৎসবিন্দুতে? কি জানি! তবে 'ঘরে ফেরা' এই শব্দবন্ধটুকু এক আকুল আশ্রয়ের সন্ধান দেয়, দেয় শান্তি, প্রাণের আরাম এবং সুখও।
মহাভারতের পাণ্ডবরা তখন বনে বনে ভ্রাম্যমান। পানীয় জল অকুলান। কুন্তীর আদেশে এক এক করে পুত্ররা জলের সন্ধানে যাচ্ছেন—কিন্তু ফিরে আসছেন না। অবশেষে গেলেন যুধিষ্ঠির। সেখানে বকরূপী ধর্ম তাকে চ্যালেঞ্জ করলেন, বকের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে, নাহলে অন্য ভাইদের মতো প্রাণ হারাতে হবে তাকেও। সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ছাড়া উপায় ছিল না যুধিষ্ঠিরের। একের পর এক প্রশ্ন। তার একটি ছিল 'এ জগতে সুখী কে?' যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, 'যে ব্যক্তি অঋণী, অপ্রবাসী থেকে দিনান্তে ঘরে ফিরে শাকান্ন ভোজন করেন তিনিই প্রকৃত সুখী।' অপ্রবাসী কথাটার ব্যবহার লক্ষণীয়।
পাণ্ডবরা তখন সদ্য গৃহহারা হয়ে বনে বনে ঘুরছেন। যে মানুষ দিনের শেষে নিজের ঘরে ফিরে আসতে পারে, তার থেকে সুখী যে তাদের আর কাউকে মনে হবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালোবাসা কবিও সন্ধ্যায় কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় ঘরে ফিরতে চেয়েছিলেন। ঘুরে ঘুরে পেতে চেয়েছিলেন 'শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ অথচ তাঁরই ঘরে ফেরা হলো না। মহানগরের সেই ট্রাম আর তার যান্ত্রিক ঘড়ঘড়ানিতে মিশে গেল ঘুমের ঘ্রাণ'—মেয়েলি হাতের স্পর্শ। সেই কলকাতার রাস্তাতেই তো হারিয়ে গেছে কত কিশোর-যুবক। সত্তরের সেই দুর্দান্ত দিনগুলোতে যারা বাড়ি থেকে ফেরার অঙ্গীকার করে বেরোত, অনেকেরই যাত্রা শেষ হত বেওয়ারিশ লাশকাটা ঘরে। কিংবা সেই বালকটি? সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার সে ছেলেটি 'বাবা কেন এল না মা?' বলে বাবাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল সেদিন। অনেক রাত্রে বাবা ফিরলেও ছেলে ঘরে ফেরেনি।
আসলে আমাদের প্রতিটি যাত্রাই হয়তো দিন শেষে ঘরে ফেরার যাত্রা। যে কোনো যাত্রাই সার্থকতা পায় সফল ভাবে ঘরে ফেরাতে। ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে গিয়ে যদি বলতাম 'দারুণ হলো ঘোরাটা', সাথে সাথে বাবা বলতেন, 'দাঁড়া, আগে সবাই ভালভাবে ঘরে ফিরি, তারপর দারুণ বলবি।' জীবনের মতো আমাদের যাত্রাতেও কোনো সরলরেখা নেই—আগাগোড়াই একটা বৃত্ত। ঠিক এইখানে ফিরে আসা নিয়ে আরও একটা গল্প মনে পড়ল। সে বেচারা অবশ্য ঘরে ফিরতে পারেনি। ইংল্যান্ডে এক পাদ্রী ছিলেন প্রচণ্ড লোভী। ধন সম্পত্তি, এমন কি জায়গাজমিতেও তার বড় লোভ। খবর কানে গেল রাজার। তিনি পাদ্রীকে অদ্ভুত এক প্রস্তাব দিলেন। বললেন, 'কাল সূর্য ওঠা থেকে তুমি তোমার ঘর থেকে দৌড় শুরু করবে। সারাদিন দৌড়ে দিনশেষে সূর্যাস্তের আগে তোমাকে ঘরে ফিরে আসতে হবে। যতটা জায়গা তুমি দৌড়ে ফিরতে পারবে, গোটাটাই তোমার। সেই পাদ্রী তো দৌড়ানো শুরু করল। সূর্য যখন ঢলে পড়ছে হঠাৎ তার খেয়াল হল এবার তো ঘরে ফিরতে হবে। প্রাণপণে ফিরতে চাইল সে। দৌড়াতে দৌড়াতে সূর্য যখন অস্ত গেল, আর ঘর থেকে মাত্র সাড়ে তিন হাত দূরে জমিতে লুটিয়ে পড়ে মারা গেল সে। মানুষকে কবর দিতে নাকি মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গা—অন্তিম ঘরের সেই জায়গাটুকুও অর্জন করতে ব্যর্থ মানুষটির ঘরে ফেরা আর হলো না।
ভারতীয় আধ্যাত্মিকতাতেও অবশ্য এই নশ্বর পৃথিবীকে প্রপঞ্চময় মায়া বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের আসল ঘর নাকি অন্য কোথাও। এই মায়ার সংসারে আমরা দুইদিনের অতিথিমাত্র। বিবেকানন্দও তো গাইতেন, 'মন চল, নিজ নিকেতনে/সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে।' গোটা বৌদ্ধ ধর্মটাও কিন্তু এক অর্থে সেই 'ঘরে ফেরার গান'। এই পাপের পৃথিবীতে ক্রমাগত জন্ম ও পুনর্জন্মের হাত থেকে বাঁচার উপায় নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখা। বৌদ্ধধর্ম সেই পথেরই সন্ধান দেয়। অর্থাৎ ঘরে ফেরা শুধু মাত্র ইট-কাঠ-বালি-পাথরের এক কাঠামো নয়। ঘর ছড়ানো পথের কোণে। সুজিত সরকার দু'লাইনে চমৎকার লিখেছিলেন:
দেওয়াল তুললেই ঘর
ভেঙে ফেললেই পৃথিবী
চার্লস ডিকেন্স সাহেবও তাই বলেছিলেন, 'Every traveller has a home of his own, and he learns to appreciate it the more from its wandering।' আর তাই একেবারে অজানা নতুন কোনো জায়গাও ঘর হয়ে উঠতে সময় নেয় না।
তখন সদ্য সদ্য পোস্টিং হয়েছে কালিম্পংয়ে। ঘরের থেকে, প্রিয়জনের থেকে অনেক দূর। দিস্তা দিস্তা মন খারাপ নিয়ে তিস্তা, রঙ্গিত বয়ে চলেছে। স্বজনবান্ধবহীন আমি প্রতিদিন বিকেলে রওনা হতাম পাহাড়ি পথ বেয়ে—যেদিকে দু'চোখ যায়। নেপালি গিটার, গান আর মাউথ অর্গানের শব্দ ভেসে আসত কানে। আমার অনভ্যস্ত হৃদয়ে তা নিতান্ত বিজাতীয়। একদিন জানি না কোনো বাড়ির একফালি জানলা থেকে হঠাৎ গান ভেসে এল, 'আমার সকল দুখের প্রদীপ/জ্বেলে দিবস/গেলে করব নিবেদন'—এ গান শুনিয়ে আমার মা আমার ঘুম পাড়াতেন ছোটবেলায়। এক মুহূর্তে সেই পাইন, দেওদার, কাউ ঘেরা পাহাড়ি-পাথুরে রাস্তায় আমি আমার ঘর খুঁজে পেলাম।
...
আমার বালককালে একটি বই অনেকের বাড়ির তাকেই শোভা পেত। জানি না এখনও পাওয়া যায় কি না, নাম 'সুভাষ ঘরে ফেরে নাই'। সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান ইদানীং অনুজ ধরের সৌজন্যে আবার খবর হয়েছে। আমরা প্রায়ই শুনতে পেতাম: 'নেতাজি জীবিত। নেতাজি ফিরবেন নেতার বেশেই।' মাঝে আরও গোটা তিরিশ বছর কেটে যাওয়ায় এ অদ্ভুত দাবি আর কেউ করেন না। সে অর্থে কিন্তু ভারতে ফেরা (বা ভারতে মৃত্যু) হয়নি অনেক ভারতীয়রই। আমার তো এই মুহূর্তে রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর আর লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কথা মনে পড়ছে। প্রবল শিলাবৃষ্টিতে মাথায় কাঠবাদামের সাইজের একটা শিল পড়ে অকালে মারা গেছিলেন দ্বারকানাথ। লালবাহাদুরের মৃত্যু তো এখনও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। রামমোহন অবশ্য রোগে ভুগেই মারা গেছিলেন।
তবে তিনজন মানুষের ঘরে না ফেরার কথা বড্ড বেশি কষ্ট দেয়। একজন ম্যাসিডোনিয়ার সেই সম্রাট—এশিয়া, আফ্রিকা জয়ের পর ব্যাবিলনে এসে যিনি আচমকা জ্বরে ভুগে মারা গেলেন। শেষের দিকে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে যায়। তার আগ পর্যন্ত তিনি নাকি একবার ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর ঘরে, ম্যাসিডোনিয়ায়। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার হিসেবে নয়, ফিলিপের ছেলে হয়ে। মনে পড়ে সেই মানুষটির কথা যিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করতে চেয়েছিলেন শুধুই 'because it is there', যাবার আগে সঙ্গীদের বলে গেছিলেন, 'দেখো, ফিরে আসব নিশ্চয়ই।' তুষার ঝড়ে মারা পড়া, হিম হয়ে থাকা সবুজ জুতোর মালোরিরও ঘরে ফেরা হয়নি। ফেরা তো হয়নি সেই মানুষটিরও যিনি 'পশ্চিম আজ বসন্তের শূন্য হাত' বলে জানু পেতে বসেছিলেন। বাবরনামার ছত্রে ছত্রে নিজের ঘরে, কাবুলে ফেরার কি আকুল আর্তি ছিল তাঁর। এদেশের কিছুই তাঁর ভালো লাগত না। মৃত্যুর আগে একটিবার ফিরতে চেয়েছিলেন মাতৃভূমি ফরগনায়। ঈশ্বর তাঁকে ধ্বংস করলেন—কিন্তু ঘরে ফিরতে দিলেন না। ঘরে কি সত্যিই কখনো আসা যায়। ফেরা যায় গ্রামাফোন শোভিত সুখী গৃহকোণে?
'আসা মানে তো প্রস্তুতি শুরু
বিদায় নেবার কাঠের সে পুরোনো খামে
ঠিকানা লেখা তোমার নামে জমছে ধুলো...'
কৌশিক মজুমদার: ভারতীয় বিজ্ঞানী ও লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।