আত্মহত্যা: উত্তরবিহীন প্রশ্ন, অতৃপ্ত মন এবং গভীর শূন্যতার জন্ম দেয়
আমাদের সন্তানরা মনে কষ্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে এই পৃথিবী ছেড়ে। বিষাদ ও হতাশার কারণে পরাজয় মেনে নিচ্ছে। যে বয়সে জীবনকে উপভোগ করার, স্বপ্ন দেখার, আনন্দ করার বা যুদ্ধে যাবার সময়, সেই বয়সেই তারা 'নির্বাণ লাভ' করার চেষ্টা করছে। যে সময় ছেলেমেয়েরা বেশি উদ্যমী, আনন্দে ভরপুর এবং নতুন কিছু করার চেষ্টা করে, সেই তারুণ্য কেন সহজে পরাজিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সিয়াম মৃত্যুর আগে এক দীর্ঘ নোটে লিখেছে, এর মাধ্যমে সে নির্বান লাভ করছে। পদার্থ বিজ্ঞানে পড়া একজন তরুণ 'দেহ থেকে বের হয়ে তার আত্মার অনন্ত যাত্রার' কথা লিখে আত্মহনন করতে পারে, ভাবতেই অবাক লাগে। এত যুক্তি, বিজ্ঞান, হিসাব, নিকাশ, বন্ধু, পরিবার কোনোটাই তাকে সাপোর্ট দিতে পারলো না।
দু'দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল থেকে এক শিক্ষার্থীকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। রোকেয়া ভাল ছাত্রী ছিল বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়তে এসেছিল লালমনিরহাট থেকে। পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে, অসময়ে গর্ভধারণ, স্বামীর অসহযোগিতা, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে না পারার চাপ মেয়েটি বহণ করতে পারেনি।
''আমি যদি বন্ধুদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারতাম, তাহলে এটা হতো না। এখন আমি অধঃপতিত হলাম। আমি আপনাদের কাছে একদম ক্ষমার অযোগ্য, তবুও সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।" এমন একটি চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী অনিক চাকমা।
খুব সামান্য সময়ের ব্যবধানে এতগুলো মৃত্যুর ঘটনায় আঁচল ফাউন্ডেশনের ২০২১ সালের তথ্যের কথা মনে হলো। তাদের তথ্য জানাচ্ছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের বেশি।
তারা আরো বলেছে, দেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর।
কয়েক বছর আগে আমার পরিচিত একটি মেয়ে আত্মহত্যা করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়েটি ছিল খুব চুপচাপ স্বভাবের। খবর শুনে সবাই ছুটে গেলাম। মানুষ ফিসফাস করছে, তাদের মূল প্রশ্ন একটাই, কেন আত্মহনন করলো মেয়েটি? শোকের চাইতে এই আত্মহত্যার পেছনের ঘটনা খোঁজাতেই দেখলাম সবার উৎসাহ। মেয়েটির মা কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছেন, "কেন আমি ওকে সময় দিলাম না? ওর কষ্টের কথা শুনলাম না? নিশ্চয়ই আমার মেয়েটা খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল।"
অন্য একজনের মানসিক কষ্ট বুঝে, সত্যিকারভাবে তা অনুভব করা দ্বিতীয় কারো পক্ষে খুব কঠিন হয়। অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারেনা বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে কেন মানুষ বিষন্ন হয়ে পড়ে। জানি না সিচুয়েশনাল অথবা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, বাইপোলার, সিজোফ্রেনিয়া ও বর্ডারলাইন ডিজিজ কী?
স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম সেই ১৭ শতকে তাঁর 'আত্মহত্যা' বিষয়ক প্রবন্ধে লিখেছেন, "আমি বিশ্বাস করি কোনো মানুষ কখনোই তার জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেনা, যতোক্ষণ পর্যন্ত সেই জীবনটা তার কাছে মূল্যবান থাকে।" অনেক ধরনের উপাদান বা পরিস্থিতি একজন ব্যক্তির বোঝার ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা এবং পরিবেশকে নাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু কেন সে নিজেই নিজের জীবন কেড়ে নেয়, তা আমরা কোনোদিনও জানতে পারবো না। আমরা জানতে পারবো না একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিচার বিবেচনা ও যুক্তি ঠিক ঐ মুহূর্তে বা সুইসাইড করার আগের মুহূর্তে কেমন থাকে।
অনেক রোগী ডাক্তারকে বলেছেন, তারা যখন আত্মহত্যা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, তখন তারা তাদের প্রিয়জনদের কথা ভাবেননি। কারণ তখন তাদের কাছে নিজেদের ব্যথাটাই খুব বেশি ছিল। মনে হতেই পারে এটা খুব স্বার্থপরের মতো আচরণ। মানুষ আত্মহত্যা করে শুধু নিজে পালিয়ে বাঁচার জন্য, অন্য কারো জন্য মারা যাওয়াটা সুইসাইড নয়। সে আসলে নিজে বাঁচার উপায় হিসেবেই মৃত্যুকে বেছে নেয়।
আত্মহত্যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন, ভুল ব্যাখ্যা, ভয় এবং কুসংস্কার কাজ করে। প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে যিনি আত্মহত্যা করেন, তার নিজস্ব কিছু কারণ থাকে। প্রতিটি মানুষ আলাদা, তাদের আবেগ-অনুভূতিও আলাদা। তাই কেউ কেন সুইসাইড করলো এটা চট করে বলা খুব কঠিন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন আত্মহত্যা দু'ধরনের হয়- পরিকল্পিত এবং আবেগতাড়িত হয়ে বা কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে- চরম বিষণ্নতা বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে। অধিকাংশ মানুষ খুব একটা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করেনা। বিষণ্নতা থেকে আবেগ তৈরি হয়, আশা চলে যায়, অন্য কোনো উপায় খুঁজে পায় না মানুষ, তখন একমাত্র উপায় হয় আত্মহত্যা।
গত কয়েক বছরে আত্মহত্যা ঠেকাতে নানা সময়ে কাজ করতে দেখা গেছে জাতীয় জরুরি সেবা হটলাইন ৯৯৯-এর সদস্যদের। বিভিন্ন সময়ে ফোন পেয়ে তারা ছুটে গেছেন ভিকটিমকে বাঁচাতে। তাদের কাছে অনেক সময়ই আত্মহত্যা চেষ্টার তথ্য জানিয়ে কল আসে। ভিকটিম নিজেই কল দিয়ে জানান যে, তিনি পারিবারিক কিংবা কোনো খারাপ লাগার কারণে এই কাজ করছেন। এক্ষেত্রে কৌশলে তার অবস্থান জেনে নিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়। ওনারা উদ্ধার করেছেনও।
এ প্রসঙ্গে মনোচিকিৎসক ক্যাম্পবেল ওয়াট এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য তিনি বলেছেন, "এটা আমাদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব যে, একজন মানুষকে তার আত্মহত্যা করার ইচ্ছার হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আমরা যদি সফল হই, যদি ব্যক্তির কারণগুলোকে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই হবে বড় উপহার।"
মনোচিকিৎসকরা এও বলেন, তারা দেখেছেন যখন রোগীদের মানসিক, শারীরিক ও আবেগজনিত অসুস্থতা চিকিৎসা করা হয়, তখন সেইসব সুইসাইডাল রোগীরা আর মারা যেতে চান না। অনেকেই ফিরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে, আর ফিরে এসে বলেছেন তারা জীবনকে উপভোগ করতে চান। তারা স্বীকার করেছেন বিশেষ একটা অবস্থায় তারা মারা যেতে চেয়েছিলেন। আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের ঐ মুহূর্তটাকে ঠেকানো, তার পাশে দাঁড়ানো।
আমাদের দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে। কারণ আমরা আত্মহত্যার কারণগুলোকে আমলে নেই না বা গুরুত্ব দেই না। এটা যে মানসিক অসুস্থতা বা চাপ থেকে হয়, সেটাও অধিকাংশ পরিবার জানেনা। আর জানলেও এটা জানেনা যে, মানসিক রোগীকে নিয়ে কী করতে হবে? কীভাবে তার পাশে দাঁড়াতে হবে?
আমরা মনেকরি, মানসিক সমস্যা মানে পাগল হয়ে যাওয়া। এজন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়া মানে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাওয়া। পরিবারের কোনো সদস্য কোনো বিপদে পড়লে পরিবারের অন্য সদস্যরা তার পাশে না দাঁড়িয়ে, বরং গালিগালাজ করে। তাকে একঘরে করে বিষণ্নতার মুখে ঠেলে দেয়।
অনেক আলোচনা থেকে যে তথ্যগুলো মনোচিকিৎসকরা বের করেছেন, তা হলো, সন্তানদের মানিয়ে নেওয়া শেখাতে হবে। বিপদে তাদের পাশে থেকে সময় দিতে হবে। অপরাধের জন্য কাউকে ধিক্কার জানানোর মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। নিজেদের অপ্রাপ্তি সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবেনা। কেউ যদি বিষণ্নতায় ভোগে, তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সময় মতো কারো পাশে দাঁড়ালে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে একজন মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সরকারকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে আমলে নিয়ে জাতীয় সুইসাইড প্রিভেনশন কৌশল দাঁড় করাতে হবে। বাঁচার জন্যই দরকার পরিবার, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, দেওয়া-নেওয়ার মতো সম্পর্কগুলো।
যে পরিবারগুলোতে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু পরিচিতজনের হাট লেগে থাকে, যেখানে ঘর-বিছানা, পড়ার টেবিল, মুরগির মাংস, মাছের টুকরা ভাগাভাগি করে খেতে হয় সেইসব পরিবারে সন্তান একাকীত্ব বোঝেনা, শেয়ার করতে শেখে, অপ্রাপ্তি বুঝে। আমার বাবা সবসময় বলতেন, "একটা কথা মনে রাখবে, সবার সাথে থাকলে কোনো না পাওয়া, দুঃখ-কষ্ট তোমাকে সহজে স্পর্শ করবে না। আর তুমি অনুভব করবে যে তুমি একা নও। দেখবে মানসিকভাবে শক্তি খুঁজে পাবে। সবাই সবার পাশে থাকলে মানুষ কখনো ভেঙে পড়েনা।"
আধুনিক মানুষ এখন বেশি একা হয়ে যাচ্ছে। সবাই এখন ইদুঁর দৌড় প্রতিযোগিতায় আছি। এই প্রতিযোগিতা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের হতাশা ও বিষণ্নতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হতাশা মানুষের সৃজনশীলতা, বোধ ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করে দেয়। আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষের মন ও মননে যে আসলে কী ঘটছে, সেটা বাইরে থেকে বুঝতে পারা কঠিন। পাশে থাকা মানুষও অনেক সময় বুঝতে পারে না যে তার পাশের মানুষটি আত্মহত্যা করতে পারেন বা করতে যাচ্ছেন।
আত্মহত্যা এক ধরনের অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও সমাজে এটা বাড়ছে। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে বা লাইভে এসে আত্মহত্যার ঘটনাও বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ''ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার একটি ঘটনা যখন প্রচার পায়, তখন অন্যদের তা প্রভাবিত করে। আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে যদি পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়, তাহলে আরেকজন আত্মহত্যার যুক্তি খুঁজে পায়। তাই আমাদের সবার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।''
যে মারা যায়, তার চলে যাওয়া পরিবারের ওপর ভয়াবহ প্রভাব রাখে। কারণ এই চলে যাওয়াটা তার একার বিষয় নয়, এই ঘটনায় সবচেয়ে আক্রান্ত হয় মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজন। তারা সারাজীবন একটা উত্তরবিহীন প্রশ্ন, অতৃপ্ত মন এবং গভীর শূন্যতা নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেয়।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।