একজন সংশপ্তক জাফরুল্লাহ! একাত্তরই তাকে তৈরি করেছে
গতকাল যখন জাফর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটা শুনলাম, খারাপ লেগেছিল ভীষণ। তবে অবাক হইনি। হয়তো দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন বলে। কেবল একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল, জাফরুল্লাহ ভাই সারাটাজীবন লড়াই করে গেল! কয়েক মাস আগে একবার একজন আমাকে বলেছিল, 'জাফরুল্লাহ ভাই বেঁচে আছে মনের জোরে। তা নাহলে এই শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার কথা না।'
এ লড়াই তো তার শুরু থেকেই। সারাজীবন তাকে আমি লড়াকু মানুষ হিসেবেই দেখে এসেছি। যদি একটি শব্দে তার পরিচয় দিতে হয়, তবে বলবো তিনি হলেন 'সংশপ্তক'। যে জেতা বা হারার কথা না ভেবে সারাজীবন লড়ে যায়। জীবনটা তার সত্যিই সেভাবেই গেছে। কখনো হয়তো তাতে অর্জন হয়েছে, কখনো ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু লড়াই বন্ধ হয়নি।
একাত্তরের আগে জাফর ভাইকে কোনো ব্যক্তি হিসেবে চিনতাম না
জাফরুল্লাহ ভাইকে বুঝতে হলে একাত্তর বোঝাটা খুব দরকার। একাত্তরই তাকে তৈরি করেছে।
যুদ্ধের সময় তিনি বিলেতের লেখাপড়া ছেড়ে এসে যোগ দেন আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে। সেখানেই গড়ে তুললেন একটি হাসপাতাল। সুলতানা আপার মতো আরও অনেককে প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একদল সেবাদানকারী। আমার নিজের খালাতো ভাই মেজর আখতার বীর প্রতীকও সেখানে ছিলেন।
শুনেছি এই সেক্টর টুয়ের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ যখন ১৯৭৫ সালে মারা গেলেন, তখন জাফরুল্লাহ ভাই নিজে লাশটি উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করেন। খুব পছন্দ করতেন খালেদ মোশাররফকে।
চীনাদের থেকে আমদানি করলেন চিকিৎসাসেবা পদ্ধতি
আজকের দিনে একাত্তরের ইতিহাস রাজনৈতিক দলের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস। কিন্তু ভাবিনা যে এই একাত্তর আমাদের গোটা সমাজটাকেই নতুন করে তৈরি করেছে। এরমধ্যে ভালো জিনিসও যেমন তৈরি হয়েছে, খারাপও তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই একাত্তরকে ধারণ না করার ফলে, জাফরুল্লাহ ভাইকেও আমরা বুঝতে পারিনা, আমাদের সমসাময়িক ঘটনাকেও বুঝতে পারিনা।
যেকারণে আমরা এখন জাফরুল্লাহ ভাইকে রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবেই দেখি বেশি। কিন্তু তার মূল ভূমিকা ছিল 'স্বাস্থ্যের অধিকার' নিয়ে। 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' এই কথাটা তিনিই প্রথম জনপ্রিয় করেছেন।
জাফরুল্লাহ ভাইকে আমরা ভালোভাবে চিনলাম বাহাত্তর সালে। স্বাধীনতার পরপর মানুষের জীবনে ছিল অনেক কষ্ট। একদিকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি অন্যদিকে খাদ্যের অভাব, চিকিৎসার অভাব। রোগশোক হলে তার কোনো চিকিৎসা-সেবাও ছিল না তখন। সেসময় জাফর ভাই-ই মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। জনসাধারণের স্বাস্থ্য-চিকিৎসার হাল ধরলেন।
মুক্তিযুদ্ধ প্রকল্পে কাজ করার সময় আমরা যখন মাঠ পর্যায়ে গবেষণার জন্য গেছি, তখন দেখেছি কীভাবে জাফরুল্লাহ ভাই গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্য নিয়ে বোঝাচ্ছেন, সচেতন করছেন। শুধু তা-ই নয়, অসহায়, অসুস্থ, ক্ষতিগ্রস্ত এই দেশের মানুষদের সাথে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন এক চিকিৎসা সেবা। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ডাক্তার, সেবিকারা রোগীদের স্বাস্থ্য সবা দেওয়া শুরু করলেন। যা ছিল এদেশের মানুষদের জন্য তখন একদমই নতুন।
জাফর ভাইকে প্রথম দেখি টেলিভিশনে গালাগাল দিতে
আমি প্রথম জাফর ভাইকে দেখতে পাই ড.বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একটি টেলিভিশন প্রোগ্রাম 'আপনার স্বাস্থ্য'তে। খুব জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান ছিল তখন সেটা। সেখানেই একদিন জাফরুল্লাহ ভাইকে দেখলাম। তিনি সেই প্রোগ্রামে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, অন্যান্য মেডিকেল কলেজে (যেসব সিনিয়র শিক্ষকদের চাকরি যায় না, প্রফেসারি চলতেই থাকে) এক্সট্রা শিক্ষকদের অনেক বকাঝকা দিলেন। কিন্তু তা নিয়ে কোনো রিরূপ কথা হয়নি, বরং এবং সেটা বেশ গ্রহণযোগ্যই হয়েছিল! তিনি বরাবরই এমন পাগ্লাটে, কিন্তু ভালো মানুষ ছিলেন।
তার সাথে আমার প্রথম সামনাসামনি দেখা হলো বিচিত্রা পত্রিকা অফিসে। বিচিত্রার সম্পাদক ছিলেন শাহাদাত ভাই। শাহাদাত ভাই এই বিচিত্রায় এমন কিছু মানুষকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন যারা যুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজকর্মের সঙ্গে জড়িত। তারমধ্যে একজন ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এই বিচিত্রাতেই মানুষের সহায়তায় 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' স্লোগানে একটি ক্যাম্পেইন চালু করলেন তখন। প্রকাশনা সংস্থা শুরু করলেন। আরও অন্যান্য কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। তবে সবকিছুর উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই। সেটা হলো, স্বাস্থ্য।
তিনি মনে করতেন, সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী যদি একসাথে এগিয়ে না আসে, তাহলে সবার জন্য স্বাস্থ্য হবেনা।
জাফরুল্লাহ ভাই ওইসময় যে জিনিসটাকে সবচেয়ে বেশি দাম দিতেন তা হলো ওষুধের দাম। যেটা আমরা ভাবতেও পারিনি। আমরা ওষুধ পাচ্ছি এতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু এই যে ওষুধ কোনোটা বোতলে বিক্রি হচ্ছে, কোনোটা ডিব্বায় বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু ফয়েলে বিক্রি করলে সস্তায় পাওয়া যায়। এই সহজ সাধারণ বিষয়টা নিয়ে কিন্তু ভাবিওনি। তিনি ভাবলেন!
কিন্তু ক্রমেই সমাজে তার বিরোধিতাও বাড়তে থাকলো। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল করলেন, বিরোধিতা পুরো উন্মুক্ত হয়ে গেল।
তিনি যে 'জাফরুল্লাহ চৌধুরী', এই ভাবটা কখনো তার মধ্যে ছিল না
জাফরুল্লাহ ভাইকে পছন্দ করতেন না এমন মানুষ খুব কমই ছিলেন সেসময়। তিনি ছিলেন প্রকৃত মানবদরদী মানুষ, সেইসাথে রাগী মানুষ। ঐ সময় আমরা একসাথে বিভিন্ন মানবাধিকারধর্মী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আজকের দিনে তো মানবাধিকারধর্মী সংগঠনগুলো বিদেশি টাকা নেওয়ার কাজকর্ম করে। তখনকার দিনে তো এসব ছিল না। একবার আমাদেরকে এমনেমস্টি ইন্টারন্যশনাল টাকা দিতে চেয়েছিল, আমরা নেইনি। কেননা তখন তো আমরা ছিলাম বাম, পশ্চিমাদের টাকা নিয়ে আমরা কাজ করব না।
এই যে নিজের দেশের টাকায় নিজের দেশের জন্য কাজ করতে হবে- এমন একটা ভাবনা সবসময় জাফর ভাইয়ের মধ্যে ছিল। আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যাদের বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, বিদেশে এবং দেশে দু জায়গাতেই গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তারা কিন্তু দুটো শক্তিকেই কাজে লাগিয়েছেন। যেকারণে, অক্সফামের মতো গোষ্ঠী ব্র্যাক এবং গণস্বাস্থ্য দুজায়গাতেই বড় ভূমিকা পালন করেছে।
আবেদ ভাইয়ের মৃত্যুর পর ব্র্যাকে আবেদ ভাইকে নিয়ে যে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে জাফরুল্লাহ ভাই ছিলেন অন্যতম বক্তা। কারণ তাদের লড়াইটা তো একসাথে। তারা জানতেন বিলেতকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে বাংলাদেশের জন্য। একাত্তর ও বিলেত এ দুটোরই অবদান ছিল বাংলাদেশের ব্র্যাক আর গণস্বাস্থ্যের পেছনে। কারণ আবেদ ভাই আর জাফর ভাই, এই দুজন প্রবাদপ্রতীম মানুষই পেরেছিল বিলেতকে ব্যবহার করতে। আজকাল অনেকেই ব্যবহার করে, নিজেদের স্বার্থে। কিন্তু তারা করেছিলেন দেশের মানুষের স্বার্থে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করেছি বলে জাফর ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। কিন্তু কখনো তার মধ্যে নিজেকে নিয়ে অহংকার বা ভাব নিতে দেখিনি।
গালাগাল দিলেও সবাই জানতেন তিনি খাঁটি মানুষ
জাফরুল্লাহ ভাইয়ের রাজনৈতিক একটা পরিচয় ছিল, একাত্তরের আগে ছাত্রজীবন থেকেই। তিনি ছিলেন কিছুটা চীনা বামপন্থী। তখনকার দিনে সচেতন শিক্ষিত মানুষের তো তা-ই হওয়ার কথা। এছাড়া বিচিত্রা ছিল বাম ঘরানার, চীনা বাম্পন্থী। প্রকাশনী সংস্থ থেকে প্রকাশ করতেন কিছুটা বামঘেঁষা বই।
৭৫ এর পর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাজনীতি খুব প্রবলভাবে আঘাত করলো। জাফর ভাইও রাজনীতির এই পরবর্তী ঘনঘটায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি কখনো নির্বাচনে দাঁড়াননি। কিন্তু তিনি তাদেরকেই সমর্থন করেছেন, যারা খুব মোটাদাগেই সরকারবিরোধী। কিন্তু তাতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। কেউ তাকে কখনো এই বলে দুষতে পারেনি যে, তিনি নিজের জন্য সুবিধা নিয়েছেন, নিজের পকেট ভারী করেছেন। তাকে গালি দিক বা না দিক সবাই জানতো, সে খাঁটি মানুষ। কারণ সবাই জানতো, তার মৌলিক উদ্দেশ্যই ছিল একটাই 'সবার জন্য স্বাস্থ্য'।
শেষদিকে জাফর ভাই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। তার ধারণা ছিল তিনি যেভাবে সবাইকে দেখেন, সবাই তাকে সেভাবেই দেখবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি তো ব্যক্তিপর্যায়ে চলে যায়। সবকিছুই এদেশের মানুষ ব্যক্তিপর্যায় লাভের জন্য করতে চায়। এমন কোনো সংগঠন ছিল না যার সাথে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ঝামেলা হয়নি। কিন্তু তিনি এসবে কোনো পাত্তা দিতেন না।
এদেশের জন্য তার যা করার ছিল, তিনি তা করে গেছেন, দিয়ে গেছেন। গণ বিশ্ববিদ্যালয় করেছেন, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিকিউটিক্যালস গড়েছেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দিয়ে গেছেন সাধারণের জন্য। আমাদের দেশের অনেকেই কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য আজ গণস্বাস্থ্যের শরণাপন্ন হোন।
জাফরুল্লাহ ভাই পেরেছেন, স্বাস্থ্য যে সবার অধিকার তা তিনি প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যেতে পেরেছেন!
- লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক