বইয়ের মানুষেরা, মানুষের বইয়েরা
১
হেলিপ্যাডে শুয়ে আছি। বাবার অফিসের ছাদে, জিয়াউর রহমান সাহেব হেলিকপ্টারে নেমেছিলেন পরিদর্শনে। জেনারেল ইলেকট্রিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি তখন দেশের একমাত্র ট্রান্সফর্মার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। সোভিয়েত রাশিয়া যুক্ত ছিলো এই প্রতিষ্ঠানের সাথে। প্রচুর রুশ মেশিনারিজ ছিল তখনো। বাবা ভেবেছিলেন, চাকরিতে ভালো করলে রাশিয়া বেড়াতে যাবেন, লেনিনের মসোলিয়ম দেখবেন, তাই জীবনের প্রথম চাকরি বদলাননি।
রাশিয়াও পরে আগের মতো রইলো না। বিনামূল্যের জাহাজভর্তি বই আসা বন্ধ হয়ে গেল। কোনো বইতেই মুদ্রিত মূল্য নেই। সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম। হেলিপ্যাড থেকে নেমে বাবার সাথে অফিস ক্যান্টিনে। সবাই খুব আদর করতেন আমায়। ফেয়ারওয়েলে গিয়েও দেখি, কাকুদের চোখে আমি পনেরো-ষোলোতে আটকে। বাবা পয়সা দিলেন, বাস ভাড়া। বাড়ি ফেরার। শখ করে অফিসে বেড়াতে এসেছিলাম। মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে মনে পড়ল, আজ আনন্দমেলা আসার দিন। পঁচিশ টাকা। সেই আমলে। আছে মাত্র আট টাকা, জমানো, আজো স্পষ্ট মনে আছে। বাবা বিশ টাকা দিয়েছে। যদি রাস্তায় খিদে পায়। সেই পনেরো-ষোলো বছর বয়সে, সাড়ে তিন ঘণ্টা হেঁটে জি ই এম প্ল্যান্ট, উত্তর পতেঙ্গা থেকে নিউমার্কেটের সামনে কারেন্ট বুক সেন্টার গেলাম। নতুন আনন্দমেলার গন্ধ আজো নাকে লেগে আছে। সেদিনের এক টাকার বস্তা আইসক্রিমের স্বাদ আজো জিভে লেগে রয়েছে। প্রথম চুমু না প্রথম কৈশোরের এই স্বাদ, কার জয় আজো স্থির করতে পারিনি।
২
বড় হচ্ছে মন আর শরীর। অক্টোবরে শারদ সংখ্যা আর ঈদে ঈদ সংখ্যা নিত্যনৈমিত্তিক। বিচিত্রা বন্ধ হয়ে সাপ্তাহিক ২০০০ শুরু হলে প্রথম ঈদ সংখ্যায়, যতদূর মনে পড়ে, বেরোল হুমায়ূন আজাদের 'কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ', তার আগে তাঁর 'মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ' আর 'ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল' পড়েছি। তাই খুব টানল না, কিন্তু সমনামী অন্যজনের 'কবি' কিংবা তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কবি'র চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক আজাদের কবি। যদিও কবি বিষয়ে আমার পছন্দের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'এই তাঁর পুরস্কার', জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখা।
অল্প বয়সে এমনকি ঔপন্যাসিক ও পরে চিত্রনায়ক ওমর সানীর একাধিক উপন্যাস পড়েছি। খারাপ ছাপায় দেদার বিকোত সেসব। একবার পেলাম, অনেকদিন পর অবশ্য, শমী কায়সারের চারটি উপন্যাস। সেই বইতে ক্লাস টুয়ের শমী গোটা গোটা হরফে লিখছে বাবার সাথে রাশিয়া যাওয়ার কথা। একটা শিশুর চিন্তা এতো স্পষ্ট দেখে মনে হয়েছিল লেখালেখি অনেকটাই জেনেটিক, হয়তো বা।
একটা অদ্ভুত উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। জনৈক আনিছুর রহমানের লেখা। চারজন মানুষ আর একটা টয়োটা। প্রচুর যৌনতা, আর শেষে গাড়িটা খাদে। নাম মনে নেই, কিন্তু চমকে গিয়েছিলাম পরিণতিতে।
একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ি এলো শহরে। গাড়িতে গান বাজে, আলো আমার আলো ওগো। ইনচার্জ দীপঙ্কর দাশ, ফর্সা এবং একবার দেখলে মনে থাকার মতো চেহারা। এখন বাতিঘরের কর্ণধার। আমায় বই সাজেস্ট করতেন।
মানুষ চেনার কত রকম পদ্ধতি আছে। আমি চিনি বই আর ফিল্ম সাজেশনে। আলোর গাড়িটা আমাদের শহরের পড়ার পরিবেশ অনেক বদলে দিয়েছিল। তুলনাহীন বইয়ের সম্ভার। আমার পাঁচটা কার্ড ছিল নানা আত্মীয়, বন্ধু ও তৎকালীন ক্রাশের নামে। বই দেয়ার অজুহাতে বিকেলে তার বাসায় যাওয়া, চা দিতে গিয়ে যদি একটু আঙুল ছুঁয়ে যায়! জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর 'রাবণ বধ' ওখানেই পড়া।
তবে আমার বইয়ের প্রতি আমর্ম টানের গল্প আরেকটু আগের। মাধ্যমিকের পর সবাই যখন উদয়াস্ত কম্পিউটার শিখছে, কলেজ ভর্তি কোচিং করছে, আমি বসে আছি চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে। টেনিদার বাইরে লেখা নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বারো খণ্ডের সেই রচনাবলী শেষ করছি। উপনিবেশ, শিলালিপি, সূর্যসারথি--কী অভাবিত সব লেখা! আর 'রেকর্ড' গল্পটা। সম্প্রতি শিবব্রত বর্মনের 'বানিয়ালুলু' পড়ে কেন জানি না আমার রেকর্ড গল্পের কথা খুব মনে পড়ছিল। না, থিম এক নয়, কিন্তু আত্মার দিক থেকে কোথাও একটা জলছাপ থেকে গেছে হয়তো।
৩
সকাল আটটা বাজার আগে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়তাম। তখন পৈতৃক বাসায় থাকি, ঠাকুরদার বানানো সাধু মিষ্টি ভাণ্ডারের উপর, কোতোয়ালির মোড়ে। পরটা ভাজি, মিষ্টি সাঁটিয়ে সোজা বিশ মিনিট হেঁটে পাবলিক লাইব্রেরি, শহীদ মিনারের সামনে। এই শহরে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থাপত্য এই শহীদ মিনার। দেশপ্রেমিক না হলেও আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো বা জাতীয় সঙ্গীত শুনলে চোখ ঝাপসা হয়। পড়তে পড়তে ঘুরে বেড়াই বাংলা ভাষার অযুত প্রান্তর। বেলা গড়ায়, আজানের মৃদু শব্দ আসে দূর থেকে। হাল্কা কিছু খেয়ে উঠি আবার।
আমার বসার জায়গা ছিলো জানালার পাশে। রোদ এসে লেখার অক্ষর আস্তে আস্তে সোনালি করে দেয়, কনে দেখা আলো। এক নারীকে মনে পড়ে। জলের বোতল সামনে তাঁর, চিকন বেল্টের হাতঘড়ি পরা হাতখানি ফেলে রাখা আর ধ্যানস্থ হয়ে পড়াটুকু। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের পরমাত্মীয়া মৈত্রেয়ীহেন। যে জ্ঞানে অমরত্ব লাভ হয় না, তা দিয়ে কী করব! মুখ মনে নেই, ধ্যানটুকু মনে পড়ে। এই ধ্যান এক জীবনে অর্জন করে নেয়ার জিনিস। একসময় সোনালি রং গাঢ় হুইস্কিরং ধারণ করে, আর চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। বাতি জ্বলে লাইব্রেরির। তখন মুঠোফোন ঘরে ঘরে আসেনি। ডিজিটাল বাংলাদেশের ঢপের কীর্তন আসেনি। তখন মোবাইল ডাটা ছিল না, মনোযোগ ছিল। বাসায় জানত ছেলে লাইব্রেরিতে নয় সিনেমাহলে। পরের গল্পটা আরেকদিন।
কেমন করে জানি না, একদিন ফুটপাথ থেকে একটা বই কিনলাম অল্প পয়সায়। সাল তারিখ মনে নাই। মনে আছে, শীতকাল। আমি জানতাম না, ফুটপাথ পরের প্রায় বিশ-বাইশ বছর আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। ফুটপাথের দেবতার আশীর্বাদ ঝরে পড়বে শরীরে।
রেজাউল করিম সুমনের কথা অনেকেই জানেন। নির্মাণ পত্রিকার সম্পাদক, নভেরা গবেষক, চারুকলার শিক্ষক--তাঁর অনেক পরিচয় কিন্তু আমার কাছে একটাই, বড় ভাই। সুমন ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, ঢাকা চলে যাওয়ার সময় তাঁর বিপুল বইপত্রের বন্দোবস্ত করতে পারেন নাই। একদিন তার একটা বড় অংশ পুরনো বইদোকানে এসে পড়লো। আমরা সবাই আহত হলাম। বিচিত্র এক কাকতাল, অসীম রায় প্রণীত গল্প সংগ্রহ এক আর দুই এবং তাঁর অবিস্মরণীয় উপন্যাস 'গোপালদেব' সুমন ভাইয়ের সম্পত্তি, সই দেখে চিনেছি, দুই বছর সময়সীমায় তিনটে বই শহরের তিন ফুটপাথ থেকে এই অধমের হাতেই উঠে আসে। বই কখনো কখনো শিশু যেন, স্নেহ বোঝে, কেউ যদি আন্তরিক ভালোবাসে, সর্বস্ব দিয়ে বাসে, মানুষ হৃদয়ে না এলেও, বই হাতে উঠে আসে। গোপালদেব হাতছাড়া হওয়াতে দুঃখ পেয়েছি।
৪
প্রত্যেকটা শহরে দু-একজন বড় ভাই থাকেন। দিদি থাকেন। আত্মার আত্মীয় তাঁরা। নানা রকম রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সূত্রে পরিচয় ঘটে। নিজাম উদ্দিন ছিলেন তেমনই একজন, আমার নিজাম ভাই হয়ে উঠেছিলেন তারপর। হাতে ধরে ভালো বই চেনানো, জরুরি লেখক চেনানো এই মেন্টরের কাজ। দুই হাজার আট সালে আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশত বর্ষ পালন করেছিলাম আমাদের অধুনালুপ্ত ছোটো কাগজ 'নাব্যিক'-এর উদ্যোগে। সেখানেই পাই ফেরদৌস আরা আলীম দিদিকে। আমাদের আয়োজনের সঞ্চালক ছিলেন। সত্তর প্লাস একজন মানুষ এখন। বাংলা পড়াতেন কলেজে। গল্প, প্রবন্ধ লেখেন। অনুবাদ করেছিলেন গোপাল হালদার প্রণীত নজরুল জীবনী। চমৎকার বলেনও। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ আমি দেখলাম, এখনো নতুন ধরনের ভাষার প্রতি টান। খুঁটিয়ে খবর রাখার চেষ্টা করেন বাংলায় ভালো লেখা কারা লিখছেন এখন।
বলছিলাম নিজাম ভাইয়ের কথা। দস্তয়েভস্কির প্রথম পাঠ তাঁর কাছে। অস্তিত্ব যে নিয়ত দহন আর অনন্ত প্রশ্নমালার সংযোগ তা দস্তয়েভস্কি কেমন করে উপন্যাসের পর উপন্যাসে লিখে রেখেছেন তিনি আমায় তা খেয়াল করতে বলেন। পড়ান কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের রচনা। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়সহ ওই সময়ের একাধিক ছোটো কাগজ থেকে উঠে আসা লেখকের প্রথম প্রকাশক 'অধুনা' ও 'গল্পকবিতা' থেকে। নিজেও বড় মাপের লেখক। যেমন, ধরা যাক, নিত্যদিনের বাজার করতে বেরিয়ে একটা লোক বেরিয়ে পড়ল আজব সফরে; কিংবা 'হুজুগানী' উপন্যাসের কথাই ধরা যাক, উত্তর কলকাতার শরিকি দুর্গাপূজার কথার আড়ালে পুরোনো সময়ের ইতিহাস তুলে আনা। কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত সাম্প্রতিক ছোটগল্পের প্রথম সংকলনটাও তাঁর বাসায় প্রথম দেখি। সহযোগী সম্পাদক কায়েস আহমেদ আর শাকের চৌধুরী। প্রকাশ বৈশাখ, তেরাশো সাতাত্তর; মানে এদিকে তিন ওদিকে পঞ্চাশ, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের। কায়েস আহমেদ একাধিক রচনা লিখেছিলেন।
৬
আমাকে জাগিয়ে দিয়ে নিজাম ভাই একদিন ঘুমিয়ে পড়লেন। শোকের মধ্যে সন্ধ্যাতারার কথা মনে পড়ল একদিন। সে আমার অক্ষরকে ভালোবাসত। আমার বইয়ের প্রতি অবিশ্বাস্য টান আর টানা পড়ার অভ্যাসকে ভালোবাসত। বলতো, আমাকে অল্প একটু ভাগ দিলেই হবে। দুই হাজার বারো, ডিসেম্বরের ঊনত্রিশ আনুমানিক বিকাল চারটা তিপান্ন মিনিটের দিকে প্রথম ব্যাকুল চুমুটিও তো উপহার পেয়েছিলাম বাংলা বইয়ের জন্যেই। আমার চোখের মধ্যে যে শুধু বইয়ের প্রতি ভালোবাসাই প্রত্যক্ষ করেছিল, শেষ পারমাণবিক যুদ্ধে উবে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে মনে পড়বে। না, তাকে নয়, তার চুমুটিকে, না চুমুটিকেও নয় চুমুর ব্যাকুলতাটিকে।
আর, এই প্রচারসাফল্যের সময়ে, বিজ্ঞাপনের নানারকম বর্ণবিচ্ছুরণের মধ্যে ইচ্ছে করে এখন অধরা, এক সময়ের নিত্যকাজ সেই ধ্যানে ডুবে গিয়ে, বাংলা অক্ষরের দিগন্তবিস্তীর্ণ প্রান্তরে আবার ছুটে বেড়াই প্রথম কৈশোরে। প্রকৃতি নিশ্চয় আমায় দয়া করবে। ওই ব্যাকুলতার স্মৃতি আর ধ্যানের প্রতি টান আমার মতো বইয়ের মানুষকে বাঁচাবে। যারা পড়তে ভালোবাসে তাদের জীবন স্বস্তিময় হোক। মানুষের সভ্যতার সবচেয়ে বড় আবিষ্কারের সাথে তার সম্পর্ক আরো গভীর হোক।