সুদানের গৃহযুদ্ধ, ইথিওপিয়ার নীল নদের বাঁধ এবং মিশরের অস্তিত্বের সংকট
'খোদা যখন সুদানকে তৈরি করেছিলেন, তখন তিনি হেসেছিলেন' — নিজেদের দেশ সম্পর্কে এই প্রবাদটি সুদানে বেশ প্রচলিত। দীর্ঘকাল ধরে আফ্রিকার এই প্রাচীন জনপদ রক্তাক্ত হয়েছে। ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সংঘাত চলছেই দেশটিতে। এখনো সুদানে চলছে গৃহযুদ্ধ। দেশটির সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল থেকে। এক দিকে আছেন দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল-ফাত্তাহ বুরহান। অন্যদিকে আরএসএফ-এর প্রধান জেনারেল মোহাম্মেদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেদতি। গত দশদিনে এ সংঘাতে অন্তত ৪৫৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪,০৭২ জন।
আরএসএফ গঠিত হয়েছিল প্রায় বিশ বছর আগে — স্বৈরশাসক ওমর আল-বশির দারফুর অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করার জন্য এটি গঠন করেছিলেন। ২০১৯ সালে ওমর আল-বশিরের ক্ষমতাচ্যুতির পর রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয় এবং অব্যাহত লড়াই বেসামরিক শাসনকে বার বার ব্যাহত করছে। সুদানে একটি নতুন মানবিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, দেশটি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মানবিক সংকটে পর্যুদস্ত।
কিন্তু সুদানের গৃহযুদ্ধে এখন তার প্রতিবেশি দেশগুলোও জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মিশর ও ইথিওপিয়া এই সংকটের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। দেশ দুটির অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে এই সংকট, আর তার কারণ নীল নদ এবং তার ওপর ইথিওপীয় বাঁধ নির্মাণ।
নীল নদ আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য লাইফলাইন। কিন্তু মিশর আর সুদানের জন্য নীল নদের প্রভাব অনেক বেশি; কারণ দেশ দুটির প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় নীল নদের দ্বারা। মিশরকে নীল নদের দান বলেছিলেন হেরোডেটাস, কারণ মিশর গড়েই উঠেছে নীল নদের কারণে। দেশটির ৯০ শতাংশ সুপেয় পানি আসে নীল নদের মাধ্যমে, জনসংখ্যার অর্ধেক বাস করে নীল নদের তীরে।
নীল নদের প্রধান দুই শাখা — ব্লু নাইল আর হোয়াইট নাইল সুদানের রাজধানী খার্তুমে মিলিত হয়েছে। সেখান থেকেই নীলের মূল প্রবাহ শুরু। বর্ষাকালে নীল নদ সুদানের প্রধান যোগাযোগমাধ্যম। দেশটির ৭০ শতাংশ পানির উৎস নীল নদ, ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা বাস করে নীল নদ অববাহিকায়। মিশর আর সুদান দুই দেশই ভাটির দেশ; আর উজানের দেশ ইথিওপিয়া।
নীল নদ মিশর, সুদান এবং ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য জল, বিদ্যুৎ, সেচ এবং পরিবহনসুবিধা সরবরাহ করে। বিশেষ করে জলবিদ্যুতের জন্য নীল নদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুদানের মেরোওয়ে ড্যাম আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। মিশরের আসওয়ান ড্যাম পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এমব্যাংকমেন্ট ড্যাম। কিন্তু সম্প্রতি এই অঞ্চলে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নতুন একটি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প — ইথিওপিয়ার গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম (গার্ড)।
ইথিওপিয়া দাবি করছে গার্ড দেশটির উন্নয়ন এবং শক্তি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে। গার্ড নির্মিত হলে ৫,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে, যা ইথিওপিয়ার জাতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের দ্বিগুণ। কিন্তু মিশর ও সুদানের মতে, গার্ড নির্মিত হলে নীল নদের পানি সরবরাহ কমে যাবে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশদুটি। বিশেষ করে মিশরের জন্য নীল নদের পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এক অকল্পনীয় হুমকি। এ কারণেই মিশর সবসময়ই শক্তহাতে ইথিওপিয়াকে চাপে রেখেছে, যাতে ইথিওপিয়ার উজান থেকে পানির পরিমাণ কখনো না কমে মিশরে। ১৯২৯ সালে স্বাক্ষরিত নীল নদ সমঝোতার বলে মিশর তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরেও ছড়ি ঘুরিয়েছে।
ইথিওপিয়ার এমন বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা অবশ্য নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে একইরকম একটি বাঁধ নির্মাণ করতে চেয়েছিল দেশটি; তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত হুমকি দিয়েছিলেন: 'আমরা মিশরে বসে পিপাসায় মরার জন্য অপেক্ষা করব না। বরং আমরা ইথিওপিয়ায় যাব এবং সেখানে মরব।'
স্বাভাবিকভাবেই এর পরে ইথিওপিয়ার বাঁধ নির্মাণ আর এগোয়নি। ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত মিশরের একছত্র আধিপত্য ছিল নীল নদের পানির ওপর। কিন্তু হোসনি মুবারাকের পতনের পর মিশরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নেয় ইথিওপিয়া — ঘোষণা করে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গার্ড নির্মাণের।
গার্ড থেকে যা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, সেটি আশপাশের দেশে রপ্তানিও করতে পারবে ইথিওপিয়া; কাজেই বেশ লাভজনক প্রকল্প এটি। ইথিওপিয়ার দাবি, গার্ড বানানো হলে নীল নদের পানি আরও ভালোমত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, ফলে ভাটির দেশগুলোতে আচমকা বন্যার সম্ভাবনা কমে যাবে। উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালে নীল নদ ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পানিসীমায় পৌঁছে, যার ফলে সুদানে ভয়াবহ বন্যায় শখানেক মানুষ নিহত ও এক লাখের ওপর বাড়িঘর ধ্বংস হয়।
কিন্তু সুদান বা মিশর কেউই এটা মানতে নারাজ। এর কারণও বেশ যৌক্তিক।
মিশরের সংকট এখানে বেশি। ইথিওপিয়া ব্লু নাইলের পানি জমা করতে শুরু করলে মিশরের নাসের হ্রদের পানির স্তর কমে যাবে। তখন আসওয়ান বাঁধ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট পানি পাবে না। আবার তীব্র খরায় শুকিয়ে যেতে থাকা জলাধারগুলোতে সরবরাহ করার মতো পর্যাপ্ত পানি থাকবে না।
ইথিওপিয়া আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গার্ড বাঁধের রিজারভয়ার ভর্তি করে ফেললে মিশরের কৃষিখাত বছরে ২৮ বিলিয়ন ডলারের লোকসান করবে; দশ বছরে ভর্তি করলে লোকসান হবে ১৭ বিলিয়ন ডলার। কাজেই মিশর কোনোভাবেই পাঁচ বছরের মধ্যে ইথিওপিয়াকে রিজারভয়ার ভর্তি করতে দিতে রাজি না; তাদের দাবি ১২ থেকে ২১ বছর সময় নিয়ে ভর্তি করতে হবে।
ওদিকে এতদিন বসে থাকা ইথিওপিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা চায় সাত বছরের মধ্যে ভর্তি করতে। এখন মিশর যেকোনো মূল্যে ইথিওপিয়াকে দেরি করাতে চায়। আর ইথিওপিয়া গার্ডের পাশাপাশি আরও উজানে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে; যার কারণ স্থায়ীভাবেই নীল নদের পানি প্রবাহ কমে যাবে।
গার্ডের ভবিষ্যত আরও অনিশ্চয়তায় পড়েছে টিগ্রে অঞ্চলে সংঘাতের জন্য। বাঁধটি নির্মাণের জন্য ঠিক হওয়া এ অঞ্চলে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে চলছে গৃহযুদ্ধ। ২০২২ সালের সবচেয়ে রক্তাক্ত সংঘাত কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ছিল না, ছিল টিগ্রে গৃহযুদ্ধ। হাজার হাজার মৃত্যু, কয়েক লাখ লোকের উদ্বাস্তু হওয়া এবং সরকারি অবরোধের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় এই সংঘাতকে করে তুলেছে ভয়াবহ।
মিশর ও সুদান গার্ড রিজারভয়ার পূরণের সময় ও পানির প্রবাহ নিয়ে বাইন্ডিং-এগ্রিমেন্ট করতে চায় ইথিওপিয়ার সাথে; কিন্তু ইথিওপিয়া চায় নন-বাইন্ডিং এগ্রিমেন্ট করতে। এই কারণে তিন দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তিনবার দেশগুলো আলোচনায় বসার পরও কোনো সুরাহা হয়নি।
এরই মাঝে সুদানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ২৫ অক্টোবর, ২০২১ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থান বেসামরিক নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করে, তার ফলে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট। এখন সেটা গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এই অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ইথিওপিয়া এবং মিশরেও ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে পড়েছে। সুদানের জনগণ গণতন্ত্র ও বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে রাজপথে নেমেছে, কিন্তু সামরিক জান্তা নিরাপত্তার হুমকি এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের কর্মকাণ্ডের সাফাই গেয়েছে।
মিশর এখানে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় বলে অনেকেই ভাবছেন। টিগ্রে যুদ্ধে সেনা পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে ইথিওপিয়ার পড়শি ইরিত্রিয়ার বিরুদ্ধে। ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর হাই-প্রোফাইল ইরিত্রিয়ান ডেলিগেশন কায়রো সফর করে গেছেন। এই কারণে অনেকেই সন্দেহ করছেন, এই সুযোগে মিশর গার্ডে স্যাবোটাজ করতে পারে অথবা এ যুদ্ধকে ব্যবহার করে ইথিওপিয়াকে মিশরের দাবি মেনে নিতে চাপ দিতে পারে।
ওদিকে ইথিওপিয়া সরাসরি সুদানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে টিগ্রে যুদ্ধ থেকে ফায়দা লোটার জন্য। আদ্দিস আবাবার দাবি, খার্তুম টিগ্রে যুদ্ধকে ব্যবহার করে সীমান্ত এবং গার্ড ইস্যুতে ফায়দা নিতে চাইছে। সুদান ইথিওপিয়া সীমান্তের টিগ্রে অঞ্চলে অবস্থিত উর্বর কৃষিভূমি আল-ফাশকা ট্রায়াঙ্গল দখল করে নিয়েছে ২০২০ সালে। ২০০৮ সালের সমঝোতা অনুযায়ী আল-ফাশকার জমিতে চাষ করবে ইথিওপীয় চাষিরা; আর প্রশাসন পরিচালনা করবে সুদান। কিন্তু সুদানের এই আগ্রাসনের ফলে টিগ্রে অঞ্চলের এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঝুঁকিতে পড়ল, গার্ড থেকে যার দূরত্ব বেশি নয়। ফলে গার্ডের ভবিষ্যত আরও ঝুঁকিতে পড়ল, কারণ সামরিক পন্থায় আল-ফাশকা পুনরুদ্ধারের সক্ষমতা ইথিওপিয়ার আপাতত নেই।
অন্যদিকে সুদানি গৃহযুদ্ধ গার্ড ইস্যুতে সমঝোতা বা চুক্তিকে পিছিয়ে দিয়েছে; কারণ সুদানের জান্তার বৈধতা নেই। তাই বর্তমানে মিশর আর ইথিওপিয়ার মতো দুই মরিয়া দেশের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কেউ রইল না। ইথিওপিয়ার মত নানা জাতি ও গোত্রে বিভক্ত দেশের জন্য গার্ড ঐক্যের প্রতীক, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রতীক। তাই গার্ড নির্মাণ তাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর মিশরের কাছে এটা বাঁচা-মরার প্রশ্ন। মিশর বার বার তাই সতর্ক করছে, দরকার হলে জঙ্গি বিমান পাঠিয়ে হলেও গার্ড ধ্বংস করে দেওয়া হবে। আর পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দশ বছর ধরে বানানো হচ্ছে গার্ড, এটি ধ্বংস করে দেওয়ার অর্থ মিশর এ অঞ্চলে সর্বগ্রাসী একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে। যুদ্ধের কারণে আপাতত এ সমীকরণ থেকে ছিটকে গেছে সুদান।
আফ্রিকা বরাবরই অবহেলিত, আফ্রিকার সংকটও তাই অবহেলিত। ফলে বিশ্ব জনমতের অলক্ষ্যেই কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ ও জীবন এভাবেই জটিল রাজনৈতিক ঘুর্ণাবর্তে আটকে আছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।