ইথিওপিয়ার রহস্যময় নেকড়ে: বিশেষ ফুলের মধু খায়, শিকারি হয়েও পরাগায়ন ঘটায়
ইথিওপিয়ান নেকড়ে আফ্রিকার দক্ষিণে বেল পর্বতমালার ফুলের মাঠে ঘুরতে ভালোবাসে। এই প্রজাতির কিছু নেকড়ে এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় সেখানে ঘুরে বেড়ায়। তারা বিশেষ এক গাছের উজ্জ্বল কমলা রঙের ফুল দেখে খুব আনন্দিত হয়। ফুলটির নেক্টার [ফুলের মধু] তাদের আকৃষ্ট করে এবং তারা পাকা ফুলগুলো চেটে খায়। এসময় তাদের মুখে মধুর মতো হলুদ রেণু লেগে যায়। এই অদ্ভুত আচরণ প্রথমবারের মতো গবেষণায় ধরা পড়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে স্যান্ড্রা লাইয়ের নেতৃত্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী দলের পরিচালিত একটি গবেষণার মাধ্যমে।
ইথিওপিয়ার হাইল্যান্ড-এ এই বিশেষ প্রজাতির নেকড়ের বাস। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানিস সিমেন্সিস (Canis simensis)। এই অঞ্চলের পরিবেশ অনেকটাই তুন্দ্রার মতো। এখানকার জলবায়ু শুষ্ক এবং গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে।
২০২৩ সালের মে মাসের শেষ থেকে শুরু করে জুনের প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা তিনটি দলের ছয়টি নেকড়েকে পর্যবেক্ষণ করেন। তারা চার দিন ধরে অফ-রোড গাড়িতে করে [এমন একটি যান, যা বিভিন্ন ধরনের খারাপ, অপ্রত্যাশিত বা দুর্গম পথে চলাচল করতে সক্ষম] নেকড়েগুলো থেকে ২৫ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে, এদের খাদ্য সংগ্রহের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেন।
ইথিওপিয়ান নেকড়েদের প্রধান খাবার আফ্রিকান মোল র্যাট-এর [আফ্রিকান মোল ইঁদুর] মতো ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণী। তবে বিজ্ঞানীরা ভিডিও এবং ছবি তুলে দেখতে পেয়েছেন, এরা ফুল চেটে খেতে পছন্দ করে। গাছ এবং পরাগবাহী প্রাণীর মধ্যে এটি বিরল এক ধরনের সম্পর্ক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিফোফিয়া ফলিওসা (Kniphofia foliosa) নামের এই ফুল টর্চ লিলি প্রজাতির সদস্য। এই জাতীয় ফুলগুলো সাধারণত বিভিন্ন প্রাণী ও পতঙ্গকে আকর্ষণ করে, বিশেষ করে জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে ফুল ফোটার মৌসুমে।
স্যান্ড্রা লাই বলেন, "ইথিওপিয়ান নেকড়েদের পরাগবাহী হিসেবে কাজ করার সক্ষমতা তাদের একটি ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগ নিয়ে গিয়ে ফল উৎপন্ন করতে পারার ওপর নির্ভর করে। এটি এখনও পরীক্ষা করা হয়নি।" তিনি আরও বলেন, "এ বছর আমরা দেখেছি, বড় নেকড়েরা ছোট নেকড়েদের ফুলের মাঠে নিয়ে গেছে, যা সাংস্কৃতিক স্থানান্তরের ইঙ্গিত হতে পারে।" এই আচরণটি বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত ছিল, কিন্তু এটি কখনোই নথিবদ্ধ করা হয়নি।
গবেষকরা স্বীকার করেছেন, এসব নেকড়েদের খাদ্যাভ্যাসে পরাগ কী ভূমিকা পালন করে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এবং এই প্রাণীগুলো প্রকৃতপক্ষে কার্যকর পরাগবাহী কি না, তাও এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
কৃষি পরিবেশবিদ হেসুস কুইন্তানো ব্যাখ্যা করে বলেছেন, একটি গাছকে পরাগিত করার জন্য অনেক ধরনের প্রজাতি কাজ করে, কিছু প্রজাতি প্রধান ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, কিছু প্রাণী শুধু সহায়ক হিসেবে কাজ করে এবং এই প্রক্রিয়াটি আরও ভালো করতে সাহায্য করতে পারে।
হেসুস নিজে গবেষণার অংশ ছিলেন না। তবে তিনি বলেন, "তাদের গবেষণা করতে হবে, নেকড়ে দিয়ে পরাগিত গাছের জন্য পরাগ পরিবহণের গুরুত্ব কতটুকু। আমি ভয়ে আছি, এই ক্ষেত্রে এটি একটি ছোট ভূমিকা হতে পারে।"
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরাগ পরিবহণ করে পতঙ্গ। তবে আরো কিছু প্রাণী পরাগায়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু সরীসৃপ যেমন বালিয়ারিক লিজার্ড, হামিংবার্ড এর মতো ছোট পাখি এবং বাদুড়ের মতো ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী পরাগ পরিবহণ করে।
কুইন্তানো জানান, স্পেনের পশ্চিমাঞ্চল এক্সত্রেমাদুরাতে অ্যানাগাইরিস ফোইটিডা (Anagyris foetida) নামের একটি গাছ সাধারণত কমন চিফচাফ এবং ওয়ারব্লার পাখিদের মাধ্যমে পরাগিত হয়। এই পাখিগুলো গাছের ফুলে এসে পরাগ নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, "এটি ২০০৫ সালে ইউরোপে প্রথমবারের মতো রেকর্ড করা হয়েছিল এবং কীভাবে এই পাখিগুলো মিষ্টি রসকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে তা আবিষ্কৃত হয়েছিল।"
কুইন্তানো যে ঘটনার কথা বলছেন, সেটি জীববিজ্ঞানে অর্নিথোফিলি নামে পরিচিত। এই পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় পাখিরা একটি গাছের ফুলের পরাগবাহী হিসেবে কাজ করে।
নেকড়েরা বীজও ছড়িয়ে দেয়
মালয়েশিয়ার সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এলিসিয়া সোলানা বলেন, "গাছপালা এবং প্রাণী উভয়ই আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে।" উড়ন্ত নয় এমন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাধ্যমে যে পরাগায়ন ঘটে সেটিকে থেরোফিলি বলা হয়। এই বিজ্ঞানী এবং তার দল বর্তমানে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে ধূসর নেকড়ের (Canis lupus) বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছে।
আলকালা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন গবেষক আঞ্জেল এম. সানচেজ ব্যাখ্যা করে বলেন, এই প্রাণীগুলো বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত। তিনি বলেন, "নেকড়েরা কিছু সময় জুনিপার বেরি, ব্লুবেরি অথবা এমনকি আঙুরও খায়, যা অস্বাভাবিক নয়। তাদের মল সংগ্রহ করে আমরা এই তথ্য নিশ্চিত করেছি।"
কেন্দ্রীয় আইবেরিয়ান সিস্টেমে ধূসর নেকড়ের বাসস্থানের ওপর কেন্দ্র করে হওয়া এই বিশ্লেষণ ২০২৫ সালে প্রকাশিত হবে। এই সিস্টেমটি স্পেনের আভিলা, মাদ্রিদ, সেগোভিয়া এবং গুয়াদালাহারা প্রদেশের মধ্যে অবস্থিত।
বীজ পরিবাহী এবং সম্ভবত পরাগবাহী হিসেবে ইথিওপিয়ান নেকড়েদের ভূমিকা সম্পর্কে গবেষক এলিসিয়া সোলানা বলেন, "এগুলো কম পরিচিত সেবা, তবে খুবই মূল্যবান; বিশেষ করে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নেকড়ে এবং তার পরিবেশবিদ্যা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য। এটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, শিকারিরা প্রকৃতিতে অন্যান্য ভূমিকা পালনও করতে পারে।"