পাকিস্তান পেল রাশিয়ান তেলের চালান: দক্ষিণ এশিয়ায় রুশ প্রভাব কি নতুন মাত্রা পাবে?
অর্থনীতি হোক বা রাজনীতি – কঠিন এক দুঃসময় চলছে পাকিস্তানে। সরকারের আর্থিক হিসাবও নেতিবাচক। দ্রব্যমূল্যের চড়া দামে পরিত্রাহী দশা জনতার। সেদেশের বর্তমান সরকার ওয়াশিংটনের সমর্থনপুষ্ট এমন অভিযোগ বিরোধীদের। আর জনতার বড় অংশও তা মনে করছে। ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খানের জনপ্রিয়তা তাই পিপিপি-পিএমএলএন জোট সরকারের মাথাব্যথা হয়েই রয়েছে। ইমরান পাকিস্তানের পরীক্ষিত বন্ধু - চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে চেয়েছিলেন। উদ্যোগ নেন রাশিয়ার সাথেও সম্পর্কোন্নয়নের। মস্কোর সাথে জ্বালানি খাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্ব সবার আগে ইমরানই বুঝেছিলেন। এরপর তাকে ক্ষমতাও হারাতে হয়েছে। সে যাই হোক, রাশিয়ার সস্তা জ্বালানির কোনো বিকল্প কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান সরকারও খুঁজে পাচ্ছে না। এজন্য সম্প্রতি মস্কোর সাথে মূল্যছাড়ে তেল কেনার চুক্তি করে ইসলামাবাদ। চলতি সপ্তাহে প্রথম রাশিয়ান জ্বালানিবাহী জাহাজ পৌঁছেছে করাচি বন্দরে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতির এক বিশ্লেষণ কষেছেন মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক লেখক, বিশ্লেষক এবং ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ওই নিবন্ধের নির্বাচিত অংশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
গত রোববার করাচি বন্দরে লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) খালাস করেছে রাশিয়ার একটি জাহাজ। গত এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে যে যুক্তি হয়, তারই আওতায় এ চালানে আসে ১ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম পাকিস্তানে মূল্যছাড়ে তেল বিক্রি করছে রাশিয়া। যখন উভয় দেশেরই বৈদেশিক মুদ্রা- বিশেষত ডলারের ঘাটতি রয়েছে।
এই চুক্তি রাশিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিরই নির্দেশক। বিশেষত যখন ভারতের সাথে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যেই রয়েছে। একইসঙ্গে, উন্নয়নশীল দেশগুলো যেভাবে মস্কোর সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়, তারও ইঙ্গিত বহন করে।
স্নায়ুযুদ্ধকালে ইসলামাবাদের মিত্রতা ছিল ওয়াশিংটনের সাথে। এসময়ে রাশিয়া-পাকিস্তানের সম্পর্কে চিড় ধরে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে – তালেবানের সঙ্গে আলোচনা ও সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানের আঙ্গিকে – সেই সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়। আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। চিরবৈরী ভারতকে এই অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বেছে নেওয়ায় ইমরান মস্কোর সাথে পাল্টা ঘনিষ্ঠতা তৈরির প্রচেষ্টা চালান। এরই অংশ হিসেবে, ২০২২ সালের ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি দুই দিনের সফরে মস্কো যান তৎকালীন এই প্রধানমন্ত্রী। আর ২৪ তারিখেই শুরু হয় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। এতে পশ্চিমা বিশ্বের বিষদৃষ্টিতে পড়েন ইমরান। যদিও এই সফরে তার মূল এজেন্ডা ছিল জ্বালানি সহযোগিতা।
এরপর সিন্ধু, বিয়াসে গড়িয়েছে অনেক স্রোত। ইমরান আর ক্ষমতায় নেই বটে, তবু পাকিস্তানের বর্তমান সরকারও যে রাশিয়ার সাথে সুলভ মূল্যের জ্বালানি চুক্তিতে খুবই আগ্রহী – সেটাও স্পষ্ট। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এপ্রিলে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি স্রেফ পরীক্ষামূলক উদ্যোগ। তবে এরপর চলতি সপ্তাহে পাকিস্তানের জ্বালানিমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, ইসলামাবাদ রাশিয়ান ক্রুড আমদানির মাধ্যমে দেশের এক-তৃতীয়াংশ তেলের চাহিদা পূরণ করতে চায়। জ্বালানি খাতে এটা হবে সুদূরপ্রসারী এক পরিবর্তন। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান বেশিরভাগ জ্বালানি তেল আমদানি করেছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে।
কিন্তু, পাকিস্তানকে আপন বলয়ে আনতে আন্তরিক প্রচেষ্টাই রয়েছে মস্কোর। গত সোমবার (১২ জুন) রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক আবেগপ্রবণ এক বক্তৃতা দিয়েছেন। সেখানে তিনি উর্দুতেই বলেন, 'পাকিস্তান-রুসি দোস্তি জিন্দাবাদ' (রাশিয়া-পাকিস্তান সম্পর্ক দীর্ঘজীবী হোক)।
চীনের সাথেও সম্পর্ক গভীরতর হচ্ছে রাশিয়ার। বাড়ছে বেইজিংকে পাঠানো অত্যাধুনিক অস্ত্রের চালান। এতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে নয়াদিল্লিতে। ভারতীয় নীতি-নির্ধারক মহলের শঙ্কা, এর ফলে চীনের চাপে ভারতের সাথে সামরিক সহযোগিতা সীমিত করতে পারে ক্রেমলিন।
অবশ্য এই মুহূর্তেই পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নবরূপ নেওয়ার দাবি সময়নিষ্ঠ হবে না। সেটা বাহুল্যই হবে, কারণ মস্কো-ইসলামাবাদের জ্বালানি সহযোগিতা বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলেও– সেটা টেকসই নাও হতে পারে। পাকিস্তান আর্থিক সংকটে, এই বাস্তবতায় রাশিয়ান ক্রুড পরিশোধনের যে খরচ, তা দেশটি বহন করতে পারবে কিনা- সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। পাকিস্তানী বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই আমদানি স্থানীয় বাজারে জ্বালানির চড়া দাম কমাতে পারবে না।
পাকিস্তানের বর্তমান সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে নারাজ করতেও চায় না। ইসলামাবাদ ভালো করেই জানে, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রভাব। ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপিত মূল্যসীমার চেয়ে বেশি দর দিয়ে মস্কোর জ্বালানি কিনবে না ইসলামাবাদ। সেটা করলে পশ্চিমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার খড়্গই নেমে আসবে। এছাড়া, ভূরাজনৈতিক বিবেচনাও এক্ষেত্রে কাজ করবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের বিষয়ে নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে দেখাতে চায় পাকিস্তান। ইতোমধ্যেই দেশটি ইউক্রেনে আগ্নেয়াস্ত্রের চালান পাঠিয়েছে। তার বিপরীতে, রাশিয়া থেকে ছোটখাটো কিছু তেলের চালান কিনে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা চলছে। কিন্তু, এই জ্বালানি বাণিজ্য বড় পরিসরে হলে তখন আর ভারসাম্য থাকবে না। ওয়াশিংটনের নজরে, পাকিস্তানও হবে রাশিয়ার দোসর।
অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মৌলিক কিছু চুক্তির বাস্তবায়ন করছে। বাড়াচ্ছে যোগাযোগ ও গোয়েন্দা তথ্য-বিনিময়। গত সপ্তাহে নয়াদিল্লি সফরে এসে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ভারতকে দ্রুত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে আলোচনা করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর শীর্ষ ক্রেতা ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র সরবরাহে দেরি হচ্ছে রাশিয়ার। বিশেষত, পিছিয়েছে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ডেলিভারির দিনক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজারকে নিজ আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। লয়েড অস্টিনের সফরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যও ছিল তাই। যুক্তরাষ্ট্র যুক্তি দিচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে থাকা রাশিয়া কখনোই ভারতের নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা অংশীদার হতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্র যাই বলুক, এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার সাথে অংশীদারত্ব রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভারত। তবে একইসময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে চলেছে। কারণ, দিল্লি মনে করে, রাশিয়ার সর্বাধুনিক অস্ত্র ভারত যতোটা অনায়সে পায়, পশ্চিমা অংশীদাররা হয়তো ততোটা সহজে সর্বাধুনিক অস্ত্র প্রযুক্তিসহ দেবে না। আর দিলেও দাম হবে বহুগুণে বেশি। তাই ভারতের যুক্তি হচ্ছে, রুশ সমরাস্ত্র তাকে চীনকে ঠেকানোর সক্ষমতা দিচ্ছে। এই বাণিজ্য বন্ধ হলে মস্কো আরো বেশি নির্ভরশীল হবে বেইজিংয়ের প্রতি। তাতে ভারতের নিরাপত্তাই শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্রের চীন ঘেরাও কৌশলও দুর্বল হবে।
এভাবে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশও নিয়েছে একই নীতি। ঢাকা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রুশ জাহাজ যেমন ফিরিয়ে দিয়েছে, তেমনি নিয়েছে রাশিয়া ও চীনের মুদ্রায় লেনদেনের উদ্যোগ। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলোর নীতিরই প্রতিফলন – যেখানে আজো মলিন হয়নি রাশিয়ার প্রভাব। উন্নয়নশীল বিশ্ব পশ্চিমের সাথে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক যেমন চায়, তেমনি চায় মস্কোর সহযোগিতা।