সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানিতে আরও নিয়ন্ত্রণ: প্রভাব পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ প্রযুক্তিতে
২০২২ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন ব্যুরো অভ ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সিকিউরিটি সেমিকন্ডাক্টর এবং এটি তৈরির কয়েক ধরনের যন্ত্র রপ্তানির ওপর নতুন বিধিনিষেধ জারি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন নতুন নিয়মের উদ্দেশ্য হচ্ছে চীন যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চক্ষমতার চিপ সংগ্রহ করতে না পারে।
দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম জারি রেখেছে। তবে এবারে নতুন এ বিধিনিষেধ দেশটির রপ্তানি নীতিতে একটি বড় পরিবর্তন।
আগের নীতিমালা নকশা করা হয়েছিল বৈরী দেশগুলোকে, বিশেষ করে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি থেকে এক বা দুই প্রজন্ম পিছিয়ে রাখতে। এ নিয়ম অনুযায়ী, নতুন কোনো প্রযুক্তি তৈরি হলে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াত যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ওই প্রযুক্তির পুরোনো প্রজন্ম রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হতো।
এ নিয়ন্ত্রণের তিন প্রকার প্রভাব দেখা যেত। চীন সবচেয়ে অগ্রসর প্রযুক্তি হাতে পেত না। চীনের কাছে পুরোনো প্রযুক্তি বিক্রি করে পাওয়া অর্থ মার্কিন কোম্পানিগুলো গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে ব্যয় করতে পারত। এবং পুরোনো প্রজন্মের প্রযুক্তির কারণে চীনের পক্ষে মার্কিন প্রযুক্তির সমকক্ষ কোনো বিকল্প প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব হতো না।
কিন্তু বেশ কয়েকবছর আগে থেকে চীন স্বাধীনভাবে নিজের প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। আর এরই জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে রপ্তানি নিয়ম জারি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রযুক্তিক্ষেত্রেও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ রেখা তৈরি করতে চাচ্ছে।
চীনকে প্রযুক্তির দৌড়ে পিছিয়ে রাখার চেষ্টার বদলে যুক্তরাষ্ট্র এখন সক্রিয়ভাবে চীনের সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
তবে নতুন এ বিধিনিষেধের স্বল্পমেয়াদি প্রভাব চিপ নির্মাতাদের ওপর খুব বেশি পড়ছে না বলেই আপাতভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর কারণ এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় অল্প সংখ্যক চিপই পড়েছে। কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্রপাতি নির্মাতাদের জন্য এর প্রভাব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, কারণ এ নির্মাতা কোম্পানিগুলোর চীনে একটি বড় বাজার রয়েছে।
অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মূল্যায়নের জন্য তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। নতুন এ বিধিনিষেধের ফলে মার্কিন কোম্পানিগুলোর রাজস্বের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে? এ নিয়মের ফলে চীনের নিজস্ব প্রযুক্তি তৈরির নীতিতে কি গতি আসবে?
এবং নতুন এ নিয়মের ফলে শেষ পর্যন্ত কি 'ডিজাইনিং আউট' পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে? 'ডিজাইনিং আউট' বলতে বিশ্বের অন্য দেশের প্রযুক্তি পণ্য তৈরি করাকে বোঝায়, যেসব পণ্যে মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই।
এ মুহূর্তে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পুরোপুরি দেওয়া সম্ভব নয়। তবে কী হতে পারে, তা নিয়ে কিছুটা ধারণা করা যায়। মার্কিন কোম্পানিগুলোর রাজস্বের কথা চিন্তা করলে — তাৎক্ষণিক প্রভাবটা চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলোর ওপর কম পড়বে, কিন্তু বড় ধাক্কা খাবে যন্ত্রপাতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
সময়ের সাথে সাথে যখন নিয়ন্ত্রিত পণ্যের সংখ্যা বড় হতে থাকবে, রাজস্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও ক্রমশ বাদবে। এর ফলে পুঁজির অভাবে গবেষণা ও উন্নয়ন নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে মার্কিন কোম্পানিগুলো।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির কারণে চীন স্থানীয়ভাবে প্রযুক্তি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আরও বেশি জোর দিতে বাধ্য হবে।
তৃতীয় প্রশ্নের বিষয়ে কোনো কিছু ধারণা করা কঠিন। অতীতে 'ডিজাইন আউট' ঘটার নজির রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ছাড়া কোনো দেশের পক্ষেই নিজে থেকে চিপ বা চিপ তৈরির সরঞ্জাম নির্মাণ সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে।
কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে এ 'আপাতদৃষ্টি' কেবল অল্প কয়েক বছরের বিষয়। এর আগে স্যাটেলাইট নির্মাণশিল্পে 'ডিজাইন আউট'-এর ঘটনা ঘটেছিল। তখন স্রেফ কয়েক বছরের ব্যবধানে স্যাটেলাইট বাণিজ্যে মার্কিনীদের হিস্যা ৭৫ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল।
বর্তমান নিয়মের ফলে বিভিন্ন দেশে নিজস্ব প্রযুক্তিতে চিপ তৈরির ক্ষেত্রে ক্রমশ প্রণোদনা বাড়তে পারে, যার ফলে মার্কিন চিপ প্রযুক্তির সমকক্ষ বিকল্প তৈরি হওয়া মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
শেষ পর্যন্ত এ মার্কিন বিধিনিষেধই তাদের কোম্পানিগুলোর মার্কেট শেয়ার ও আয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
তবে চিপ নির্মাণশিল্পের ক্ষেত্রে শুরুর বাধাটা অনেক বেশি। এ শিল্পে শুরু থেকেই বৃহৎ পুঁজি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু মার্কিন বিধিনিষেধ দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে বিকল্প সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।
এ পরিস্থিতি থেকে এশীয় দেশগুলোর লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ চেইন থেকে চীনা পণ্য সরিয়ে ফেলতে চাইছে।
তার বিকল্প হিসেবে এ কোম্পানিগুলো ভিন্ন উৎস খুঁজবে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া একটি চমৎকার উৎস হতে পারে, তবে এ অঞ্চলের কোন দেশ এ সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তা দেশগুলোর সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।
আবার অন্যদিকে মার্কিন প্রযুক্তি বাদ দিয়ে স্থানীয় প্রযুক্তিতে চিপ তৈরি করতে চেষ্টা করা নতুন কোম্পানিগুলোও সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন কাঁচামালের জন্য এশিয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ রপ্তানি বিধিনিষেধের কিছুটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কা লাগতে পারে এর মিত্র দেশগুলোর ওপরও — আর তাও বিবেচনায় রাখতে হবে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি এ দেশটিকে।
উইলিয়াম এ. রাইনশ: শল চেয়ার, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)।
এমিলি বেনসন: পরিচালক, প্রজেক্ট অন ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি; জ্যেষ্ঠ ফেলো, শল চেয়ার, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।