যখন কাচ্চি বিরিয়ানির জায়গা দখল করলো কাঁচামরিচ!
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাদের অধিকাংশের কাছেই পোলাও-কোর্মা বা পোলাও-মাংস ও কাচ্চি বিরিয়ানিই সবচেয়ে খানদানি খাবার। কোনো দাওয়াতে এগুলো খাওয়ালে আমরা বর্তে যাই। বাসায় বা বাইরে গিয়ে ভালোমন্দ কিছু খাওয়া মানেই পোলাও-মাংস। এগুলো সাধারণত রাজা বা ধনীরাই নিয়মিত খাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আমার তো মনেহয় এই খাবারগুলো খাদ্যগুণের জন্য নয়, বরং ধনীরা অনায়াসে খেতে পারেন বলেই হয়তো নাম হয়েছে "রিচ ফুড"। যাক তামাশা বাদ দিয়ে মূল প্রসঙ্গে আসি, ইদানিং দেখছি সেই পোলাও-মাংস বা কাচ্চির জায়গা নিয়েছে কাঁচামরিচ, আদা, পিঁয়াজ এসব মামুলি মশলাপাতি। এমনকি এইসব পাওয়ার জন্য হাতাহাতি, মারামারির সংবাদও পাচ্ছি।
এইতো সেদিন পটুয়াখালীর বাউফলে বিয়ের অনুষ্ঠানে 'কাঁচামরিচ-সালাদ না দেওয়ায়' সংঘর্ষে আহত হয়েছে ১৫ জন। খাবার টেবিলে মাছ-মাংস, পোলাও দিলেও সেখানে কাঁচামরিচ ও সালাদ দেওয়া হয়নি বলে বরপক্ষ হইচই শুরু করেন এবং একপর্যায়ে উভয়পক্ষের লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, যা প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে চলে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বিয়ের বাড়িতে এর আগেও বর ও কনেপক্ষের মধ্যে বহুবার বহু বিষয়ে সংঘর্ষ হয়েছে কিন্তু কাঁচামরিচকে কেন্দ্র করে মারামারি ও আহত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। আমার আশংকা হচ্ছে, এইভাবে চললে অচিরেই যৌতুকের তালিকায় স্বর্ণ, খাট, সোফা, সাইকেল বা ঘড়ির পাশাপাশি কাঁচামরিচ বা আদা-রসুনও যোগ হতে পারে।
সেদিন এক আত্মীয়ের বাসায় নুডুলস, মিষ্টিসহ আরো কিছু খাবার খেতে দিয়েছিল আমাদের। দেখলাম সুতার মতো চিকন স্লাইস করে কেটে নুডুলসে কাঁচামরিচের ফালিও দেয়া হয়েছে। তাই দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। বলেই বসলাম নুডুলসে কাঁচামরিচও দিয়েছেন? আমার বোন অমায়িক হেসে বললো, "তোরা এতদিন পর এলি, তাই আরকি দিলাম একটা মরিচ।"
অবস্থাটা আসলে এরকমই দাঁড়িয়েছে। হয় বেগুন, না হয় মরিচ, পেঁয়াজ বা রসুন, চিনি, লবণ, ডিম, তেল, দুধ, আটা, চাল কিছু না কিছুর অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য খবর হয়ে থাকছে। এসব নিয়ে উস্মা প্রকাশ করলে বা স্ট্যাটাস দিলে বিভিন্নজন খুব সহজ একটি উপায় বলে দেন। তারা বলেন, 'এই বয়সে তোমার বা তোমাদের শরীরের জন্য চিনি-তেল খারাপ, না খাওয়াটাই মঙ্গল।' কথা সত্য, এইসব জিনিস প্রায় বিষাক্ত শরীরের জন্য।
কিন্তু ঘটনা হলো সংসারে তো আমি বা আমার বয়সী সদস্য ছাড়াও অন্যরা রয়েছেন। তাদের তো এইসব খাদ্যের চাহিদা থাকতেই পারে। একথা ঠিক যে, কোন দ্রব্যের হঠাৎ আকাশচুম্বী দাম হলে হয়তো কিছুদিন সংযম দেখানো ভাল। তাতে কালোবাজারিরা একটা ধাক্কা খেতে পারেন। কিন্তু কতদিন প্রয়োজনীয় দ্রব্য না কিনে থাকা যায়?
আলোচনা প্রসঙ্গে কানাডার দ্রব্যের উচ্চমূল্য বিষয়ক একটি গল্প উল্লেখ করছি, বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোর সাথে যোগসাজস করে পাউরুটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলো 'কানাডা ব্রেড'। বিভিন্ন সময়ে পাউরুটিপ্রতি ৬ থেকে ৭ সেন্টস করে বাড়িয়ে দিয়েছিলো তারা। কম্পিটিশন ব্যুরোর তদন্তে যোগসাজসে পাউরুটির দাম বাড়ানোর ঘটনা প্রমাণিত হবার পর আদালত কোম্পানিটিকে ৫০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে। 'কানাডা ব্রেড কোম্পানি' দায় স্বীকার করে নিয়েছে (শওগাত আলী সাগর, সাংবাদিক, টরেন্টো)।
বাংলাদেশে সমস্যাটা ঠিক এখানেই। দাম বাড়ানোর যোগসাজস করার দায়ে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না, এই অপরাধে কোন সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করা হয় না, শাস্তিও হয় না। আর সেই কারণেই এই দেশে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে, বাজার অস্থিতিশীল হয় এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমতেই থাকে।
শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, ২০২২ সালের মে মাসের সঙ্গে চলতি বছরের একই মাসের তুলনা করলে দেখবো যে, আরও অনেক খাতেই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বেড়েছে বাড়িভাড়া, পরিবহন খরচ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়। গত এক বছরে ভোজ্যতেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে এর কোন প্রভাব পড়েনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অবশ্য এজন্য সরবরাহ চেইনের অসঙ্গতিকে দায়ী করেছেন।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে শুধু চাল, ভোজ্যতেল ও মসুর ডালের দাম কমেছে। বাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম ওঠানামা করলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেশি ছিল। এছাড়া সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধন সামগ্রী, টিস্যুসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশ বেড়েছে। এতে করে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তদের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের খরচ কমাতে হয়েছে। অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়াও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন নিম্নবিত্ত, স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের কথা নিয়ে আলোচনা করারও অবান্তর মনে হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলেছে, বাংলাদেশে গত চার বছরে ধনী-গরীব সবার আয় বাড়লেও সে তুলনায় আয় বাড়ার হার সবচেয়ে কম নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তবে সব শ্রেণীর মানুষেরই খরচ বেড়েছে এবং আয় বৈষম্যও বেড়েছে।
দেশের অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে পারছেন না বা যোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, দেশের অনেক শিশু একটু ভাতের জন্য কাজ করে অথবা ভিক্ষা করে। দেশে প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষের জন্য চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত নেই। যে দেশে বর্তমানে মানুষ একটু কম দামে চাল, ডাল, তেল কিনবেন বলে ২/৩ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং অনেক মধ্যবিত্ত চোখের পানি লুকিয়ে নিম্নবিত্তের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন, সেই দেশ থেকেই বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হয়েছে দুবাইয়ে। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে কিছুটা আলোচনা হচ্ছে বলে, এখন বাংলাদেশের অসৎ ধনী ব্যক্তিবর্গ টাকা মজুদ করার জন্য বিকল্প জায়গার খোঁজ করছেন, হায়রে জীবনের বৈপরীত্য।
গত এক দশকেরও একটু বেশি সময়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৪.৩ শতাংশ হারে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা। এক্ষেত্রে বিশ্বতালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। সংস্থাটি বলেছে যাদের সম্পদের পরিমাণ ৫০ লাখ ডলারের বেশি, তাদের নামই এখানে এসেছে (ডয়েচে ভেলে)।
'ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৯' শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল দেশের তালিকায় ধনী জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাওয়ার সংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। ২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত এর চলার গতি ধরে এ হিসাব করেছে ওয়েলথ-এক্স। নতুন প্রতিবেদনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধনী বৃদ্ধির হারে শীর্ষে থাকবে এমন ১০টি দেশের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে, যেখানে শীর্ষে আছে নাইজেরিয়া। এরপরে আছে মিসর। এবং তালিকার তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ।
কেমন করে বাংলাদেশের মতো ঋণনির্ভর একটি দেশের কিছু মানুষ বিশ্বের ধনী তালিকার শীর্ষে থাকতে পারেন, এই কথা বোঝার জন্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নাই। এদের অধিকাংশই যে জনগণের গর্দান কেটে কালো টাকার মালিক হয়েছেন, তা বুঝতে কারো কোন অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশে কালো টাকাটা এসেছে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটপাট এই দুটো পথেই। নামে-বেনামে নেওয়া ব্যাংক ঋণের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। শুনেছি বিশ্বের অন্য দেশে শীর্ষ ধনী তালিকায় যাদের নাম, তারা সব ধরনের কর দেওয়ার পরেই শীর্ষ ধনী। বাংলাদেশে এর উল্টো, কর দেন না বা কর ফাঁকি দেন বলেই অনেকে বিরাট ধনী।
অর্থনীতি বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুম তার একটি লেখায় লিখেছিলেন, "একটা সময় লাখের বাতি জ্বালানোর প্রচলন ছিল। কেউ লাখপতি হলে বাড়ির সামনে উঁচুতে একটা বাতি বেঁধে দেওয়া হতো। আর তাতেই লোকে বুঝতে পারতো, এটা লাখপতির বাড়ি।" আমার মনে হলো এখন কিন্তু এই পরিচয় দেয়ার ব্যবস্থাটা পাল্টে গেছে। লাখপতির জায়গায় এসেছেন হাজার কোটিপতিরা। এরা কিন্তু তাদের প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে উঁচুতে বাতি বেঁধে রাখেন না, বরং তারা দুবাইতে বাড়ি কেনেন, কানাডায় মহল্লা গড়ে তোলেন, বিদেশী ব্যাংকে টাকা পাচার করেন।
অথচ দেশের এই কোটিপতিরা যদি চাইতেন, তাহলে বিদেশী ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়ার পাশাপাশি পারতেন দারিদ্র ঠেকাতে, অসংখ্য মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, টিসিবি'র লাইনে ভিড় কমাতে, অসংখ্য শিশুর খাদ্য, চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে; প্রকট আয় বৈষম্যকে কমিয়ে আনতে।
কিন্তু তারা তা করেন না, এমনকি দেশের মানুষের পিঠে ছুরিকাঘাত করা ছাড়া অন্যকিছু ভাবেনও না। রবীন্দ্রনাথের কথা ধরে বলতে হয়, 'ধন জিনিসটাকে আমাদের দেশ সচেতনভাবে অনুভব করিতেই পারিল না, এইজন্য আমাদের দেশের কৃপণতাও কুশ্রী, বিলাসও বীভৎস।' (বোম্বাই শহর, পথের সঞ্চয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
- লেখক: যোগাযোগকর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।