গাড়ি কেনার আগে একবার এই বিষয়গুলো ভাবুন
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর আমি দুজন হাঁটছিলাম। আমার বন্ধু আমার সাথে একটি বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতে চাইল। সে বলল, তার কাছে কিছু টাকা আছে, সে একটি গাড়ি কিনতে চায়। এই প্রশ্নটি শুধু আমার বন্ধুর নয় অনেকেরই এই বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন আছে। আসলে আস্তে আস্তে বয়স বাড়ছে, কিছু টাকা সঞ্চয় হয়েছে, একটা গাড়ি তো কেনা হলো না। সুতরাং, একটা গাড়ি কেনা অনেকের কাছে নিজেকে পেমেন্ট করা, নিজেকে পুরস্কৃত করার সমান।
গাড়ি অনেকের কাছে বিলাস, অনেকের কাছে শখ, অনেকের কাছে আভিজাত্য আবার অনেকের কাছে এটা নেসেসিটি। গাড়ি ছাড়া কোথাও বেরই হতে পারেন না এমন অনেক মানুষ আছেন। আমার বন্ধুর অবস্থা সে রকম নয়। গাড়ি কিনলে এটাই হবে তার প্রথম গাড়ি।
কিছু টাকা আছে একটি গাড়ি কিনতে চাই, কিনবো? আপনাকে যখনই কেউ এই প্রশ্নটি করবে আপনি হয়ত সাথে সাথে বলে দেবেন যে 'কিনে ফেলো'। কারণ যদি একটি গাড়ি কেনাতে পারেন কাউকে, যে এতদিন গাড়ি চড়েনি তার স্বপ্ন পূরণ হলো ঠিকই, কিন্তু তার গায়ে আপনি একটি খরচের আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। বিষয়টি আমি ঠাট্টা করে বললাম।
যখনই আপনি কোনো গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন বেশ কয়েকটি ব্যাপার আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি গাড়ি কেনা শুধু কিন্তু গাড়ি কেনা নয়। আপনার কাছে কিছু টাকা ছিল সেটা আপনার খরচ হয়ে যাবে এই ভেবে আপনি গাড়ি কিনলেন, মানে একটা অ্যাসেট কিনলেন, এবার আপনি বেঁচে গেলেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। গাড়ি কেনার আগে আপনি ভেবে দেখুন যে, ইমার্জেন্সি ফান্ড আপনি গঠন করেছেন কিনা। যদি দেখেন আপনার তিন থেকে ছয় মাস বা একবছর সময় চলার জন্যে যে টাকাটা দরকার সেটা একপাশে সরানো আছে, তাহলে আপনি একটা ধাপ অতিক্রম করলেন মাত্র। তার মানে আপনার যদি বড় কোনো বিপদ আসে গাড়ি কেনার পরেও তাহলে গাড়িটা বেচতে হবে না, আপনার ইমার্জেন্সি ফান্ড যেটা আছে সেটা দিয়ে আপনি চালিয়ে নিতে পারবেন।
আপনি দেখবেন, আপনার যে আয় সেই আয় দিয়ে চলতে আপনার খুব কষ্ট হয় কিনা। যদি সেই আয় দিয়ে চলতে কষ্ট হয়, তাহলে গাড়ি কেনা আপনার জন্য সাংঘাতিক একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ গাড়ি কিনলেই আপনার এখন যে খরচ আছে, তার মিনিমাম টোয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট খরচ বেড়ে যাবে। কারো কারো ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশি। কারণ গাড়ি কিনলেই আপনার একটা গ্যারেজের প্রশ্ন আসবে। গ্যারেজ ভাড়া করতে মিনিমাম পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। আপনি আবার ভাবতে পারেন, এখন যে ফ্লাটে থাকেন তার ভাড়া বিশ হাজার টাকা। একটা গ্যারেজসহ ফ্লাট নিলে আপনার ভাড়া দিতে হবে মিনিমাম ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। সুতরাং একটা নতুন বাসাই নিয়ে নিই গ্যারেজসহ। তাহলে এখানে দেখেন ভাড়া কিছুটা বেড়ে যাচ্ছে। আপনি যদি এলাকা পরিবর্তন করেন, সেক্ষেত্রে কোনো কোনো এলাকার লিভিং কস্ট বেশি, কোনো কোনো এলাকার লিভিং কস্ট কম। যদি আপনি একটু ভাল এলাকায় যান, তাহলে আপনার লাইফ স্ট্যান্ডার্ড বাড়বে, আপনার খরচও বাড়বে।
যদি আপনি পুরানো গাড়ি কেনেন তাহলে দেখবেন যে, আপনার সার্ভিসিং করাতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। দেখা যাবে- আজ এই পার্টস নষ্ট, কাল ওটা নষ্ট, পরশুদিন আরেকটা নষ্ট, এর পরের দিন চাকা পাল্টাতে হচ্ছে। দেখবেন প্রতি মাসে কিছু না কিছু খরচ লেগেই আছে। আপনার একটা ড্রাইভার রাখতে হবে। সে ড্রাইভারের পেছনে পনেরো থেকে বিশ হাজার টাকা বেতন বাবদ খরচ। এছাড়া, তার খাবার খরচ আছে। আপনাকে এই সব বিবেচনায় নিতে হবে। আবার গাড়ির পেছনে প্রচুর জ্বালানি তেল লাগে। ফুয়েল কস্ট অনেক খরচ বেড়েছে। ফলে যে গাড়ি কিনেন না কেন, প্রতি মাসে পনেরো/বিশ হাজার টাকা আপনার এই ফুয়েলের পেছনে খরচ হবে। এটা আপনাকে চিন্তা করতে হবে।
হয়তো আপনি ভাববেন, গাড়ি কিনে আমি ভ্রমণ করব না, অল্প কিছু দূর যাবো। ভুললে চলবে না যে গাড়ি অনেক ছুটতে পারে। এই গাড়ির ছোটার সাথে সাথে আপনার মনও ছুটতে থাকবে। ফলে আপনি গাড়ি কেনার পরে দেখবেন ভ্রমণ বাড়িয়েছেন। আগে আপনি শ্বশুরবাড়ি যেতেন মাসে একবার। এখন গাড়ি কেনার পরে যাবেন তিনবার। আপনার স্ত্রী আগে যেতেন মাসে দুবার, এখন যাবেন চারবার। আপনি বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে পারতেন না যানবাহনের অভাবে। এখন বাচ্চাদের নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বেরুতে ইচ্ছা করবে। যখন বাইরে ঘুরতে যাবেন শুধু ঘুরবেন না কিছু খাবেন। গাড়ির ফুয়েল খরচও বাড়বে।
একটা গাড়ি আপনার জীবনযাত্রার চতুর্দিকে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে যাবে। আপনার খরচকে অনেক উস্কে দিবে। গাড়ি থেকে যখন নামবেন, তখন আপনার সুন্দর একটা ড্রেস নাহলে কেমন দেখায়। যখন আপনার ড্রেসটা সুন্দর তখন আপনার পরিবারের সবার ড্রেস আরো সুন্দর হওয়া দরকার। আর যদি আপনি ব্র্যান্ডে আসক্ত হন তাহলে তো কথাই নেই। যে একটা ব্র্যান্ড আপনি পরতেন এখন পরিবারের সবাইকে সেই ব্র্যান্ডের পোশাক কিনে দিতে হবে। সুতরাং, গাড়ির সাথে ড্রেসটা তো মানান সই হতে হবে। হাতে একটা সুন্দর ঘড়ি না থাকলে কেমন হয়? এরকম অনেক অযাচিত খরচ যেটা আপনি আগে হয়ত চিন্তা করেননি, সেইগুলো এখন আপনার মাথায় এবং পরিবারের অন্যদের মাথায় চলে আসবে। একটা গাড়ি আপনার জীবনমানকে বাড়িয়ে দেবে বটে, কিন্তু জীবন মানের চাইতে আপনার খরচ টেনে আপনার গলায় রশি পরিয়ে দেবে।
তার অর্থ কি এই যে, আমি আপনাকে গাড়ি কিনতে বারণ করছি? না মোটেও তা নয়। আমার বন্ধুকেও বলি গাড়ি কিনতে। একটা গাড়ি এখন ঢাকা শহরে খুব দরকার। কিন্তু আমি শুধু বললাম এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো। যদি এমন হয় যে, আজকে আপনি গাড়ি কিনলেন, ছয় মাস পরে গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে আবার সেই হাঁটাহাঁটি শুরু করতে হল, তাহলে সেই গাড়ি কেনার কোনো অর্থ হয় না।
ফলে আপনি সব কিছু ভেবে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। গাড়ি কিনলে আপনার আয় বাড়বে না, কিন্তু খরচ অনেক বাড়বে। এই খরচকে আপনি সামাল দিতে পারবেন তো? আপনার যেগুলো সেভিংস স্কিম আছে সেগুলো চলবে তো? আপনার ইন্সুরেন্স স্কিম থাকলে সেটা চলবে তো? আপনি বাড়িতে বাবা মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠান, এটা আপনি পাঠাতে পারবেন তো? আপনি খাতা কলম নিয়ে ক্যালকুলেশন করুন। গাড়ির মধ্যে আর একটা খরচের কথা আমি বলিনি। সেটা হচ্ছে- ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন করতে হয়, সেখানে টাকার ব্যাপার আছে। তারপরে আরেকটা খরচ হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ যদি হঠাৎ হঠাৎ আপনার গাড়ি ধরে তাহলে সেখানে কেস করলে অনেক টাকা খরচের বিষয় আছে। আবার যদি ওনাদেরকে ম্যানেজ করতে চান সেখানেও কিছু খরচাপাতির ব্যাপার আছে।
সব মিলিয়ে একটি গাড়ি আপনার খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে। আর যদি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনেন তাহলে ব্যাংকের মাসিক কিস্তির পেমেন্ট করতে হবে, সেটাও একটা বড় খরচ। সুতরাং গাড়ি কেনার আগে হিসাব করে দেখুন, গাড়ি কেনা আপনার সাধ্যের মধ্যে আছে কিনা এবং গাড়ি কেনার পরে আপনি আপনার জীবনকে সুন্দরভাবে চালাতে পারবেন কিনা।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল
ইমেইল: [email protected]
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।