ওয়াগনারের মক্কেলদের এবার নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে
ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর পরদিন মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ফস্তিন-আর্শান তুদেঘা'র একজন উপদেষ্টা ফিদেল গুয়ান্দজিকা আনুষ্ঠানিক পোশাকের বদলে সবুজ পায়জামা, সামরিক বুটজুতা, গানবেল্ট ও 'আমি ওয়াগনার' (জো সুই ওয়াগনার) লেখা টিশার্ট পরেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, 'প্রিগোজিন আমাদের কাছে একজন বীর… আমরা তাকে ভুলব না।'
কিন্তু একইসঙ্গে তিনি এটাও বলতে ভোলেননি, রাশিয়া ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক টিকে থাকবে (এ দেশটিতে ওয়াগনারের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে)। 'রাশিয়া মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের জন্য অনেক কিছু করেছে, সামনেও করবে,' তিনি বলেন।
গত ছয় বছরে আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে রাশিয়ার দ্বৈত পদ্ধতির অর্ধেকাংশের উদাহরণ তৈরি করেছে ওয়াগনার। একদিকে আফ্রিকার বিষয়ে চীন ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর মতোই পররাষ্ট্রনীতি প্রদর্শন করছে রাশিয়া। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের মতো কূটনৈতিকেরা এ মহাদেশে ভ্রমণ করে বিভিন্ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন।
অন্যদিকে আফ্রিকায় ওয়াগনারের ছায়া অপারেশন যেন ১৯ শতকের ঔপনিবেশিক কোনো ব্যাপারস্যাপার, কেবল ২১ শতকে এসে তা আধুনিক প্রযু্ক্তির ছোঁয়ায় গ্যাংস্টারিজমের রূপ পেয়েছে। এ মহাদেশকে নিয়ে রাশিয়ার সস্তা ও কিছুটা অস্বীকারযোগ্য পদ্ধতির সবচেয়ে কুখ্যাত নিদর্শন এ ওয়াগনার।
প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর আফ্রিকায় ওয়াগনারের ভবিষ্যত নিয়ে নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রাশিয়া তার এ সাম্রাজ্য ছেড়ে দিতে চায় না। তাই এটি এখন নিয়ন্ত্রণ নিতে ও ওয়াগনারের সেবাগ্রহীতাদের নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে।
হয়তো ক্রেমলিনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য কোনো সংস্থা, ব্যক্তি ওয়াগনারের ব্যবসার ভার তুলে নেবে। কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, ওয়াগনারের সাফল্যের প্রতিফলন ঘটানো হয়তো তাদের জন্য কঠিন হবে, বিশেষ করে অস্থিতিশীল ও অপরাধী এ সংগঠনের নেতৃত্ব রাশিয়া যদি খোদ আনুষ্ঠানিকভাবে নিতে অনীহা প্রকাশ করে।
ওয়াগনার এক সময় আফ্রিকার প্রায় ডজনখানেক দেশে এর উপস্থিতি স্থাপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কেবল চারটি দেশে গোষ্ঠীটির শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। আফ্রিকার অস্থিতিশীল এ চারটি দেশেই প্রিগোজিনের তৈরি করা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে তুদেঘা প্রশাসনের সঙ্গে ওয়াগনারের সরব সম্পর্ক রয়েছে। প্রেসিডেন্ট তুদেঘার দেহরক্ষী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টারা ওয়াগনারের সদস্য। রাজধানী বাঙ্গুইর বাইরে দেশটির সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্ব দেয় ওয়াগনার। এর বিনিময়ে ওয়াগনার নেটওয়ার্কের বিভিন্ন ফার্ম দেশটির মদ থেকে শুরু করে হীরা — সব ধরনের ব্যবসার ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ তৈরি করেছে।
ওয়াগনারের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যকার নিবিড় সম্পর্ককে হুট করে উলটপালট করতে চাইবে না ক্রেমলিন। ওয়াগনারের সদস্যরা এখনো কোনো রাখঢাক ছাড়াই বাঙ্গুইতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে শোনা যাচ্ছে, প্রিগোজিনের কিংবদন্তিকে কম করে দেখানোর চেষ্টা করছে রাশিয়া।
ওয়াগনারের মৃত্যুর খবর রাশিয়ান বিনিয়োগপুষ্ট স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো প্রচার করেনি। গত জুলাইয়ে রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনে প্রিগোজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তুদেঘাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তার বদলে সেখানে তাকে রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউ-এর প্রধান আন্দ্রে আভেরিয়ানভের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
গুয়ান্দজিকার ভাষায়, 'প্রিগোজিনের সুবিশাল এ কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখার জন্য রাশিয়া সহজেই নতুন নেতা পেয়ে যাবে।'
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ব্যবহার করে ওয়াগনার প্রতিবেশী সুদানে রসদ সরবরাহ করেছে। সুদানেও গোষ্ঠীটির দারুণ প্রভাব রয়েছে। আমেরিকান কর্মকর্তাদের দাবি, সুদানের র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে অস্ত্র দিয়েছে ওয়াগনার, তার বদলে এটি পেয়েছে সোনা।
প্রিগোজিনবিহীন রাশিয়াকে মনে হচ্ছে, এটি সুদানের অনিশ্চিত গৃহযুদ্ধকে নতুন করে সমন্বয় করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবার সামনে এগিয়ে যেতে হলে রাশিয়াকে আরেকটু সাবধানে এগোতে হবে। আরএসএফ-এর সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ওয়াগনার একটু বাড়াবাড়ি করেছে — এমন ইঙ্গিত ক্রেমলিন আগেই দিয়েছে।
অন্যদিকে লিবিয়ার ক্ষেত্রে হয়তো প্রিগোজিনের মৃত্যু রাশিয়ার পদক্ষেপকে আরও সমন্বিত করবে। খলিফা হাফতারের বাহিনীর পাশে থেকে দীর্ঘসময় লড়েছে ওয়াগনার। ২০১৯ সালে হাফতারের বাহিনী রাজধানী ত্রিপোলি দখল করতে চেয়েছিল। তা ব্যর্থ হওয়ার পর ওয়াগনারের ভাড়াটে যোদ্ধারা হাফতারের নিয়ন্ত্রণাধীন সামরিক ঘাঁটি ও তেল উৎপাদন স্থাপনাগুলোতে অবস্থান নিয়েছিল।
রাশিয়া অবশ্য ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, এটি এ সম্পর্ক ধরে রাখতে চায়। প্রিগোজিনের মৃত্যুর আগের দিন রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনুস-বেক ইয়েভকুরভের সঙ্গে বেনগাজিতে দেখা করেছিলেন খলিফা হাফতার। ফলে ভবিষ্যতে হয়তো হাফতার রাশিয়া থেকে সরাসরি সমর্থন পাবেন। এমনকি আফ্রিকার অন্য কোনো স্থানে কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য, ভূমধ্যসাগরের সম্ভাব্য বন্দর ও তেলের সরবরাহকারী হিসেবে রাশিয়া লিবিয়াতে এর ঘাঁটি আরও মজবুত করার চেষ্টা করতে পারে।
মালিতে প্রায় দুই বছর ধরে ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনীর সঙ্গে জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়ছে ওয়াগনার। স্যাটেলাইটের তোলা ছবিতে দেখা গেছে, প্রিগোজিনের পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে মালিতে ওয়াগনারের ঘাঁটির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এখানেও আরও সরাসরি হস্তক্ষেপের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। মালির জান্তাপ্রধান আসিমি গোইতা রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনে আভেরিয়ানভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে শোনা গেছে।
অবশ্য মালিকে সমর্থন দিতে রাশিয়া কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তার সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। দেশটিতে সশস্ত্র সংঘাতের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা গত বছর ৭৫ শতাংশ বেড়ে ১০ হাজারের অঙ্ক পার করেছে। এ বছর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে, বিশেষ করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী যেহেতু দেশটি থেকে বিদায় নিচ্ছে।
ক্রেমলিন তার আফ্রিকান মিত্রদেরকে দ্বিধাবিভক্ত কোনো পরিস্থিতিতে রেখে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেবে না বলে আশ্বস্ত করতে চাইছে। তবে আফ্রিকায় বেশি দহরম-মহরমও চায় না এটি। রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনে অন্য অনেক মার্সেনারি দলই ওয়াগনারের উচ্ছিষ্ট থেকে নিজেদের ব্যবসার পত্তন করার সুযোগ খুঁজেছিল।
রাশিয়ান সশস্ত্রবাহিনী ইউক্রেনে লড়াই করতে খাবি খাচ্ছে। আফ্রিকান মক্কেলরা যদি ক্রেমলিনের কাছে এখন আনুষ্ঠানিক সমর্থন চায়, সেক্ষেত্রে রুশ সামরিক বাহিনীর পক্ষে সে দায়িত্ব পালন করা কঠিন হবে বৈকি। আর ওয়াগনার গ্রুপ ও রাশিয়ার মূলধারার সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো প্রকার বন্দোবস্তও আরও বেশি অপ্রতিভ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদে প্রিগোজিনের বিকল্প পাওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 'তার ব্যক্তিত্ব ও কাজ সম্পাদনের পদ্ধতি ছাড়া আমার মনে হয় না এ পুরো অবকাঠামোটি কাজ চালিয়ে নিতে পারবে,' বলেন দ্য পোলিশ ইনস্টিটিউট অভ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর ইয়নদ্রে জেরেপ। তার মতে, 'আফ্রিকায় প্রিগোজিন একটা মাছের মতোন ছিলেন।' তার পরে যারা আসবেন, তারা ডুবেও যেতে পারেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।