চীনের প্রভাবে লাগাম টানার পশ্চিমা প্রচেষ্টাকে জটিল করল ভারতের বিরুদ্ধে ট্রুডোর অভিযোগ
কানাডার মাটিতে হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার পেছনে ভারতের হাত আছে বলে অভিযোগ করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
কানাডায় খালিস্তান আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী নিজ্জার হত্যায় ভারতের বিরুদ্ধে কানাডার আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে কানাডা-ভারত সম্পর্কে ক্ষয় সৃষ্টি করবে। আর এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এমন এক সময়ে যখন পশ্চিমাবিশ্ব ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চাইছে।
এ সপ্তাহে কানাডার পার্লামেন্টে নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডে ভারতের সংযোগের অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হয়েছেন ট্রুডো। ২০২৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে এলাকায় একটি শিখ গুরুদুয়ারার পার্কিংলটে নিজ্জারকে গুলি করে হত্যা করে আততায়ীরা।
কানাডার সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই একযোগে ভারতের নিন্দা করে বলেছে, ভারতের বিরুদ্ধে এ অভিযোগের অর্থ কানাডার সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ।
দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী মেলানি জলি এ ঘটনার জেরে কানাডায় পবন কুমার রায় নামক ভারতীয় একজন কূটনৈতিককে বহিষ্কার করেছেন। কানাডা সরকারের দাবি পবন কুমার ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র)-এর কানাডা দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
জলি আরও জানান, নিউ ইয়র্কে জি৭ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। এদিকে ভারত কানাডার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং প্রত্যুত্তর হিসেবে ভারতে কানাডার একজন কূটনৈতিককে বহিষ্কার করেছে।
উত্তেজনা চরমে
জি২০ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য জাস্টিন ট্রুডো যখন ভারত ভ্রমণ করেছিলেন, তখনও ভারত ও কানাডার মধ্যে উত্তেজনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
কানাডায় শিখদের খালিস্তান আন্দোলন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্রুডোর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শিখদের এ স্বাধীনতার আন্দোলনকে ভারত নিজেদের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার বিরুদ্ধে হুমকি মনে করে।
পাঞ্জাবের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ (অভিবাসী) কানাডায় বাস করেন। নিজ্জারের মতো আরও অনেক খালিস্তান সমর্থক স্বাধীন খালিস্তানের জন্য কানাডায় বিভিন্ন আন্দোলন ও সমাবেশ করছিলেন।
বাকস্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের যুক্তিতে জাস্টিন ট্রুডো এসব আন্দোলন-সমাবেশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে তার আনা অভিযোগের কথা ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁকে জানিয়েছেন।
কানাডা ও এর পশ্চিমামিত্ররা চীনকে ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। তাই ভারসাম্য তৈরি করতে এ দেশগুলো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কৌশলগত চেষ্টা করছে। কিন্তু কানাডার এ অভিযোগ এখন পুরো বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তুলল।
চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি অর্জনের বিপরীতে কানাডা ২০২২ সালে এর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রকাশ করে। সেখানে চীনকে 'ঐক্যনাশকারী শক্তি' হিসেবে আখ্যা দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে কানাডার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার অঙ্গীকার জানানো হয়েছে।
কানাডার এ কৌশলে ভারত নিয়ে আলাদা মনোযোগ রয়েছে।
ভারত-কানাডা বাণিজ্য উন্নয়ন
মুক্ত-বাণিজ্যের আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও উন্নত করারও অঙ্গীকার করেছে কানাডা।
এখন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে নয়বার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু নিজ্জারের হত্যার অভিযোগের পর এসব আলোচনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী ম্যারি ইং অক্টোবরে তার পূর্বনির্ধারিত ভারত সফর বাতিল করেছেন।
চীনের প্রভাব মোকাবিলার গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও ভারত সরকারের কর্তত্বপরায়ণ প্রবণতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং কানাডার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো ইন্দো-কানাডা সম্পর্ক উন্নয়নে অটোয়ার জন্য বড় বাধা হিসেবে উদয় হয়েছে।
তবে ট্রুডোর অভিযোগের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো কানাডার মিত্রদের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার সম্ভাবনা নেই। কৌশলগত ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব দেশের কাছে ভারতের গুরুত্ব অনেক বেশি।
চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এর আগে অটোয়া ইঙ্গিত দিয়েছিল, কানাডার কাছে ভারত একটি 'অগ্রাধিকারমূলক' বাজার। ২০২২ সালে কানাডার ১০ম শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার ছিল ভারত।
'গণতন্ত্র' অংশীদারি
চীনের বর্ধিষ্ণু প্রভাবে ছেদ আনতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি কৌশলগত সমঝোতা হয়েছে। এ সমঝোতাকে 'বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র', ও 'বিশ্বের বড় গণতন্ত্র'-এর অংশীদারিত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে সরে আসা বা কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাবের জন্য মোদি সরকার তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে।
তা সত্ত্বেও গত জুনে মোদি যখন হোয়াইট হাউস ভ্রমণ করেছিলেন, তখন বাইডেন প্রকাশ্যে মোদির সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিলেন। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যু নিয়ে কথা বলার জন্য বাইডেনের ওপর চাপ ছিল।
মোদির সঙ্গে মানবাধিকার সংকট নিয়ে আলোচনা করতে তখন ৭৫ জন কংগ্রেসনাল প্রতিনিধি বাইডেনকে লিখিতভাবে আহ্বান জানিয়েছিলেন। মার্কিন কংগ্রেসে মোদির বক্তব্য বয়কট করেছিলেন আধ ডজন ডেমোক্রেট।
তবে কথিত আছে, বাইডেন প্রশাসন মনে করে, মোদির কর্তৃত্ববাদী নীতির বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করলে তা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে।
ভারতকে জবাবদিহিতার মুখে আনা
প্রকৃতপক্ষেই, কানাডার মিত্ররা কৌশলগত বিবেচনায় মোদি সরকারের অনেক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু কানাডা ও এর মিত্রদের এখন মোদি সরকারের কাছ থেকে এর কাজের জবাবদিহিতা চাওয়ার সময় এসেছে।
ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার কৌশলগত অংশীদারিত্ব মূলত গড়ে উঠেছিল দুই অঞ্চলের অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি এবং দ্বিতীয় বৃহৎ সশস্ত্রবাহিনীর মালিক ভারত এখনো পশ্চিমাদের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী।
কিন্তু ভারত যদি এসব অভিন্ন নীতিমালা থেকে সরে আসে, সেক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যেন গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে তা নিশ্চিত করেই দুই অঞ্চলের অংশীদারিত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
এমনকি কানাডার মিত্ররাও যদি প্রকাশ্যে ট্রুডোকে সমর্থন না দেয়, তাও কানাডার সরকারের উচিত এর মৌলিক আদর্শের জায়গা থেকে বিচ্যুত না হওয়া। আর তা করতে হবে ভারত যেন এর কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের ফলভোগ করে তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে।
সাইরা ব্যানো কানাডার থমসন রিভার্স ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।