মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র–ইরান বন্দিবিনিময়: বরফ কি গলতে যাচ্ছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কখনোই একই সুরে কথা বলে না। তবে ভারতচন্দ্র বলেছিলেন — শিলা জলে ভাসি যায়, বানরে সঙ্গীত গায়, দেখিলেও না হয় প্রত্যয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর কাতারের দুই বছরের দূতিয়ালির ফসল হিসেবে বন্দিবিনিময় সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান। পাশাপাশি দক্ষিন কোরিয়াতে ফ্রিজ হয়ে থাকা ইরানের ৬০০ কোটি ডলারের সম্পদও ছাড়া হয় সেদিন।
উভয় দেশই এ বন্দিবিনিময়কে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ২০১৫ সালে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে এসে ইরানের ওপর নতুন স্যাংশন দেওয়ার সময় থেকে চলে আসা উত্তপ্ত সম্পর্ককে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক করেছে এ ঘটনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইরান যদি কঠোরভাবে পারমাণবিক চুক্তির শর্ত মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে ফেরত আসবে।
ওদিকে কোভিড-১৯-এ ভেঙে পড়া ইরানি অর্থনীতির জন্য ছয় বিলিয়ন ডলার সুবাতাস বয়ে আনবে। বন্দিবিনিময় চুক্তির অন্যতম ন্যাগোশিয়েটর ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, এ বিনিময় দেখিয়ে দিয়েছে, কূটনীতি কাজ করে এবং সংলাপের মধ্যে দিয়ে সমস্যার সমাধান হয়।
এ বন্দিবিনিময় অন্তত একটা জিনিস প্রমাণ করেছে — দুটি দেশের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ থাকলে দেশদুটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এ বিনিময় বন্দিদের পরিবার ও স্বজনদের জন্য শান্তি বয়ে এনেছে। আশাবাদ জেগে উঠেছে অন্যদের মনেও। মার্কিন যুক্তরাষ্টে এক ডজনের বেশি ইরানি নাগরিক আটক হয়ে আছেন।
তবে মানবিক দৃষ্টিকোণ যে এখানে বড় না, সেটাও বোঝা কষ্টসাধ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য কূটনৈতিক এবং মার্কিন প্রক্রিয়াতে তা স্পষ্ট। কাতারের মতো মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে হলেও দুই দেশ আপসে আসতে পারে – এটাই প্রমাণ হলো এ বিনিময়ে। তবে এখানে মূল ফোকাস দক্ষিণ কোরিয়ায় আটকে থাকা ইরানের ছয় বিলিয়ন ডলার। এ অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত দিলো, এটি পারমাণবিক প্রোগ্রাম ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনায় বসতে আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট বলে দিয়েছে, ইরান সরকার সরাসরি এ অর্থ পাচ্ছেনা। এ অর্থ কোরিয়ান ব্যাংক থেকে কাতারের মাধ্যমে ইউরোপের ব্যাংকে যাবে। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র-পরীক্ষিত তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ব্যয় হবে মানবিক খাতে। ইরানিদের জন্য ওষুধ, খাদ্য ইত্যাদি কেনার কাজেই এ অর্থ ব্যয় করা হবে, আর তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির মধ্যে।
হোয়াইট হাউসের কো-অর্ডিনেটর ফর স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস জন কার্বি বলেছেন, 'এটা কোনো মূল্য পরিশোধ বা মুক্তিপণ নয়। ইরানের ওপর থেকে কোনো স্যাংশনও ওঠানো হয়নি। ইরানি সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিদেশে তাদের স্থিতিশীলতা নষ্টের প্রক্রিয়া, সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমর্থন, উপসাগরে জাহাজের ওপর হামলা ও ইউক্রেনযুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি তাদের সমর্থন আমরা প্রতিহত করেই যাব।' মার্কিন সেক্রেটারি অভ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেনও বলেছেন, তারা আত্মবিশ্বাসী যে এ অর্থ মানবিক খাতেই ব্যয় হবে।
ওদিকে গত সপ্তাহে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ ছয় বিলিয়ন ডলার কীভাবে খরচ করা হবে, সেটা ইরান ঠিক করবে। জন কার্বি এর জবাবে বলেছেন, 'এটা একদম ভুল কথা।'
এ অর্থ ফেরত দেওয়াটা ভালোভাবে নেয়নি ইসরায়েল। এর আগে ১২ আগস্ট ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, 'ইরানের পারমাণবিক প্রোগ্রাম বন্ধ করবে না যে চুক্তি, সেটাতে অর্থ দেওয়ার অর্থ সন্ত্রাসবাদের জন্য অর্থ দেওয়া।'
স্বাভাবিকভাবেই জো বাইডেন রিপাবলিকানদের তোপের মুখে পড়েছেন এ অর্থ ফেরত দিয়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, 'বিশ্বাস করতে পারেন, এ জোচ্চোর জো বাইডেন ইরানের সন্ত্রাসী সরকারকে ছয় বিলিয়ন ডলার দিয়েছে? এ অকর্মণ্য বোকাটা আমেরিকাকে একদম ধ্বংস করে দিচ্ছে।'
আরেক রিপাবলিকান সিনেটর এ ঘটনার সংঙ্গে নাইন-ইলেভেনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এমনকি মধ্যপন্থী এক ডেমোক্রেট সিনেটরও বলছেন, এ অর্থ প্রদান আপাতদৃষ্টিতে 'বিরক্তিকর', কারণ ইরান প্রকাশ্য ও স্পষ্ট শত্রু। তবে ইরানি তেলবেচা অর্থ ইরানকে ফেরত দেওয়ার মধ্যে ঠিক কীভাবে 'জো বাইডেন অর্থ দিচ্ছে' বয়ান এলো তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এছাড়াও সব মার্কিন বন্দিকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়েও চাপে পড়েছে বাইডেন প্রশাসন।
এ চুক্তিতে লাভবান কেবল ইরান। কারণ ইরানের এ অর্থটা দরকার — জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ফসলহানি হচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা, মাশা আমিনির মৃত্যুর এক বছর পূর্তি হলো কদিন আগেই। গতবছর পাঁচশর বেশি বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে নির্মমভাবে আন্দোলন দমন করেছিল ইরানি সরকার।
বিক্ষোভের বর্ষপূর্তিতে খণ্ড খণ্ড আন্দোলন হয়েছে কিছুদিন আগেও। ইরানি সরকারের হাতে এত বড় অঙ্কের অর্থ আসায় এটি এখন কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। কারণ মানবিক খাতেও যদি ছয় বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী ইরান পায়, সেটাও ক্ষুব্ধ জনগণকে ঠান্ডা করতে ভালো কাজে আসবে। এ চুক্তিতে এখানে ইরানকে ছয় মার্কিন বন্দিকে ফেরত দেওয়া ছাড়া তেমন কিছুই দিতে হয়নি, উলটো চুক্তির অংশ হিসেবে নিজেদের ছয়জনকেও মার্কিন কারাগার থেকে ফিরিয়ে এনেছে দেশটি।
প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন অর্থ ফেরত দিলো? এখানে কয়েকটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, ডেমোক্রেট সরকার এ মুহূর্তে তুলনামূলকভাবে অজনপ্রিয়। বিদেশে তার সাফল্য দেখানোর চেষ্টা অনেকটাই ভেস্তে গেছে — রাশিয়া এখনো লড়ছে, চীন আগের চেয়ে বেশি আগ্রাসি, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। সৌদি-ইরান আঁতাঁতের খবর চাউর হয়ে যাবার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সৌদি আরব আর আগের মতো তার অনড় পিলার নয়। এ সময়টা ইরানের জন্য বেশ ভালো হতে পারে তার আগ্রাসি নীতি বাস্তবায়নের জন্য। কাজেই ইরানকে হাতে রাখা প্রয়োজন, অন্তত ইউক্রেনের সংঘাত শেষ হবার আগেই নতুন সংকট চায় না যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয়ত, পর্দার পেছনে ইরানি পারমাণবিক প্রোগ্রামকে অনেকটাই ধীর করতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৭ আগস্ট এ প্রোগ্রামের প্রধান মুহাম্মাদ ইসলামী জানান, ইরান তার ইউরেনিয়াম পরিশোধনের হার কমিয়ে আনতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংকট তুঙ্গে থাকার সময় ২০২১ সালে ইরান ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম পরিশোধন করছিল, যা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেশি উপযোগী। বলে রাখা ভালো, ইরানি পারমাণবিক চুক্তির আওতায় ইরান কেবল ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ইউরেনিয়াম পরিশোধন করতে পারত। কাজেই ইরানের ইউরেনিয়াম পরিশোধনের গতি শ্লথ হয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো লক্ষণ।
আর তৃতীয়ত, এ চুক্তি প্রমাণ করল, ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংলাপে বসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অভ অ্যাকশন তথা পারমাণবিক চুক্তির মতো ইউরোপীয় মধ্যস্থতাকারীদের প্রয়োজন নেই এখন।
তবে এ চুক্তি থেকে কোনো বৃহৎ পরিবর্তনের আশা নেই। সংলাপ তো দশক ধরেই চলছে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। রাজনীতিবিদেরা যতই হইচই করুক না কেন, দুটো দেশের কেউই একে অন্যের সঙ্গে নিকট ভবিষ্যতে সংঘাতে জড়াতে চায় না। ইরান তার হাত লেবানন থেকে চীন সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তার করেছে তার প্রক্সিদের মাধ্যমে। ইরানের কাছে পারমাণবিক প্রোগ্রাম এর অস্তিত্বের রক্ষাকবচ। যুক্তরাষ্ট্র এ মুহূর্তে ইরানকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ধরে রাখতে চাইছে, রিপাবলিকানরা যেটাকে বলছেন অ্যাপিজমেন্ট বা তুষ্টি। তবে ইরানকে বশে রাখার এ মার্কিন প্রক্রিয়া বৃহৎ পটভূমিতে ক্ষুদ্রই বলা চলে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।