নির্বাচন কমিশন গঠন: রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় অসঙ্গতি সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব
বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন মনোনীত হন, তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে নানান মতামত চলছিল। প্রথমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে তার সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য গণভবনে চায়ের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেই সময় এর আগে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি- দলটির সাধারণ সম্পাদক রাষ্ট্রপতিকে পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তারা এই আলোচনায় অংশ নেবেন না। এর পাশাপাশি তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের একটি আইনের কথা তারা বলে আসছিলেন।
বিভিন্ন আলোচনায় তারা বলছিলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য একটি আইন থাকা উচিত। কিন্তু, আইনের রূপকথা কি হবে- কোনোকিছুই তারা গণমাধ্যমের সামনে, কিংবা অন্য কোথাও তুলে ধরেননি। সরকারের পক্ষ থেকে যখন নতুন আইন প্রণয়ন করা হলো, সেই আইনকে তারা অবাঞ্ছিত আইন হিসেবে ঘোষণা করে জানিয়ে দিলেন, 'এই আইন আমরা মানি না'। কিন্তু, কাম্য আইনটি কী এবং কোন কোন ধারা যুক্ত হলে– একটি স্বাধীন, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে পারে, তার কোনো রূপরেখা আজপর্যন্ত দলটি জাতির সামনে হাজির করেনি।
আমরা ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখতে পাব, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম দেশ ভারত– বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ এবং একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার সময় থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠন ঘিরে নানা বিতর্ক চলেছিল। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের মতই নির্বাচন কমিশনে প্রাক্তন আমলাদের একটি প্রাধান্য ছিল। প্রথমদিকে ১৯৫২ সালে গঠিত নির্বাচন কমিশনে মাত্র একজন নির্বাচন কমিশনারের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হতো; পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা ৩- এ উন্নীত করা হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব– টি এন সেসন। দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেওয়া এই আমলা ভারতের ১৮তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে ১৯৮৯ সালে কর্মজীবন শেষ করেন। এরপর ভারতের দশম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ১৯৯০ থেকে '৯৬ সময়ে টি এন সেসন, ভারতের নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনীর ব্যবস্থায় নানাবিধ সংস্কার করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক সবসময় ছিল। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ বিষয়টির নিষ্পত্তি করে। গত বছরের নভেম্বরে একজন আমলা তার স্বপ্রণোদিত অব্যাহতি নেওয়ার একদিনের মাথায় তাকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এই মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনাটি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুপ্রিম কোর্ট এই মনোনয়নের নথিপত্র তলব করে। এরপর বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী সাংবিধানিক বেঞ্চে আলোচনা হয়।
সাংবিধানিক বেঞ্চের নির্দেশনায় বলা হয়, যতদিন পর্যন্ত সংসদ নতুন আইন প্রণয়ন না করবেন, ততদিন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের বিরোধী দলের নেতা (যদি সংসদে বিরোধী দলের নেতার পদে কেউ অধিষ্ঠিত না থাকেন, তাহলে সংসদে বড় বিরোধী দলের নেতা)- কে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করবেন এবং সেই কমিটি একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের নির্দেশনার সঙ্গে আমাদের দেশের আইনটির কোন মিল নেই।
আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত যে আইনটি পাস করা হয়েছে, তা মূলত একটি সার্চ কমিটি। নতুন আইনটি তৈরি হওয়ার আগে সরকার একটি সার্চ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে চেয়েছিল। তখন অনেকে দাবি তুলেছিল- সার্চ কমিটি নয়, একটি আইন থাকতে হবে। কিন্তু নতুন আইনটি তেমনই একটি সার্চ কমিটি ছাড়া আর কিছু নয়, যা সরকার আগেই গঠন করতে চেয়েছিল। এই আইনের মাধ্যমে যেখানে পদাধিকারবলে বেশকিছু সরকারের মনোনীত ব্যক্তিরাই থাকছেন।
দেশ বর্তমানে অনিশ্চিত রাজনীতির পথে হাঁটছে। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহু ক্ষেত্রেই সংস্কার প্রয়োজন। ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন বিচার বিভাগের। সুপ্রিম কোর্টের নিয়োগ পদ্ধতি থেকে শুরু করে– বিচারিক আদালতের পদায়ন ও কর্ম স্থান নির্ধারণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যা মূলত এখনো নির্বাহী বিভাগেরই অধীনে বলা যায়। এক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের নির্বাহী বিভাগের কোনো কর্তৃত্ব নেই। তেমনি অন্যান্য কমিশনের ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক সংস্কার সংবিধানের আওতায় করা দরকার, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। চূড়ান্ত অর্থে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলত সমাজে আয় বৈষম্য কমাবে এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যেই দেশ অগ্রসর হবে।
সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এসব বিষয়কে আলোচনার জন্য কখনো সামনে নিয়ে আসে না। রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমানের এই ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের কোন আগ্রহ নেই। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও সংস্কারের বিষয়টা সামনে আসলে– বিরোধীদলের আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ ও সমর্থনের জায়গা সৃষ্টি হবে। বর্তমানের রাজনৈতিক বিতর্কটা মূলত শহরের মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ক্ষমতার নানান প্রান্তরে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তদের মধ্যে এক সমঝোতার মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এই বলয় থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়