‘পাবলো পিকাসোর প্রদর্শনী’
সেদিন, ছুটির দিন সাতসকালে জানালার থার্মোমিটারে চোখ পড়তেই অবিশ্বাসে চোখ রগড়ে আবার ঠিকমতো পরীক্ষা করলাম, যা দেখেছি তা-ই! তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ২২ ডিগ্রি, ফারেনহাইট নয়, সেলসিয়াস! এ তো পুরোই জমাট বাঁধার জোগাড়! ঠান্ডার দেশ ফিনল্যান্ডেও এই সময় এতটা ঠান্ডা পড়ার কথা না। কিন্তু আগেই পরিকল্পনা করা আছে, আজ যাওয়া হবে হেলসিঙ্কি নাশন্যাল আর্ট গ্যালারি, আতেনিয়ামে, যেখানে গত দুই মাস ধরে চলছে পাবলো পিকাসোর বিশাল চিত্রকলা প্রদর্শনী, এটাই শেষ সপ্তাহ। কাজেই গরম কফির পরপরই কয়েক প্রস্থ ঠান্ডার কাপড় পরে, বরফ ঠেলে সকাল এগারোটায় যখন আতেনিয়ামে পৌঁছালাম, সামনে ইতিমধ্যেই কয়েশ শিল্পানুরাগীর লাইন জমে গেছে!
অপেক্ষার হিম প্রহর শেষে ভেতরে ঢোকা গেল অবশেষে। টিকিটের দাম বেশ চড়া, ষোলো ইউরো। বিশ্বের অন্যতম সেরা পিকাসো জাদুঘর প্যারিসের মুজে পিকাসো ন্যাশনাল থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছে অমূল্য অমর সব চিত্রকলা। প্রথমেই পিকাসোর সংক্ষিপ্ত জীবনী আর পুরো নাম দেয়ালজুড়ে লেখা:
Pablo Diego José Fransisco de Paula Juan Nepomuceno María de los Remedios Cipriano de la Santísima Trinidad Martyr Patricio Clito Ruiz y Picasso.!!!!
সেইসাথে দেয়ালে দেয়ালে পিকাসোর অমর বাণী লেখা: 'আমাকে একটি জাদুঘর দিয়েই দেখ, একে পূর্ণ করার দায়িত্ব আমার।'
প্রদর্শনীর প্রথমেই তার ব্লু পিরিয়ডে আঁকা কিছু পোর্ট্রেট, বিশেষ করে বার্সেলোনায় অবস্থানরত সময়ে আঁকা একমুখ দাড়িওয়ালা এক তরুণের প্রতিকৃতি আর একচোখের অধিকারী মহিলার দুর্দান্ত পোর্টেট মনের পর্দায় ভেসে থাকল অনেকক্ষণ, আর কী সে নীল! হালকা, গাঢ়, ফিকে, জমাট, উজ্জ্বল,ফ্যাকাশে...সব ধরনের নীলের সন্নিবেশন পিকাসোর ক্যানভাসে।
এরপরেই ১৯০৬ সালে আঁকা তার আত্মচিত্র। মোলায়েম গোলাপি রঙে রাঙানো এই আত্মচিত্রটিই এই প্রদর্শনীর বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশালাকার পোস্টার ঝুলছে তার অ্যাতেনিয়ামের দেয়ালে।
এরপরে পিকাসোর বিশ্বকাঁপানো নতুন ধারার পেইন্টিং: রাস্তার তরুণীদের কিছু খসড়া কাজ। তার পরের গ্যালারিতে ধাতব ভাস্কর্যের আর কাঠের কাজের সম্ভার। উল্লেখ্য, পিকাসো জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন ধরনের শিল্প মাধ্যমে মেতেছিলেন: রং-তুলি থেকে কাঠ, পাথর, ধাতু, কাচ, পুরনো গাড়ির ভাঙা অংশ পর্যন্ত! সেই প্রথম ভাস্কর্যের মাঝেও লক্ষ করা গেল পিকাসো প্রবর্তিত কিউবিজম।
এরপরের প্রদর্শনী কক্ষে ১৯২৪ থেকে ১৯৩৪, এই এক দশকে আঁকা সুররিয়ালিজমের চিত্রমালা। গিটার, বেহালা নানা বাদ্যযন্ত্রের প্রতি দারুণ আকর্ষণ ছিল এই বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর, নানা রেখায়, নানা আঙ্গিকে, নানা ভঙ্গিমায়, কখনো সরল, কখনো বিমূর্ত, কখনো কিউবিজমের নতুন ধারায়। নানা আকারের ফ্রেমে ঝুলছে তার গিটার নিয়ে করা কাজ।
সবুজ শার্ট গায়ে দড়াবাজিকরের বিখ্যাত পেইন্টিংটির পাশে বিশাল ভিড়, এরপরেই ১৯২৫ সালের গ্রীষ্মের আঁকা চুম্বন, সব ধরনের রঙে রাঙানো ক্যানভাসে নানা ধরনের টানে ফুটিয়ে তোলা যুগল। জানা যায়, কিউবিজমের উদ্ভবের পিছনে আফ্রিকার কিছু হাতে বানানো মুখোশ সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল পিকাসোকে। এই চিত্রকর্মে তার প্রমাণ দেখা গেল।
এরপরে শিল্পীজীবনের নানা দুলর্ভ মুহূর্তের আলোকচিত্র। এর গুটিকেয়েক পিকাসোর নিজের তোলা। স্টুডিওতে পিকাসো, মডেলের সাথে, ষাঁড়ের লড়াই উপভোগরত, সমুদ্র সৈকতে, সন্তানদের সাথে—এমনভাবে সাদাকালো প্রিন্টগুলো তার জীবনের নানা টুকরো টুকরো ঘটনা আমাদের সামনে রঙিন কথামালার মতো ফুটিয়ে তোলে। আর আছে তার করা বিভিন্ন বইয়ের ইলাস্ট্রেশন।
আবার পেইন্টিংয়ের জগৎ, ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত। একটাতে দেখা যাচ্ছে বুলফাইটের অ্যারেনায় ক্রোধোমত্ত ষাঁড়, ভূলুণ্ঠিত ম্যাটাডোর, আতঙ্কিত সাদা ঘোড়া। ষাঁড়ের লড়াই বড় প্রিয় ছিল পিকাসোর, হয়তো এই রক্তঝরানো নিষ্ঠুরতা থেকেই পেতেন নতুন শিল্পকলা সৃষ্টির উপাদান।
পিকাসোর একসময়ের প্রেমিকা ডোরা মার-এর ভুবনবিদিত পোর্ট্রেট আসে আমাদের সামনে। চেয়ারে বসে আছেন ডোরা, রঙধনুর সাতরঙে রাঙানো তার পরিধেয় বস্ত্র, দুই চোখ পিকাসোর তুলির অনন্য কারুকার্যে মনে হয় দুই ভিন্ন দিকে তাকিয়ে আছে।
পাবলো পিকাসো তার দীর্ঘ জীবনের নানা পর্যায়ের অসংখ্য প্রেমিকাকে নিজের ক্যানভাসে ঠাঁই দিয়েছেন, শিল্পকলার জগতে অমর করে রেখেছেন ব্যক্তিজীবনের প্রেমকে, তার অনন্য উদাহরণ ডোরা মারের এই প্রোর্টেট।
এরপরের কক্ষে অন্য পিকাসো, অন্য সৃষ্টি। যুদ্ধের বছর শিরোনামে প্রদর্শনী কক্ষটিতে ১৯৪১ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আঁকা নানা যুদ্ধবিরোধী শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে, যার মধ্যমণি ১৯৫১ সালে আঁকা ম্যাসাকার ইন কোরিয়া বা কোরিয়ার গণহত্যা, কোরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর অনুপ্রবেশ আর অবাধ হত্যার প্রতিবাদে সাহসী তুলি দিয়ে বিশাল ক্যানভাসের এই ছবিটি আঁকেন তিনি, তাতে ফুটে ওঠে যুদ্ধ নামের কলঙ্কের এক নিষ্ঠুর নগ্ন করাল চিত্র, একদল নগ্ন, রুগ্ন, পীড়িত নারী ও শিশুর উপর আক্রমণে উদ্যত ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একদল যান্ত্রিক সেনা। দূরে দেখা যায় যুদ্ধবিধস্ত এলাকা।
বিশ্বের নানা প্রান্তের পুরাণকাহিণী নিয়ে অপরিসীম উৎসাহ ছিল পিকাসোর, কাজ করেছেন নানা চরিত্র নিয়ে, এখানে স্থান পেয়েছে তার পেন্সিলের সৃষ্টি গ্রিক পুরাণের ষাঁড়মাথা দানব মিনোটরের স্কেচ, আছে তার আঁকা ধবধবে সাদা পায়রা। উল্লেখ্যম, পিকাসোর পায়রার ছবিই বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসে শান্তির প্রতীক হিসেবে মনোনীত হয়।
পরের কক্ষে দীর্ঘ সময়ের প্রেমিকা ফ্রাসোয়া জিলোট আর তার সন্তান পালোমা পিকাসোর যুগল চিত্র। এরপরেরটা নীল, লাল, কালো, হলুদের সমন্বয়ে আঁকা হাত মুড়িয়ে বসে থাকা জ্যাকুলিনের পোর্টেট, লম্বা গলায় আর চোখের বিষণ্ন দৃষ্টিতে জ্যাকুলিনকে মিশরের স্ফিংসের মতো মনে হয়। পিকাসোর তৈরি ধাতব ভাস্কর্যগুলোর অন্যতম প্রমাণ আকারের ছাগীর ভাস্কর্যে চোখ বোলানোর সুযোগ হয় আমাদের।
পরবর্তীতে সামনে আসে এদুয়ার মানের বিশ্বে ঝড় তোলা শিল্পকর্ম ঘাসের উপরে মধ্যাহ্ন ভোজ-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পিকাসো আঁকা কিউবিজমের মিশেল দিয়ে একই ধরনের চিত্রকর্ম। ১৯০৯ সালে আঁকা আরেকটি ভিন্ন রঙের, ভিন্ন আঙ্গিকে চুম্বন, আগেরটির চেয়ে এটি অনেক বেশি মনে দাগ কেটে গেল শুধু সাদা, নীল আর নানা ধরনের কালোতে আকা এই যুগলচিত্রটি।
শিল্পীজীবনের শেষ ভাগের ( ১৯৭০-১৯৭৩) কিছু সৃষ্টি স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীর শেষ কক্ষে, যার অন্যতম সমব্রেরো হ্যাট পরা তুলি হাতে এক নবীন শিল্পীর পেইন্টিংটি মনে প্রশ্নের ঝড় তোলে, পিকাসো কি নিজেকেই কল্পনা করে এঁকেছেন, বারবার, চিরনবীন রূপে?
এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া সমস্ত কাজই এসেছে হোটেল স্যালে-খ্যাত প্যারিসের পিকাসো মিউজিয়াম থেকে, যার প্রায় সবগুলোই পিকাসোর সাথে ছিল আমৃত্যু, এবং পরবর্তীতে ফরাসি দেশের সরকার এইসব অমূল্য সংগ্রহ নিয়ে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করে (উল্লেখ্য, স্পেনে চলমান স্বৈরশাসন ও তার হোতা জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে পিকাসো জন্মভূমি ত্যাগ করে ফ্রান্সে চলে আসেন, এখানেই শিল্পচর্চায় নিমগ্ন থাকেন আজীবন)।
পাবলো পিকাসো, তার মতো এত ভিন্ন মাধ্যমে এত বেশি শিল্পকর্ম আর কেউই মুগ্ধ পৃথিবীকে দিতে সক্ষম হননি। এই মহান, অমর শিল্পীর সৃষ্টির প্রতি অপরিসীম বিস্ময়বোধ নিয়ে বের হয়ে এলাম হেলসিঙ্কির আতেনিয়াম জাদুঘর থেকে।