রবীন্দ্রনাথও বড় হয়েছেন চিকন প্রহারে
রবীন্দ্রনাথও বড় হয়েছেন চিকন প্রহারে।
তাহলে বলা যায়, আমাদের শিশুরাও বড় হয়ে একেকজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হবেন। স্বয়ং ঠাকুর না হলেও অন্তত তার ভাই বা ভাইপো তো অবশ্যই। রবি বড় হয়েছেন চিকন প্রহারে, আমাদের শিশুরা তার চেয়েও বড় কিছুতে; পিতা-মাতার প্রহার-শাসনে, পারিবারিক সহিংসতায়।
আমাদের বর্তমান নিয়ে কথা বলার আগে ফ্ল্যাশব্যাকে দেড়শ বছরের বেশি সময় আগে ঘুরে আসা যায়। রবি তখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে বড় হচ্ছেন। তার বড় হওয়াটা আর দশটা বাঙালি ছেলের মতো না, হওয়ার কথাও না।
রবীন্দ্রনাথের পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর পিতামহ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। সেখানকার পরিবেশ ছিল ভিন্নরকম।
রবীন্দ্রনাথের ভৃত্যকুল নিবন্ধে পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার লিখেছেন: 'জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিশাল পরিবারের ছোটো ছেলেমেয়েদের প্রতি আলাদাভাবে নজর রাখা বা স্নেহযত্ন প্রকাশ করবার রীতি ছিল না, বোধহয় সম্ভবও ছিল না। উপরন্তু সেকালে অভিজাত গৃহে জন্মের পরে শিশুদের মায়ের কাছে রাখবার রীতিও ছিল না।'
সে কারণে অতি শৈশবেই রবি 'ভৃত্যহস্তে সমর্পিত'। ভৃত্যদের অধীন হয়েই তার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছিল। সেটা যে খুব সুখকর ছিল, সেটা বলা যাবে না।
বনেদি বাড়ির বড় বড় অভিভাবকেরা 'এলিট' চিন্তা থেকেই হোক কিংবা অন্য যে কারণেই হোক, ভৃত্যদের কাছে সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব দেওয়ায় ভৃত্যদেরও ছিল মনিবী মনোভাব। দুয়েকজন ভৃত্য সন্তানবাৎসল্যে বাচ্চাদের আদর-যত্ন করলেও অনেকেরই দয়ামায়া কম ছিল, কিছু ক্ষেত্রে তা ছিল অতিশয় নির্মম। শিশুদের ভয় দেখানো ছিল নিত্য কর্মের অংশ, গায়ে হাত তোলাও ছিল নিয়মিত ঘটনা।
রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন:
'মার খাইয়া আমরা কাঁদিতাম, প্রহারকর্তা সেটাকে শিষ্টোচিত বলিয়া গণ্য করিত না। বস্তুত সেটা ভৃত্যরাজদের বিরুদ্ধে সিডিশন [রাজদ্রোহ]। আমার বেশ মনে আছে, সেই সিডিশন সম্পূর্ণ দমন করিবার জন্য জল রাখিবার বড় বড় জালার মধ্যে আমাদের রোদনকে বিলুপ্ত করিয়া দেবার চেষ্টা হইত।'
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কেন আমাদের সন্তানদের শৈশবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শৈশবের তুলনা করেছিলাম। তবে, 'রঙ্গভরা বঙ্গদেশে'র মতো এটা কোনো রং-তামাশার বিষয় না।
বিশ্বে প্রথমবারের মতো পালিত আন্তর্জাতিক খেলাধুলা দিবস (১১ জুন) উপলক্ষে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে শিশুদের সহিংসতার শিকার হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাসা-বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাদের উদ্দীপনা দেওয়াসহ সার্বিক সেবাযত্নে ঘাটতির চিত্র ফুটে উঠেছে।
১০ শিশুর নয়জনই সহিংস পরিস্থিতির শিকার
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে নয়জন মাসে একবার হলেও সহিংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। এতে সাড়ে চারকোটি শিশুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিশু সুরক্ষায় অগ্রগতি সত্ত্বেও সহিংসতা, নিপীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ-লাখ শিশু।
ইউনিসেফের নতুন তথ্যে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সি ৪০ কোটি শিশু বা এ বয়সিদের মধ্যে প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে ৬টি শিশু নিয়মিত বাসায় শারীরিক আঘাত বা শারীরিক শাস্তি সহ্য করে। তাদের মধ্যে ৩৩ কোটির মতো শিশুকে শারীরিকভাবে শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে।
এরকম শাস্তির ঘটনা শিশুদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গবেষণা বলছে, শিশুকে শাস্তি দেওয়া হলে বা রাগ দেখানোর কারণে শিশু ভয় পেলে শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা সাময়িক সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত করে। নিয়মিত এরকম ঘটনা ঘটতে থাকলে শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও আকৃতিতে স্থায়ী পরিবর্তন বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। আনন্দহীন পরিবেশে শিশু শেখে অনেক কম। সেটা হোক পরিবারে, কিংবা বিদ্যালয়ে।
অনেক সময় শেখানোর তাগিদ থেকেই আমরা শিশুদের শাস্তি দিয়ে থাকি। হোক সেটা শারীরিক বা মানসিক — এ শাস্তি তার যে কতটা ক্ষতি করে আমরা সেটা বুঝতে পারি না। অথচ পিতামাতার চেয়ে সন্তানকে বেশি আর কে ভালোবাসে!
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।