প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই
বৃষ্টি হলে ব্যাঙদের যেমন আনন্দ হয়, আমারও তেমনি। বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়লেই মনের মধ্যে তিড়িংবিড়িং শুরু। ছোটবেলায় বৈশাখ মাসের শেষের দিকে যখন বৃষ্টি শুরু হতো, আমি আর মা বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়োতাম। আমার বন্ধুদের বাপ-মা দেখতাম ওদেরকে ভিজতে দিত না। কিন্তু আমার মায়ের এসব ব্যাপারে বিধিনিষেধ ছিল না। আশ্চর্যজনকভাবে বৃষ্টিতে অনেক ভেজবার পরে জ্বরটরও বাঁধত না আমাদের। বড় হওয়ার পর সেভাবে একসঙ্গে ভেজা হয় না আমাদের। সময়, পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেল। মায়ের সেই আমুদে ভাবটা উড়ে গেল।
তবু বৃষ্টি এলে আমার মনের মধ্যে আলাদা একটা ব্যাপার কাজ করে। এককালে মায়ের কাছ থেকে খুব সহজ তরিকায় কাগজের নৌকো বানানো শিখেছিলাম। ছোট্ট অথচ কী সুন্দর! একেবারে সত্যিকারের নৌকো যেন। কাগজের নৌকো বানানোর জন্যে পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বাদাম খাওয়ার ঠোঙা অব্দি কাজে লাগত। কাগজ পেলেই জমিয়ে রাখতাম নৌকো বানানোর জন্যে। বানানোর পর সে-সব নৌকো ভাসিয়ে দিতাম বৃষ্টির জলে। জলের তোড়ে নৌকোগুলো হোঁচট খেলে দৌড়ে গিয়ে ওগুলোকে তুলে দিতাম সযত্নে। সে এক মজার খেলা।
যাইহোক, গতবছর বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গাপুজোর আগে আমার সে কী জ্বর! বিছানায় পড়ে থাকলাম কিছুদিন। ছোটবেলায় কোথাও আছাড় খেয়ে কান্নাকাটি করলে বাবা বলত, আছাড় না খেলে বড় হওয়া যায় না। আমার কাছে তেমনি মনে হয়, বৃষ্টিতে না ভিজলে বড় হওয়া যায় না। জ্বরটরও তো আসবার দরকার আছে। তা যতই ভোগান্তি হোক, আমি প্রতিবছর ভিজবই। রুটিনমাফিক জ্বর এসছে এবারও। দুপুরবেলা জ্বর গায়ে প্রেম ডটকম শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম আচমকা। মিরের সেই জাদুর কণ্ঠস্বর আর নাইন্টিজের জম্পেশ প্রেমের গল্প। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ।
এ বছর বর্ষা শুরু হওয়ার পর আমি আর মা ভিজলাম সেই ছোট্টবেলার মতেন। টিনের চাল ধুয়ে যে বৃষ্টির জলটা পড়ে, ওটা অন্যরকম ঠান্ডা। অথচ আমি অ্যাদ্দিন এটা জানতামই না। জানলাম মায়ের থেকে। গত পরশু বাজার করে ফিরছি মা আর আমি, আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। বাজারের থলে হাতে দুজন ভিজতে ভিজতে বাড়ি এলাম। আমাদের সঙ্গে ভিজল সদ্য কেনা ট্যাংরা মাছ আর শাকের ডাটা। মায়ের ব্যাগে থাকা ব্যাংকের চেকটাও ভিজে জবজবে। সেদিকে খেয়াল নেই মার। মাও যেন ফ্রক পরা খুকি হয়ে গেল আমার হাত ধরে ভিজতে ভিজতে। আমাদের বাড়িতে কচিকাঁচার অভাব নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়েই আমাদের ভেজবার দৃশ্য দেখে ওদেরকে মনের সাধ মেটাতে হলো, কারণ বেচারাদেরও বৃষ্টিতে ভেজার ব্যাপারে সেই চিরাচরিত কড়া নিষেধ আছে।
এ তো দ্বিতীয় দিন ভেজবার বৃত্তান্ত। এবার আষাঢ় মাস পড়তেই প্রথম যেদিন বৃষ্টি এল, সেদিনও মা আর আমি ভিজতে নামলাম। বৃষ্টি আসামাত্র আমি দৌড়ে ছাদে গিয়ে রেখে এলাম বিশাল একটা হাঁড়ি। উদ্দেশ্য বৃষ্টির জলের চা পান। আমি মনে মনে ভেবেই মরি, অত বড়ো হাঁড়ি পুরোটা জলে ভরে গেলে নামাব কী করে? কাঁখে করে নামাতে পারব কি? ঘণ্টা দুই পরে বৃষ্টি থামার পর ছাদে গিয়ে দেখি একটুখানি জল জমেছে হাঁড়িতে। বড়জোর এক কাপ চা হবে এতে। আমার বেজায় মন খারাপ হয়ে গেল। তবে তো দুজনের চা হবে না। স্যাক্রিফাইসটা শেষ অব্দি মা-ই করল। বলে কি-না, তোর ওসব পাগলামো রাখ। আমি বৃষ্টির জলের চা খাব না। বুঝলাম আমার মন খারাপ এড়াতে এই ব্যবস্থা। বৃষ্টির জলের চা স্বাদে এত দুর্দান্ত না খেলে বিশ্বাস করতাম না কখনই। অতুলনীয় স্বাদ, আর চায়ের রংটাও খানিকটা অন্যরকম। মনে মনে রোকেয়া হলের রুমমেটের প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল। ওর কাছেই বৃষ্টির জলের চায়ের গল্প শুনেছি বেশ কয়েকবার।
ল্যাভেন্ডার রঙের ছাতা আর লালরঙা রেইনকোট মোড়ানো বর্ষাকালের থেকে কাকভেজা বর্ষাকাল আমার কাছে বেশি উপভোগ্য। চন্দ্রবিন্দুর 'তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই' শুনতে শুনতে কবে কেমন করে বৃষ্টিকে কাছের করে ফেললাম বড্ড। তবু টিনের চালের ঘরে বসবাসের সুবাদে ভেতরকার বিড়ম্বনাও যে টুকটাক জানি না, এমন নয়। ছাদ থেকে বৃষ্টির জল পড়ে ঘরের মেঝে একাকার। আমার মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার কিছুদিন আগে ঝমঝম করে বৃষ্টি এসেছিল। টিনের চালের ছিদ্ররা বাদ সাধল সেবার। পড়ার টেবিলে রাখা ভূগোল আর অঙ্ক বইয়ে বৃষ্টির জল পড়ে সে কী যাচ্ছেতাই অবস্থা! তখনও পরীক্ষার আগে বই ভিজে যাওয়ার মর্ম বোঝবার মতন বড় হইনি। বরঞ্চ কয়েকটা দিন বই শুকোতে সময় লাগবে ভেবে আনন্দ হয়েছিল খুব।
এ বছর সাপ বেরোচ্ছে বড্ড। বাড়িতে পদ্মগোখরা থেকে শুরু করে টুকটাক সাপ দেখা যায় প্রায়ই। বাড়িতে গাছের অভাব নেই। বরং একটা জংলা ভাব এসছে সে-সব গাছের ভিড়ে। পুরোনো অশ্বত্থ থেকে শুরু করে বিশাল বাঁশঝাড়, যেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের পটভূমি। আশ্চর্যের ব্যাপারটি হচ্ছে, আমাদের কলতলায় একটা বাচ্চা বেড়াল রোজ রোজ একটা সাপের সঙ্গে খেলা করে। অথচ সাপটা ওর কোনো ক্ষতি করে না। ও-ও কিন্তু সাপটার ক্ষতির কারণ হয় না। সুনীলের কবিতায় পড়েছিলাম তিন প্রহরের বিলে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে। আমার তখন বেশ তাজ্জব লেগেছিল। অথচ সাপে বেড়ালে বন্ধুত্বও আজকাল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিনগুলোতে সাপ আর কুকুরের ভয়ে বারান্দা থেকে আমি নামি না হু হু। কিন্তু বৃষ্টি এলেই ভয়ডর উধাও!
কাল সারাদিনও বৃষ্টি হয়েছে ঢের। বিকেলবেলা এক ফাঁকে ছাদে উঠে বকুল ফুল কুড়োচ্ছিলাম। হ্যাঁ, আমাদের একটা বকুলগাছ এমনভাবে লাগানো যেটার শেকড় নিচতলাতে অথচ ফুলগুলো পড়ে ছাদের পরে। বকুলফুল দেখলে বাবার জন্যে মন কেমন করে। সেই বকুলফুল ঘরে আনলে মনে হয় চারপাশ জুড়ে বাবা-বাবা গন্ধ। বকুলফুল কুড়িয়ে একটু এগোতেই চোখ পড়লো টবে লাগানো গোলাপি আর সাদা নয়নতারা গাছগুলোর ওপর। বৃষ্টির ফোঁটা পরে কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে ফুলগুলো। খুব আফসোস হলো, কেন যে নয়নতারা হয়ে জন্মালাম না! পরের জন্মে নয়নতারা হবো ঠিক...