মানবতার দীক্ষাগুরু ডা. কে জামান
যুগে যুগে দেশে দেশে কীর্তিমান, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। এই কীর্তিমান ব্যক্তিত্বরা নিজেদের শিক্ষা, মেধা, কর্ম দ্বারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যান এবং মানবতার সেবক হিসেবে পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তেমনই একজন কীর্তিমান, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব প্রয়াত ডা. কে জামান।
ডা. কে জামান পাবনা শহরে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। ডা. কে জামানের জন্মের ২৬ দিন পর মা হামিদা বানু পরলোকগমন করেন। এরপর থেকেই খালা প্রখ্যাত লেখিকা প্রয়াত সেলিনা বানু স্বস্নেহে ডা. কে জামানকে লালন-পালন করেন।
ডা. কে জামানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় পাবনা শহরে। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করেন তৎকালীন লিটন মেডিকেল স্কুল থেকে। এই লিটন মেডিkeল স্কুল পরবর্তীকালে ময়মনসিংহ মেডিকল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। পরে তিনি ভিয়েনা থেকে চক্ষু বিষয়ক ডি,ও,এম,এস ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ডা. কে জামান। সত্তর দশক থেকে তিনি ময়মনসিংহ শহরে চক্ষু চিকিৎসক হিসেবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। একইসঙ্গে সমাজ সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। সত্তরের দশকেই তিনি প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহাম্মদের অনুপ্রেরণায় সমাজ থেকে অন্ধত্ব নিবারণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং আশির দশকে ময়মনসিংহ শহরে বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। সত্তরের দশকে সমাজের বঞ্চিত এতিম মেয়েদের জন্য ডা. কে জামান 'মোমেনশাহী এতিমখানা ও শিশুসদন' প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৫ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ডা. কে জামান ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিএনএসবি পরিচালিত চক্ষু শিবির কার্যক্রমের প্রধান সংগঠক ছিলেন। চক্ষু চিকিৎসা, চক্ষু অপারেশন, অন্ধত্ব নিবারণ ও অন্ধ পুনর্বাসন কাজ নিরলসভাবে করে যান।
ডা. কে জামান ১৯৮০ সালে ময়মনসিংহ বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই চক্ষু হাসপাতাল ময়মনসিংহ শহরের সেহড়া ধোপাখলায় অবস্থিত। ডা. কে জামানের মৃত্যুর পর এই হাসপাতালের নামকরণ হয় 'ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল'। যদিও শুরু থেকেই ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ এই চক্ষু হাসপাতাল কে 'ডা. কে জামানের হাসপাতাল' বলতো।
ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে বর্তমানে ডাক্তার, প্যারামেডিক্যাল, কর্মকর্তা, কর্মচারী মিলিয়ে সর্বমোট ১৮০ জন কর্মরত আছেন। এই চক্ষু হাসপাতাল ময়মনসিংহ অঞ্চলে পরিচালনা করছে আরও ১০টি প্রাথমিক চক্ষু পরিচর্যা কেন্দ্র ও ভিশন সেন্টার। এই ভিশন সেন্টারগুলোতে বহু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন সেবা পাচ্ছে ৪০০ থেকে ৬০০ চক্ষু রোগী। প্রতিবছর ৬০০০ থেকে ৭০০০ চক্ষু রোগীর অপারেশন করা হয়। চক্ষু শিবিরের মাধ্যমে ময়মনসিংহ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ চক্ষু রোগের চিকিৎসা ও ছানি অপারেশন করার সুযোগ পাচ্ছে।
ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল পরিচালিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সমূহ হচ্ছে—
১। নেত্রকোনা বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল
২। প্রাথমিক চক্ষু চিকিৎসা ও পরিচর্যা কেন্দ্র, মোহনগঞ্জ
৩। প্রাথমিক চক্ষু চিকিৎসা ও পরিচর্যা কেন্দ্র, নকলা
৪। প্রাথমিক চক্ষু চিকিৎসা ও পরিচর্যা কেন্দ্র, শ্রীবর্দী
৫। ভিশন সেন্টার, দুর্গাপুর
৬। ভিশন সেন্টার, ফুলবাড়িয়া
৭। ভিশন সেন্টার, ঘাটাইল
৮। ভিশন সেন্টার, গফরগাঁও
৯। ভিশন সেন্টার, শেরপুর
১০। ভিশন সেন্টার, তাড়াইল
১১। ভিশন সেন্টার, কেন্দুয়া
১২। ভিশন সেন্টার, ভালুক
ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে বর্তমানে এমবিআইসিও অর্থাৎ ময়মনসিংহ বিএনএসবি ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিটি অপথালমোলজি এর অধীনে যে সমস্ত প্রশিক্ষণ কোর্স চালু আছে তা হচ্ছে—
১। অপথালমিক অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্স (Ophthalmic Assistant Course– MLOP)
২। রিফ্র্যাকশন কোর্স (Refraction Course)
৩। অর্থোপটিস্ট কোর্স (Orthoptist Course)
৪। কাউন্সিলর কোর্স (Counselor Course)
৫। ওটি ম্যানেজমেন্ট কোর্স (OT Management Course)
৬। ওটি অ্যাসিন্ট্যান্ট কোর্স (OT Assistant Course)
৭। ভিশন টেকনিশিয়ান কোর্স (Vision Technicians Course)
৮। ফান্ডাস ফ্লুরেসসিন অ্যাঞ্জিওগ্রাফি অ্যান্ড আল্ট্রাসনোগ্রাফি (Fundus Fluorescein Angiography and Ultrasonography)
৯। ওপিডি ম্যানেজমেন্ট কোর্স (OPD Management Course)
১০। অকিউলার মাইক্রোবায়োলজি কোর্স (Ocular Microbiology Course)
১১। অপথালমিক ইকুইপমেন্ট মেইন্টেনেন্স কোর্স (Ophthalmic Equipment Maintenance Course)
১২। কমিউনিটি আউটরিচ কোর্স (Community Outreach Course)
১৩। অপটিক্যাল ডিসপেন্সিং কোর্স (Optical Dispensing Course)
১৪। ইন্টিগ্রেটেড হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যার (Integrated Hospital Management System–IHMS Software)
ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের এমএলওপি কোর্সে প্রতিবছর ২০ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছেন। এই কোর্স সম্পন্ন করে তরুণ–তরুণীরা দেশের বিভিন্ন চক্ষু সেবা কেন্দ্র ও চক্ষু হাসপাতালে চাকরি করছেন।
ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে চশমা তৈরির টেকনিশিয়ান তৈরির জন্য 'আইমিত্র ট্রেনিং সেন্টার' আছে। এখানে টেকনিশিয়ান তৈরির জন্য দুই মাস মেয়াদের কোর্স চালু আছে। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক তরুণ–তরণীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।
ডা. কে জামান ১৯৮০ সালে অন্ধত্ব নিবারণ ও পুনর্বাসন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এ,বি,সি আর্মিটেইজ এওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চক্ষু শিবির সংগঠক ও সমাজ সেবায় সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে এমরান স্বর্ণ পদক লাভ করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে হংকং ও এশিয়া প্যাসিফিক একাডেমি অফ অফথালমোলজি (আপাও) কর্তৃক প্রদত্ত ডিসটিংগুইসড সার্ভিস এওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে সমাজ সেবায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত জাতীয় সমাজ সেবা পদক লাভ করেন। ২০০৪ সালে চক্ষু চিকিৎসা ও পরিচর্যা কার্যক্রমে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অফথামোলজিক্যাল সোসাইটি অফ বাংলাদেশ (ওএসবি) কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত হন। ২০০৪ সালে চক্ষু চিকিৎসা ও সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য অ্যাপেক্স ক্লাব অফ ময়মনসিংহ কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
ডা. কে জামান ২০০৮ সালে ইউনিলিভার কর্তৃক 'সাদা মনের মানুষ' নির্বাচিত হয়ে পুরস্কৃত হন এবং একই সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগের স্বামী স্বরূপানন্দ ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত হন। ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাউথ ইস্ট এশিয়া অঞ্চলে অন্ধত্ব নিবারণে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখায় 'সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিওনাল অ্যাওয়ার্ড' প্রাপ্ত হন।
ডা. কে জামান ২০১৩ সালের ২৯ জুন নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। ডা. কে জামানের এক কন্যা হামিদা হানম দীপা, দুই পুত্র শরীফুজ্জামান পরাগ ও শাহীদুজ্জামান তারিক। সহধর্মিণী সেরিনা বানু পরলোকগমন করেছেন।
ডা. কে জামান মানুষের সেবায় 'ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল' প্রতিষ্ঠা করে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের চক্ষু চিকিৎসা ও পরিচর্যা কার্যক্রমে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেন গেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতাল থেকে চক্ষু বিষয়ক বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করে শত শত তরুণ–তরুণী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, আর্তমানবতার
সেবা করছে।
ডা. কে জামান নিজে সারাজীবন মানুষের সেবা করে গেছেন, আর মানুষের সেবার জন্য এক ঝাঁক ডাক্তার,প্যারামেডিকেল,কর্মকর্তা,কর্মচারী রেখে গেছেন। এই এক ঝাঁক মানবতার কর্মীই 'ডাঃ কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল' এবং এর অধীনে পরিচালিত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।
প্রয়াত ডা. কে জামান কখনো ব্যক্তিগত ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্যের দিকে তাকাননি। তিনি নিজে ছিলেন মানবতার একনিষ্ঠ সেবক, আর অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছেন মানবতার। তার জীবন পর্যালোচনা করে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ডা. কে জামান ছিলেন মানবতার দীক্ষাগুরু।