সাপের গুজব অথবা গুজবের সাপগুলো...
[আজ ১৬ জুলাই বিশ্ব সাপ দিবস। প্রকৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সরীসৃপ অনেকক্ষেত্রেই মানুষের অহেতুক ভীতি ও কুসংস্কারের কারণে মারা পড়ে। অথচ প্রকৃতিত অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে সাপেরও।
এ কথা সত্য যে, সাপ অন্যান্য সরীসৃপের থেকে অনেক বেশি সহনশীল, তাই অনেক ভিন্নমুখী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তবে বর্তমানে নগর উন্নয়ন, গাছ-বন উজার ও যান্ত্রিক সভ্যতার বহুমুখী আগ্রাসনে অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মতো সাপও ঝুঁকির মুখে।
সাপ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে কাজ করেছেন সীমান্ত সরকার। জড়িত ছিলেন সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী উদ্ধারে। পেয়েছেন একাধিক সফলতা। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি বলেছেন দেশের কিছু সাপভিত্তিক প্রচলিত মিথ বা গুজবের বিষয়ে।
এ লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলো তুলেছেন প্রাণিবিশেষজ্ঞ ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রিশিল্পী আদনান আজাদ।]
অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে
অজগর; পৃথিবীর বৃহত্তম সাপের পরিবার 'পাইথনেডি'র অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের দুই প্রজাতির অজগর পাওয়া যায়। এর একটি হলো বিশ্বের বৃহত্তম সাপ গোলবাহার অজগর (Reticulated Python), যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। অন্যটি ময়াল অজগর (Burmese Python); সুন্দরবন, ভাওয়াল, সিলেটের বনাঞ্চলসহ দেশের অধিকাংশ গভীর বনে যার দেখা মেলে।
ছোটবেলায় ধারাপাতের বইতে আমাদের পাঠ শুরু হয় এই একটি বাক্য দিয়ে; 'অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে।' বড় হয়ে যখন পড়াশোনা করলাম, তখন জানলাম অজগর সাপ তেড়ে আসে না। এরা মূলত একজায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে ওত পেতে, কাছাকাছি কোনো প্রাণি আসামাত্র দানবীয় শরীর দিয়ে জড়িয়ে ধরে, পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে শিকারের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়। অজগরের শরীররে রং তাকে ঘাস ও গাছের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে সহায়তা করে বলে গভীর বনে সহজে একে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। গায়ের জোর, দৈর্ঘ্য আর ওত পেতে থাকার বৈশিষ্ট্য অজগরকে অনেক সাহায্য করে প্রকৃতিতে শিকার ধরে আহার জোগাতে।
এরা নিশ্বাস দিয়ে প্রাণী বা শিকার কাছে টেনে নেয় বা এদের বিষ-নিশ্বাসে সম্মোহিত হয়ে প্রাণীরা আপনা থেকেই ধরা পড়ে—এমন প্রচলিত কথাও আদতে গুজব। এরা নির্বিষ সাপ। তবে এর শিকারের আওতায় গেলে আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে; সেক্ষেত্রে বিপদ হতে পারে।
দুধরাজ সাপ খায় না দুধ
দুধরাজ সাপ—নাম শুনলেই হয়তো মগজে সাপটি সম্পর্কে ধারণা আসে যে 'এই সাপ দুধ খেতে পটু বিধায় সাপটির নাম দুধরাজ সাপ।' বাস্তব সত্য হলো, দুধরাজ কিংবা অন্য কোনো সাপেরই দুধ খাওয়ার ক্ষমতাই নেই। কেননা সাপ দুধে থাকা ল্যাকটিক এসিড হজম করতে পারে না এবং মুখ ও জিহ্বার গঠনের জন্য এর চুষে কোনো প্রাণীর দুধ খেতে পারার ক্ষমতা নেই। আমাদের দেশে দুই প্রকার দুধরাজ সাপ রয়েছে—তামাটে মাথা দুধরাজ এবং সাধারণ দুধরাজ। দুটোই নির্বিষ।
দুধ সাপের কাছে বিষ সমতূল্য। প্রশ্ন থাকতে পারে যে, তাহলে দুধরাজ নামে কেন ডাকা হয়?
দুধরাজ সাপ প্রচুর ইঁদুর শিকার করে থাকে। দেশের অধিকাংশ গোয়ালঘর মাটির হওয়ায় সেখানে খড় থাকে। খড়ের গাদায় ইঁদুর গর্ত করে বাসস্থান তৈরি করে বলে দুধরাজ সাপ খাদ্যের সন্ধানে ইঁদুর শিকার করতে গোয়ালঘরে আসে। দুগ্ধবতী গাভীর স্তনে দুধ খেতে এক ধরনের মাছি আক্রমন করে, এতে করে ওলানে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং রক্ত পড়তে দেখা যায়। অজ্ঞতাবশত যেহেতু সাপকে গোয়াল ঘরের আশেপাশে দেখা গিয়েছে, তাই ভুল ধারণায় দুধরাজ সাপকে দোষারোপ করা হয় যে সাপ দুধ খেয়ে গেছে বিধায় গাভীর ওলান এমন রক্তাক্ত হয়ে গেছে। এই কুসংস্কারের জন্য আদতে নির্বিষ, খানিকটা বদরাগী অথচ আমাদের উপকারী এই সাপটা প্রায়ই মারা পড়ে।
দুই মুখওয়ালা সাপ; আদতেই দুমুখো?
সাপটির প্রচলিত বাংলা নাম হলো 'পুঁয়ে সাপ'। বৈজ্ঞানিক নাম; Indotyphlops braminus'. ইংরেজি নাম Brahminy Blind Snake. সাপটির অন্য আরেকটি বাংলা নাম হলো, 'আতালকুইচ্চা বা আদলকুইচ্চা।'
কেঁচোর মতো দেখতে সাপটিকে অনেকে কেঁচোর সাথে মিশিয়ে ফেলেন। নিশাচর সাপটি মাটির নিচে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। শরীরের গঠন কেঁচোর মতো হওয়ায় লেজ ও মাথার গঠন ঠিকমতো খেয়াল না করলে প্রায় একইরকম লাগে বিধায় সাপটির মুখ দুইদিকে বলে ভুল করে থাকেন অনেকেই।
নির্বিষ সাপটি অমেরুদণ্ডী প্রাণীর লার্ভা, যেমন পিঁপড়া, উইপোকা-জাতীয় প্রাণীর লার্ভা, পিউপা খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে। অতিবৃষ্টি হলে গর্তে পানি ঢুকলে অথবা খাদ্যের খোঁজে এরা মাটির নিচ থেকে বের হয়, তখন মানুষের চোখে পড়লে এটিকে দেখে অনেকেই একে দুমুখো সাপ বলে আখ্যায়িত করলেও আদতে এর কোনো ভিত্তি নেই।
উড়ুক্কু কালনাগিনী কি আসলেই ইচ্ছাধারী বা রূপবদলকারী?
কালনাগিনী হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় 'Flying Snake' বা উড়ুক্কু সাপ, যার ইংরেজি নাম 'Ornate Flying Snake'. এরা গাছের উপর থেকে নিচের দিকে লাফিয়ে চলাচল করে থাকে। এই ব্যাপারটিকে বলা হয় 'Snake Gliding'. কালনাগিনী এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছের ডালে লাফ দেওয়ার সময় তার শরীরকে প্রসারিত করে ফেলে, যেন বেশি সময় বাতাসে ভেসে থাকা যায়, অতিরিক্ত বাধা অতিক্রম করে আগানো যায়।
প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, কালনাগিনী ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫ মাইল গতিতে, সর্বোচ্চ ১০০ মিটার (৩০০ ফিট) গ্লাইড করতে পারে বা বাতাসে ভেসে থাকতে পারে।
আশি-নব্বইয়ের দশকে নির্মিত বহু সাপের চলচ্চিত্রে খলনায়িকার চরিত্রে 'কালনাগিনী সাপ'কে উপস্থাপন করা হয়েছে। কালনাগিনীর এক ছোবলেই ছবি হয়ে যেতে দেখা যেত সিনেমার চরিত্রদের। কালনাগিনী চরিত্রটি ইচ্ছে করলেই সাপের রূপ বদলে মানুষের রূপ নিতে পারত, আবার হঠাৎ করে ধারণ করত সাপের রূপ। আদতে কালনাগিনী সাপটি মৃদু বিষধর, যা কীটপতঙ্গ পোকামাকড় শিকার করে বেঁচে থাকে। মানুষের ক্ষতি করতে পারে, এমন বিষই নেই সাপটির বিষথলিতে। ফলে এটি মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
দাঁড়াশের কাঁটায় নেই যে বিষ
কৃষিজমির ইঁদুর খেয়ে সরাসরি কৃষকের উপকার করে বলেই দাঁড়াশ সাপকে দেওয়া হয়েছে 'কৃষকের বন্ধু' উপাধি। বাংলাদেশের সব অংশেই দাঁড়াশের দেখা মেলে। এবার আসি মূল কথায়। দাঁড়াশের লেজের দিকে যে অংশকে দাঁড়াশের কাঁটা বলে চিহ্নিত করা হয়, সেটি হলো সাপটির পুং জননাঙ্গ (হেমিপেনিস), যা দেখে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে অনেকে একে কাঁটার সাথে তুলনা করে থাকেন।
গ্রামগঞ্জে প্রচলিত আছে, দাঁড়াশের কাঁটার আঘাতে পচন ধরে; যা সম্পূর্ণ ভুল। প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, একটি দাঁড়াশ সাপ প্রায় ৩ একর কৃষিজমির ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
পরিশেষে
সাপ শিকারি প্রাণী হিসেবে খাদ্যশৃঙ্খলে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ক্ষতিকর রোডেন্ট-জাতীয় প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল পরিমাণে ফসল রক্ষা করে, প্রাণীবাহিত সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমায়। সাপের বিষ থেকে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি করা হয়; ফলে পরিবেশে এর গুরুত্ব সর্বাধিক।
তাই সাপকে ভয় না পেয়ে বরং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধমেই মানুষ ও সাপসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রাকৃতিক সহাবস্থান নিশ্চিতকরণে উদ্যেগ নেওয়ার এটাই সেরা সময়।
- সীমান্ত সরকার: প্রাণিপ্রেমী, সাপ ও অন্যান্য প্রাণীরক্ষার্থে নিয়োজিত