বাংলাদেশ ও ‘বিদেশি শক্তি’র ভূত
শেখ হাসিনার পতন নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম গুলোতে মজাদার বিভিন্ন তত্ত্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যম প্রচার করছে, ৮৪ বছর বয়সী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস একজন "সিআইএ এজেন্ট"। তার ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তারা দাবি করছে, হাসিনার সবচেয়ে বড় সমর্থক ও আঞ্চলিক শক্তি ভারতকে তারা হারিয়ে দিয়েছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং অধ্যাপক এবং ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সি. রাজা মোহন ঢাকার অভ্যূত্থান, শেখ হাসিনার পতন, দিল্লির ভূমিকা, ভারতের গণমাধ্যম একই সঙ্গে 'বিদেশি শক্তির হাত' ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে এক বিশ্লেষণমূলক বক্তব দিয়েছেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তা আজ প্রকাশিত হয়েছে।
আসলেই কী হচ্ছে?
এ উপমহাদেশে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এসব তত্ত্বের কোনো প্রমাণের প্রয়োজন হয় না আবার এগুলো খণ্ডন করাও কঠিন। দেশের বিভিন্ন সমস্যায় দক্ষিণ এশিয়ার শাসকরা প্রায়ই 'বিদেশিদের হাত' তত্ত্ব ব্যবহার করে থাকে।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছিল ভারতীয় রাজনীতির একটি সাধারণ বিষয়। ইন্দিরা গান্ধী তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে যখনই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন, তখনই সিআইএ-কে দোষারোপ করতেন। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করার সময়ও, তিনি এবং তার বাম সমর্থকরা দেশের 'ফ্যাসিবাদী ও বিদেশিদের 'সাম্রাজ্যবাদীদের' দোষ দিয়েছিলেন।
এখন অনেকেই মনে করেন, 'উদীয়মান ভারত' এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং নিরাপদ। তবে 'ঢাকায় একজন মিত্র'কে হারানোর ধাক্কা দিল্লিতে নতুন করে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। এ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রাজনৈতিক পক্ষপাতকে উস্কে দেয় এবং সাধারণ জনগণকে এসব নিয়ে ভাবতে নিরুৎসাহিত করে। এতে সরাসরি সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
তবে শেখ হাসিনা দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন। তিনি তার দলকে দুর্বল করে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন। বারবার নির্বাচনে কারচুপি, ক্ষমতায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। তাই কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূচনা করে।
তাই শেখ হাসিনাও এর ব্যতিক্রম নন। তিনিও ওই একই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি হয়তো ক্ষমতা হারানোর শোকে এই তত্ত্বে আস্থা রাখতে বাধ্য হয়েছেন। শেখ হাসিনা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি করতে না দেওয়ায় তারা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
তবে শেখ হাসিনাই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নেতা নন, যিনি ক্ষমতা হারানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও একই ধরনের কথা বলে আসছেন। ইমরান খান মনে করেন, পাকিস্তানে ঘাঁটি করতে না দেওয়ায়ও তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
আসলে, চীনা সামরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ-সুবিধার খোঁজে রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ঘাঁটি স্থাপনের জন্য আমেরিকা ষড়যন্ত্র করছে, এমন ধারণা করা অযৌক্তিক। কারণ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সিআইএকে অত্যধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত বিষয়গুলো সিআইএ-এর ক্ষমতাকে বাস্তবতার চেয়ে অতিরঞ্জিত করে বলা হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ভেনেজুয়েলার সাম্প্রতিক নির্বাচনে অত্যন্ত সমালোচিত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি সিআইএ। আবার কিউবায় ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ দুটো দেশই যুক্তরাষ্ট্রের নিকটবর্তী।
সিআইএই একমাত্র সংস্থা নয় যা দক্ষিণ এশিয়ার ষড়যন্ত্র তত্ত্বকারীদের কল্পনাকে উস্কে দিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংকেও (র) বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয়।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বকারীরা যখন "বিদেশি হাত"কে দোষারোপ করেন, তারা উপলব্ধি করুন বা না করুন, তারা ভারতের প্রতিষ্ঠানের একটি বড় ব্যর্থতাকে দিকে ইঙ্গিত করছেন। যদি বলা হয় যে সিআইএ ভারতের নাকের ডগায় বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তার অর্থ দাড়াচ্ছে দিল্লি বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল মুহূর্তটি ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের আজকের এই সংকটের উৎপত্তি ও বিস্তার এবং এই সংকট নজরদারির জন্য দিল্লির ব্যবস্থাপনার ওপর ভারতের পক্ষ থেকে একটি গুরুতর 'ময়নাতদন্ত' করতে হবে। কারণ সেটি করা গেলে আঞ্চলিক নীতির ঠিক রাখার জন্য এটি ভারতের জন্য একটি মুল্যবান শিক্ষা হয়ে থাকবে।
তাই মনে রাখা জরুরি যে, কোনো শক্তিই একচেটিয়াভাবে রাজনীতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আর শক্তি যদি বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক যা-ই হোক কৌশলগত স্বার্থের হলেও তা সম্ভব নয়। তাছাড়া যেকোনো সরকারই, যতই দক্ষ হোক না কেন, অন্য দেশের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভুল বোঝার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়।
তাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সান্ত্বনা খোঁজার পরিবর্তে, ভারতের কৌশলগত সম্প্রদায়ের উচিত হাসিনার ট্র্যাজেডির দিকে গভীরভাবে নজর দেওয়া। যেমন শেক্সপিয়ার তার রিচার্ড দ্য সেকেন্ড-এ আহ্বান জানিয়েছেন, "সৃষ্টিকর্তার দোহাই, আসুন মাটিতে বসে রাজা-রানিদের পতনের দুঃখজনক গল্প বলি" ।
হাসিনার গল্পে রয়েছে বিজয় এবং ট্র্যাজেডি দুটোই রয়েছে। তিনি অসম্ভবের বিরুদ্ধে টিকে থেকেছেন এবং জাতির মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছেন। গত ১৫ বছরে, হাসিনা বাংলাদেশকে একটি দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করেছেন এবং এটিকে অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্যই মডেল, যা অনুসরণে পাকিস্তানকেও উৎসাহিত করেছে। এছাড়া, তিনি ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বিভেদের ইতিহাস পেরিয়ে, সীমান্ত বিরোধ মেটাতে, সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাতে, আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি করতে এবং দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করেছেন। তবে সব ট্র্যাজিক নায়কের মতো, তারও কিছু মারাত্মক ত্রুটি ছিল। তিনি ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার সংকল্প করেছিলেন এবং ইতিহাস নিয়ে রাজনৈতিক বিভাজন রোধে তিনি অসমর্থ হয়েছেন। তার এই ট্র্যাজিক পরিণতি সত্ত্বেও, হাসিনা উপমহাদেশের আধুনিক ইতিহাসে একটি সত্যিকারের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় ভারত মর্মাহত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনায় দিল্লির আটকে পড়লে হবে না। তাকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে। কারণ শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে যে শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দিয়েগেছেন তা রক্ষায় নতুন সরকারদের সহযোগিতা করতে হবে। রাজনৈতিক মুক্তি এবং বিস্তৃত অর্থনৈতিক সুযোগের জন্য আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হকে দিল্লির। বাংলাদেশে তাত্ক্ষণিক স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদী উত্থানে সহায়তা করতে, ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবেও থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।
গত কয়েক বছরে, দিল্লি এবং ওয়াশিংটন দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়গুলোতে একে অপরের কাছাকাছি এসেছে। গত কয়েক মাসে, বাংলাদেশ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক পার্থক্য কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা চলেছে তাদের মধ্যে। কারণ গত জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকার ওপর রাজনৈতিক চাপ কমানোর জন্যও ওয়াশিংটনকে উৎসাহিত করেছেন। বাংলাদেশে জানুয়ারির নির্বাচনের নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও, বাইডেন প্রশাসন হাসিনার নতুন সরকারের সাথে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্যা দিল্লি কিংবা ওয়াশিংটনের সঙ্গে ছিল না। সমস্যা হলো শেখ হাসিনা সনেতিক ঘরিকে থামাতে পারেনি।
পরিশেষে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের উপমহাদেশে ও এর জলসীমায় তাদের মধ্যে বিদ্যমান কাঠামোগত সম্পর্ককে দুর্বল করতে পারবে না। বাংলাদেশের বর্তমান সংকট এবং মিয়ানমারের চলমান ঝড় মোকাবেলায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ ও সহযোগিতকার প্রয়োজনীতাকেই তুলে ধরছে। বঙ্গোপসাগর এবং এর উপকূলে এ ধরনের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।