বন্যার আসল কারণ কী?
বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার মাত্র দুই মাস পরেই, আবার দেশের দক্ষিণাঞ্চল নতুন করে বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। গত বুধবার ২১ আগস্ট ২০২৪ মধ্যরাত থেকে হঠাৎ করেই এ বন্যার পানি আসতে শুরু করে। ফেনী, নোয়াখালী এবং কুমিল্লায় বন্যার পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে।
ভারতের ত্রিপুরার গোমতী নদীর উপর ডম্বুর ড্যাম ৩১ বছর পর ভারী বর্ষণের কারণে খুলে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই ড্যাম খোলার কারণেই বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ বন্যার প্রকৃত কারণ বুঝতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দুইজন জলবায়ু এবং পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে।
"বৃষ্টির ব্যাপারে জানতো আবহাওয়া অধিদপ্তর, কিন্তু তারা সতর্ক করেনি"
ড. আইনুন নাহার নিশাত
ইমেরিটাস অধ্যাপক, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথমত, স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে ড্যাম এবং পানিরোধী বেষ্টনীগুলো নিয়ে ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এগুলো বিভ্রান্তি তৈরি করছে। ড্যামকে 'বাঁধ' বলা ঠিক নয়। জলাধার হিসেবে ব্যবহারের জন্য মূলত নদীর ওপর এসব ড্যাম তৈরি করা হয়। অপর দিকে বাঁধ হলো পানিরোধী বেষ্টনী, যা পানি উপচে পড়া থেকে রক্ষা করে।
ভারতে গোমতী নদীর উপর একটি ড্যাম রয়েছে এবং চট্টগ্রামের কাপ্তাইতেও একটি ড্যাম রয়েছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এ ড্যামগুলো পূর্ণ করা হয়, কারণ যত বেশি পানি সংরক্ষণ করা যাবে, তত বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তবে বর্ষার শেষ দিকে যদি বৃষ্টি হয়, তখন ড্যামগুলো আর পানি ধরে রাখতে পারে না।
এই ড্যামগুলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা প্রতিরোধের জন্যও ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই ত্রিপুরা এবং কুমিল্লার নিম্নাঞ্চলে দীর্ঘদিন বন্যা হয়নি। যার কারণে দীর্ঘ ৩০ বছরে কুমিল্লায় কোনো বন্যা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, গোমতী নদীর অববাহিকায় ড্যামটি অবস্থিত। এর অর্থ হলো এ ড্যামের কারণে ফেনী, নোয়াখালী কিংবা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বন্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু গতকালের পত্রিকা থেকে আমি জেনেছি, এসব এলাকায় ও ত্রিপুরায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর এ অতি বৃষ্টির কারণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া একটি নিম্নচাপ। তবে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
এছাড়া, দিল্লিতেও প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। যদিও এর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমি এই প্রসঙ্গটি তুলেছি কারণ ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি) সেখানে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় কমলা সতর্কতা জারি করেছে এবং ত্রিপুরায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।
এসব তথ্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরও পেয়েছে। তারা তাদের রাডারের মাধ্যমে বৃষ্টির বিষয়টি জানতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। যদি একদিন আগেও আমাদের সতর্ক করা হতো, তাহলে আমরা নিজেদের প্রস্তুত করতে পারতাম।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আধুনিকায়ন প্রয়োজন। আমরা গত ৫০ বছর ধরে একই কথা বলে আসছি।
গত ৩০ বছরে গোমতী অববাহিকায় তেমন বন্যা হয়নি। মানুষ সেখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বেষ্টনীর কথা ভুলে গেছে এবং এত বেশি পানি আসার কারণে যদি সেখানে কোনো ফাটল তৈরি হয় তাহলে আমি অবাক হবো না।
মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে, রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এবং ফসল পানির নিচে চলে গেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে পানির উচ্চতা বেশি নয়। গোমতী নদীর পানি বিপদসীমার ১-২ ফুট ওপরে রয়েছে। যদি বাঁধগুলো কার্যকর থাকত, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তাই বাঁধগুলো বন্যা প্রতিরোধে সক্ষম কিনা তা নিশ্চিত করতে প্রতি বর্ষায় সব বাঁধ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আর আগস্ট মাসে বন্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পেশাগতভাবে এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি সদ্য দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই তার পক্ষে এখনই কিছু করা সম্ভব হয়নি। পানি মন্ত্রণালয়, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকারকে এই বিষয়ে দায়ী করা উচিত। প্রকৌশলীদের বদল করা হয়নি, তারা কী করেছে?
[টিবিএসের স্টাফ ফিচার লেখক আরিফুল হাসান শুভ'র সাথে মুঠোফোনে এসব জানিয়েছেন ড. আইনুন নিশাত।]
"আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতার দিকেও নজর দিতে হবে"
গওহর নাঈম ওয়াহরা
জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ
ড্যামগুলো খুলে দেওয়ার আগে ভারত আমাদের আগাম নোটিশ দিতে পারতো। আমরা এর আগেও দিনাজপুরে এমন একটি পরিস্থিতি দেখেছিলাম। সেখানে তারা অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ড্যাম খুলে দেওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসককে জানিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা তা করেনি।
প্রথমত, তারা দুই বা ততোধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীর ওপর ব্যারেজ নির্মাণ করতে পারে না। আমাদের উচিত এই বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা।
তবে যাইহোক, বন্যার একমাত্র কারণ কিন্তু এটি না। আমাদের নিজেদের দুর্বলতাগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে, যাতে আমাদের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকে।
পানি ছাড়ার আগে বৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এই বৃষ্টি এবং বন্যার সম্ভাবনা প্রায় ১০ দিন আগেই স্পষ্ট ছিল। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে কোনো পূর্বাভাস জারি করা হয়নি। জনগণকে সতর্ক করা আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রাথমিক দায়িত্ব এবং কেন তা করা হয়নি তার জন্য অবশ্যই জবাবদিহিতা থাকা উচিত।
ফেনী এবং অন্যান্য অঞ্চলের বর্তমান প্রজন্ম এর আগে এমন একটি বন্যা দেখেনি। তাদের সতর্ক করা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় সম্পর্কে জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেখানকার ড্রেনেজ সিস্টেম ভেঙে পড়েছে।
আমাদের অবকাঠামোর দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের উচিত নদীর প্রবাহের মানচিত্র তৈরি করা এবং সেসব এলাকার চিহ্নিত করা যেখানে বাড়ি বা অবকাঠামো নির্মাণ এড়ানো উচিত, যাতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়।
বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা বজায় রাখা। মানুষ তাদের আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। দুর্যোগের সময় মোবাইল অপারেটরদের ভূমিকা প্রায়ই অদৃশ্য থাকে। তাদের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য ব্যাটারি সাপোর্ট এবং নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সেবা নিশ্চিত করা। উদ্ধার কার্যক্রমগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত। আমি মনে করি, এখন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর সব ফায়ার ব্রিগেড মোতায়েন করা উচিত। শিশুদের উদ্ধার করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
[টিবিএসের স্টাফ ফিচার লেখক আরিফুল হাসান শুভ'র সাথে মুঠোফোনে এসব জানিয়েছেন গাওহার নাঈম ওয়াহরা।]