নিজেকে পরিবর্তন করার ৬টি কার্যকর উপায়
অধিকাংশ মানুষ নিজের বর্তমান অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট। কেউ নিজের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে, কেউ আর্থিক অবস্থার কারণে, আবার কেউবা জীবনের অন্যান্য দিক নিয়ে হতাশ।
কিন্তু আপনি কি জানেন, নিজেকে পরিবর্তন করা সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে, নিজেকে পরিবর্তন করা কোনো অস্বাভাবিক বা অসম্ভব কাজ নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাই; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাভাবনা, এবং জীবনযাত্রা পরিবর্তিত হয়।
প্রশ্ন হলো, আমরা নিজেরা কেন এ পরিবর্তন করতে চাই? এবং কীভাবে এ পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
১. নিজেকে ফোকাস করুন: সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সমাধানের জন্য প্রস্তুত হওয়া
নিজেকে পরিবর্তন করার প্রথম ধাপ হলো নিজের অবস্থার পর্যালোচনা করা এবং সমস্যা চিহ্নিত করা। আপনি যদি মনে করেন আপনার স্বাস্থ্য, আর্থিক অবস্থা, বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে অসন্তুষ্ট, তাহলে প্রথমে এসব সমস্যার মূল কারণগুলো বের করে তা নিয়ে কাজ করা উচিত।
অনেক সময় আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। যেমন, আপনি যদি মনে করেন যে আপনার আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা দরকার, তবে প্রথমে বুঝতে হবে কোথায় আপনি খরচ কমাতে পারেন বা কীভাবে নতুন আয়ের উৎস তৈরি করা যায়।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের এক গবেষণায় (২০১৯) দেখা গেছে যে, যারা নিজের সমস্যা এবং সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করেন, তারা ৬০% ক্ষেত্রে জীবনে সফল হন।
এ গবেষণা দেখায় যে, নিজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে আমরা জীবনের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি।
২. মানসিকতা পরিবর্তন করুন: ফিক্সড মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে আসুন
ক্যারল ডুয়েকের বিখ্যাত বই 'মাইন্ডসেট: দ্য নিউ সাইকোলজি অব সাকসেস'-এ বলা হয়েছে, মানুষের দুই ধরনের মানসিকতা থাকে: ফিক্সড মাইন্ডসেট এবং গ্রোথ মাইন্ডসেট। যারা ফিক্সড মাইন্ডসেটে থাকেন, তারা বিশ্বাস করেন যে তাদের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। তারা মনে করেন, যেটা তাদের জন্মগতভাবে দেওয়া হয়েছে, সেটাই তাদের নিয়তি।
অন্যদিকে, যারা গ্রোথ মাইন্ডসেটে বিশ্বাস করেন, তারা জানেন যে সময়ের সঙ্গে নিজেদের উন্নত করা এবং অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব।
এ মনোভাব হলো পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। যখন আমরা নিজেদের উন্নতির জন্য মানসিকতা পরিবর্তন করি, তখনই আমরা প্রকৃত পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যেতে পারি। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় (২০১৮) দেখা গেছে, যারা তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করেন এবং নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, তারা ৭৫% ক্ষেত্রে জীবনে সাফল্য অর্জন করেন।
৩. আপনার শক্তি এবং সম্পদগুলোর ওপর ফোকাস করুন
প্রায়ই আমরা অন্যের জীবনের দিকে তাকিয়ে নিজের দুর্বলতা নিয়ে হতাশ হই। অন্যের সবকিছুই যেন ভালো মনে হয়। কিন্তু যদি আমরা নিজেদের কার্যক্রম যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করি, তাহলে নিজের জীবনে উন্নতির কোনো পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অন্যের জীবন দেখে নিজের জীবনকে কম মূল্যায়ন করা খুবই সহজ। কিন্তু আমাদের উচিত নিজেদের শক্তির ওপর মনোনিবেশ করা।
জানুন আপনার কাছে কী আছে এবং সেই সম্পদগুলো কিভাবে উন্নত করতে পারেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, "যারা তাদের নিজস্ব শক্তি এবং দক্ষতার ওপর মনোযোগ দেন, তারা সাফল্যের পথে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে পারেন।"
অন্যদের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের শক্তির ওপর মনোযোগ দিন এবং সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যান।
৪. নেতিবাচক অভ্যাস ত্যাগ করুন
নিজেকে পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে নিজের নেতিবাচক অভ্যাসগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের প্রতিদিনের অনেক অভ্যাস আছে যা আমাদের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। যেমন, অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান, বা খারাপ সঙ্গে মেশা— এগুলো সবই নেতিবাচক অভ্যাস।
যখন আপনি এসব নেতিবাচক অভ্যাস ত্যাগ করবেন, তখন দেখবেন আপনার জীবনের অন্যান্য দিকগুলোও উন্নতি করতে শুরু করবে।
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, "যারা তাদের নেতিবাচক অভ্যাসগুলো ত্যাগ করেন, তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত উন্নতির হার ৮০% বৃদ্ধি পায়।"
৫. ধীরে ধীরে ইতিবাচক অভ্যাস তৈরি করুন
নিজেকে পরিবর্তন করতে হলে ইতিবাচক অভ্যাস তৈরি করা অপরিহার্য। আপনি যদি প্রতিদিন ছোট্ট একটি ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তোলেন, যেমন ধ্যান করা, প্রতিদিন ১০ মিনিট বই পড়া বা ব্যায়াম করা— তাহলে ধীরে ধীরে এ অভ্যাসগুলো আপনার জীবনকে আরও উন্নত করবে।
ইতিবাচক অভ্যাস তৈরি করার জন্য সময় লাগবে, কিন্তু একবার যদি তা আপনার জীবনের অংশ হয়ে যায়, তবে আপনি সহজেই আরও বড় পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের এক গবেষণায় (২০১৯) বলা হয়েছে, "ইতিবাচক অভ্যাসের মাধ্যমে জীবনের মান উন্নত করা সম্ভব, এবং যারা প্রতিদিন একটি করে ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তোলেন, তারা দীর্ঘমেয়াদে আরও সুখী এবং সফল হন"।
৬. নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করুন এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
নিজেকে পরিবর্তন করতে হলে আপনাকে নিজের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি করতে হবে। আপনি যদি প্রতিদিন নিজের উন্নতির জন্য কাজ না করেন, তাহলে কোনো পরিবর্তনই স্থায়ী হবে না। আর এর জন্য আপনাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। লক্ষ্য নির্ধারণ ছাড়া কোনো পরিবর্তনই সম্ভব নয়।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় (২০২০) দেখা গেছে, "যারা তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন, তারা ৭৫% ক্ষেত্রে সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন"।
তাই নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করুন এবং আপনার জীবনের লক্ষ্যগুলো লিখে ফেলুন।
নিজেকে পরিবর্তন করা একদিনে সম্ভব নয়, তবে এটি ধাপে ধাপে করা সম্ভব। প্রথমে নিজের সমস্যা চিহ্নিত করুন, তারপর মানসিকতা পরিবর্তন করে ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলুন। নেতিবাচক অভ্যাস ত্যাগ করুন এবং নিজের শক্তি ও সম্পদগুলোর ওপর ফোকাস করুন।
আর সর্বোপরি, নিজের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকুন, আর দেখবেন আপনার জীবন এক নতুন পথে ধাবিত হবে।
সাইফুল হোসেন: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।