আসুন একসাথে কাজ করি: ভারতকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পৌঁছেছে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা শেখ হাসিনা সরকারের পতন অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে আমাদের উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতার সম্ভাবনাগুলো মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং আমি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিবাচক দিকগুলো এগিয়ে নিতে এবং ভুল বোঝাবুঝির জায়গাগুলো বাস্তবসম্মতভাবে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
আমাদের অবস্থান প্রথম থেকেই পরিষ্কার—আমরা ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে ভালো কাজের সম্পর্ক চাই। আমরা আশা করি, আমাদের ভারতীয় অংশীদাররাও এই আকাঙ্ক্ষাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে গত ডিসেম্বর মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রের ঢাকা সফর ছিল ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যমান, এবং এই সহযোগিতার ধারাবাহিকতা উভয় দেশের মানুষের জন্যই কল্যাণকর হবে।
বিশ শতকের শেষ দশক থেকে ভারত অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে—বিশ্বজোড়া প্রভাব বিস্তারকারী প্রযুক্তি খাত হোক বা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া, ভারত তার সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে। বাংলাদেশও কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে আমাদের অবস্থান চীনের পরেই দ্বিতীয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের অবদান যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ, যা বিশ্বজুড়ে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্ভাবিত মাইক্রোক্রেডিট মডেল বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং এটি ভারতে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে।
সম্প্রতি, ভারতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মধ্যবর্তী শূন্যতার সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না, যার ফলে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার শিকার বেশিরভাগই ছিলেন আগের সরকারের ঘনিষ্ঠজন, যাদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি দেশের সাধারণ নাগরিকরাও হিন্দু পরিবার ও মন্দির রক্ষায় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। দুঃখজনকভাবে, ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরঞ্জিত এবং অনেক ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়িয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং বাংলাদেশের হিন্দুরা সমান অধিকারসম্পন্ন নাগরিক। আমাদের আনন্দের বিষয় যে, ভয়েস অব আমেরিকার এক স্বাধীন জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে উন্নত হয়েছে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল তৈরি করতে চাই। ভারতীয় সাংবাদিকদের আমরা বাংলাদেশে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই, যাতে তারা স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে পারেন।
আমাদের সরকার দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনর্জীবিত করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে, যা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কার্যত অকার্যকর হয়ে আছে। কিন্তু ভারত এখনো এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। আমাদের বিশ্বাস, ভারতের এতে ভয়ের কিছু নেই। আমরা জানি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতা গড়ে তুলতে সময় লাগবে। তবে দীর্ঘ পথচলার জন্য প্রথম পদক্ষেপটি নেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অন্তত আঞ্চলিক নেতারা আগামী কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একসঙ্গে একটি ছবি তুলতে পারেন, যা সহযোগিতার প্রতি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করবে।
সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কিছু আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উভয় দেশের জেলেদের মুক্তি, এবং বাংলাদেশকে নেপালের জলবিদ্যুৎ থেকে কিছু অংশ পাওয়ার অনুমোদন সংক্রান্ত ত্রিদেশীয় চুক্তি। আসুন, এই ইতিবাচক উদ্যোগগুলোর ওপর ভিত্তি করে এমন একটি পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলি, যা উভয় দেশের জনগণ, সমগ্র অঞ্চল এবং বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্য কল্যাণকর হবে। এর অংশ হিসেবে সীমান্তে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক হত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো বন্ধ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। আমাদের জনগণের অর্জন অনেক বেশি, এবং ইতিবাচক ও বাস্তববাদী সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আমরা এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারি।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন