নারী ফুটবলারদের নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে হচ্ছে কেন?
"'ব্যাপারটা আমাদের আত্মসম্মানের'... এটুকু বলেই মাথা নিচু করে ফেললেন সাবিনা খাতুন। আর মাথা তুলছিলেন না। মিনিটখানেক পর মাথা তুললে দেখা যায় তাঁর চোখে পানি। কথা আর বাড়ালেন না। পিছিয়ে গিয়ে সামনে জায়গা করে দিলেন আরেকজনকে।" পত্রিকায় সাবিনার এই ক্রন্দনরত ছবিটি দেখে মনে হলো, ঠিক তিন মাস আগের আরেকটি ছবির কথা। সেদিনও বাফুফে ভবনে সঙ্গী খেলোয়াড়দের নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সাবিনা। সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন হাসিমুখে, টানা দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি নিয়ে। তবে এবার সাবিনারা দাঁড়িয়েছেন হাসিমুখে নয়, অমর্যাদা আর অপমানের যন্ত্রণা নিয়ে, চোখেমুখে হতাশা আর কান্না নিয়ে। এই দৃশ্য সহ্য করা কঠিন।
এই খেলোয়াড় মেয়েরা দেশকে তাদের সেরাটা দিয়েছেন, আমাদেরও উচিত তাদেরকে সেরা কিছু দেওয়া। দেশের জন্য যারা সম্মান বয়ে এনেছেন, আমাদের উচিত তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া, তাদের অভিযোগ ও দাবি-দাওয়ার দিকে গুরুত্ব দেওয়া। অথচ তা না করে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছি, যেখানে মেয়েগুলোকে সবার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে হলো।
কোচ বাটলারের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ করেছেন আমাদের নারী ক্রিকেটাররা। মানসিক হয়রানি, উৎপীড়ন, গালাগালি, মানুষ হিসেবে অমর্যাদা করা, বডি শেমিং, দুর্ব্যবহার, ধারাবাহিক বৈষম্য, অন্যায় আচরণ এমন অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে। বাটলারের অধীনে অধিকাংশ খেলোয়াড়ই হতাশাগ্রস্ত ও আতঙ্কবোধ করছেন বলে তারা দাবি করছেন। কোচের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ কেন করছেন খেলোয়াড়রা, সেটা ফয়সালা হবার আগেই বাফুফে বাটলারের সাথে চুক্তি নবায়ন করেছে।
এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) খেলোয়াড়দের অভিযোগ ও দাবিকে ততোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না, যতোটা জরুরি মনে করেছে বাটলারের চুক্তি নবায়ন করার বিষয়টি।
১৮ নারী ফুটবলার বাফুফে প্রধানের কাছে সমস্যার আশু সমাধান চেয়েছেন। বাফুফে প্রধান এখন দেশে নেই। করণীয় ঠিক করতে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বাফুফে। অপেক্ষা করতে হবে কমিটি কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখার জন্য।
সাফ ২০২৪ চলার সময়েও গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল দলের ভেতরের গ্রুপিং ও কোন্দলের কথা। কোচের নানান সিদ্ধান্তেই অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন ফুটবলাররা। নানান বিতর্কিত ঘটনার পরেও বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে পিটার বাটলারের অধীনে দক্ষিণ এশিয়ান নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিল।
হয়তো এখন বাফুফে দু'পক্ষের সাথেই কথা বলে একটা সমঝোতার চেষ্টা করবে। কিন্তু এই বিদ্রোহ-অভিযোগের কাহিনী যখন শুরু হয়েছিল, তখন কি আলোচনায় বসা যেতো না? তাহলেই তো এই সমস্যা এতো বাড়তো না, প্রকাশ্যেও আসতো না। বাংলাদেশের মেয়েরা খেলাধুলায় এগিয়ে যাবে, এটাই সবাই চাইছে। কোনো অবস্থাতেই দলে বিভাজন চাইছে না কেউ। তাই বিভাজন সৃষ্টি হতে পারে এমন বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়াটা জরুরি।
আরেকটি অভিযোগ উঠেছে যে, মেয়েরা তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ পায়নি। এমনকি, সাফ জিতলে যে বোনাস দেওয়ার কথা ছিল ফুটবল ফেডারেশনের, সেটিও এখনও দেওয়া হয়নি। আর নারী ফুটবল দলের সাথেও চুক্তি নবায়ন করেনি বাফুফে। কেন বাফুফে এই বিষয়গুলোকে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রেখেছে?
মেয়েরা অভিযোগ করেছেন, তাদের মানসিক হয়রানি এবং উৎপীড়নের একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন কোচ। এটি মানতে হবে– কোচিংয়ে শুধুমাত্র কৌশল এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলেই হয় না বরং পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস এবং সমর্থনের পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষমতাও কোচের থাকতে হয়। কিন্তু তা কোচের মধ্যে নেই বলেই মনে করছেন সিনিয়র নারী ফুটবলাররা।
ফুটবল কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, বাইরের কারো ইন্ধনে এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই অভিযোগ করেছেন কোচ বাটলার। এই 'বাইরের কেউ'টা কে বা কারা– এটি জানা দরকার। সত্যিই যদি কেউ এরকম চেষ্টা করে, তাকে বা তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু সবচাইতে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে মেয়েরা কেন মেনে নিতে পারছেন না বাটলারকে? কেন তারা বাটলারকে আর কোচ হিসেবে চাইছেন না? বাটলার তাদের সাথে কেমন আচরণ করছেন, এটা জানা খুব জরুরি। এই তথ্য জানার জন্য খুব বেশি কিছু করতেও হবে না। শুধু চোখ-কান খোলা রাখলেই চলবে।
মেয়েরা এই কোচকে চাইছেন না, তারা পদত্যাগ করারও হুমকি দিয়েছেন। এ সত্ত্বেও কেউ কেউ বলছেন, মেয়েদের কথায় তো আর কোচ মনোনয়ন হবে না। খেলোয়াড়দের ওপর নির্ভর করেও তো ফেডারেশন চলবে না। ম্যানেজমেন্ট আছে, নির্বাহী কমিটির সদস্যরা আছেন, তারা সকলে মিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের কোনো কথা এখানে চলবে না।
সে না হয় মানলাম, কিন্তু এর তো একটা শেষ থাকবে। এভাবে তো চলতে পারে না। খেলোয়াড়রা প্রশিক্ষণ নেবেন, তারাই যদি কোচের বিরুদ্ধে থাকেন, তাহলে ফলাফলটা কী হবে? তাহলে কি কোচ নিয়োগে মেয়েদের মতামতের কোনো মূল্য দিচ্ছে না ফেডারেশন?
আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি আরব আমিরাতের সঙ্গে সেখানকার মাঠে ফিফা প্রীতি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। জুনে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব। এসব সামনে রেখে খেলোয়াড় আর কোচের বিরোধ সৃষ্টি হলে বিপদে পড়বে দেশ।
কোচ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যেই মেয়েদের নিয়ে বসেছিলেন বাফুফের নারী কমিটির প্রধান মাহফুজা আক্তার। জানা গেছে, মাহফুজা মেয়েদের পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, বাটলারের অধীনেই অনুশীলন করতে হবে। কোনোরকম বয়কট বা অন্য কিছু করা যাবে না। (প্রথম আলো)
এইসব সমস্যার বাইরেও নারী ফুটবলারদের যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তা হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিরোধ। তাদের 'অপরাধ' হচ্ছে আর দশজন ফুটবল খেলোয়াড়ের মতো তারাও শর্টস (হাফপ্যান্ট) পরে ফুটবল অনুশীলন করতেন। কেবল এ কারণেই অতীতে তাদেরকে মারধর করা হয়েছে। কিছু কিছু মানুষ মেয়েদের খেলার বিষয়টি পছন্দ করেন না। তারা সুযোগ পেলেই মেয়েদের কটু কথা শোনান। ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলে নারী ফুটবলের দুটি আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
দেশের নারী ফুটবলের অর্জনের তালিকাটা দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। বয়সভিত্তিক ফুটবলে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা যে অপ্রতিরোধ্য, তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই মেয়েরা গত ৭/৮ বছর ধরে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন। তারা তাদের সেরাটা দেশকে দিয়েছেন, কিন্তু আমরা দিতে পারছি কি?
কখনো কখনো মানুষের জীবনে এমন অর্জন যোগ হয়– যা তার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। সেই অর্জন এতটাই বড় হয়, যা পুরো জাতির জন্য সম্মান বয়ে আনে। হ্যাঁ, আমি আমাদের নারী ফুটবলাদের কথা বলছি। তাদের সেই অর্জনের কথা বলছি– যা দেশকে সম্মানিত করেছে।
একদম তৃণমূল থেকে উঠে আসা সেইসব মেয়েরা জীবনের অসংখ্য প্রতিকূলতা ও দারিদ্র্যকে জয় করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শিরোপা জয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেও আদতে তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ।
যারা খেলছেন, তারা যে শুধু সামাজিক বাধা জয় করে এসেছেন, তা নয়, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়েছেন। খেলে যেটুকু টাকা পান, তাই দিয়ে সংসার চালিয়ে নেন। তারা প্রায় সবাই গ্রামের খেটে খাওয়া পরিবার থেকে এসেছেন। আদিবাসী পরিবার থেকে এসেছেন আরও বেশি। যে মেয়েরা খেলছেন, তারা এই সমাজের অন্যায্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের বিপরীতে নয়, পাশাপাশি এই সমাজব্যবস্থার বিপরীতেও। এইরকম একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে যারা লড়াই করছেন, তাদের কেন নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে হচ্ছে?
এদের হাত ধরেই বাংলাদেশে আরও অনেক শিরোপা আসবে নিঃসন্দেহে, তাই ওদের জন্য সুবিধাটুকু নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। পেশাগতভাবে ছেলেদের মতো সমর্থন, সহযোগিতা ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
কিন্তু দেখছি তাদের অভিযোগ কানে তুলতে গড়িমসি করছে বাফুফে। নারী খেলোয়াড় বলেই কি এই বৈষম্য? পেশাদার খেলোয়ার হিসেবে নারীদের উঠে আসার মতো অবকাঠামোই বাংলাদেশে নেই। তাই নারী খেলোয়ারদের জন্য বাড়তি কিছু সাপোর্ট লাগবে।
সারাদেশ থেকেই নারী খেলোয়ার ট্যালেন্ট হান্ট করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ চলাকালে তাদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি চোখ দিতে হবে। তাদের আর্থিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ভাল প্রশিক্ষণ, মাথাগোঁজার ঠাঁই, প্রতিদিনের সুষম খাবার, খেলার সরঞ্জাম পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা আশা করছি, নারী খেলোয়াদের সাথে কোচের এই দ্বন্দ্ব মেটানোর জন্য ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও এগিয়ে আসবে। কোচের সাথে বিরোধ টিকিয়ে রেখে কোনো অর্জন সম্ভব নয়।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।