আবারও একটি তালেবান রাষ্ট্র মেনে নেবে আফগান জনগণ?
গেলো বছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মাঝে বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের যে আলোচনা হয়েছিলো তারই ধারাবাহিকতায় একই বছর সেপ্টেম্বরে কাতারের দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আফগান সরকার ও তালেবানের মাঝে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। বন্দি মুক্তির ইস্যুতে সেই আলোচনা খুব বেশি ফলপ্রসূ না হলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি বছরের ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্থাৎ, নাইন ইলেভেন ঘটনার দুই দশক পূর্তির আগেই আফগান ভূমি থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি বছরের পহেলা মে থেকে সেনা প্রত্যাহার কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হওয়ার সুযোগে তালেবান বাহিনী ইতোমধ্যেই দেশটির এক তৃতীয়াংশ নিজেদের দখলে নিয়ে ফেলেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তালেবানরা বিভিন্ন প্রদেশের রাজধানীগুলোকে টার্গেট করে এগোচ্ছে, যেনো বিদেশী সেনা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই পুরো দেশ নিজেদের দখলে নিতে পারে।
এদিকে আফগান সরকার প্রথমে ঘোষণা দিয়েছিলো দেশটির সরকারি সামরিক বাহিনী তালেবানীদের রুখতে যথেষ্ট। কিন্তু কার্যত তার প্রমাণ মেলেনি বরং উল্টো ঘটনাই ঘটতে দেখা গেছে। তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধে না পেরে সহস্রাধিক আফগান সেনা পার্শ্ববর্তী দেশ তাজিকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছে। তাজিক কর্মকর্তারা বলছেন, জীবন বাঁচাতেই আফগান সেনারা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। আরেক প্রতিবেশী দেশ উজবেকিস্তানেও কিছু সংখ্যক সেনা পালিয়েছে। এসব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আফগান সরকার স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা তালেবানের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে।
'কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস'-এর তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানে বর্তমানে পঞ্চান্ন থেকে পঁচাশি হাজার তালেবান যোদ্ধা সক্রিয় রয়েছে। পশ্চিমা ন্যাটো বাহিনীর প্রায় চৌদ্দ বছরের 'অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম' এর পরও তালেবানীদের এমন সক্রিয়তা সত্যিই চিন্তনীয় বিষয়। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের সময় থেকে অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম আফগান সামরিক বাহিনী পেয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে তালেবান বাহিনী যেভাবে আফগান বাহিনীকে দেশ ছাড়া করছে, তাতে সন্দেহ নেই যে তারা মার্কিনীদের দেয়া সেসব অত্যাধুনিক সরঞ্জামের উত্তরাধিকার হচ্ছে, যেটা আরও চিন্তনীয় বিষয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফোর্বস ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে, জ্বালানির ব্যবস্থা করতে পারলে তালেবান বাহিনী এসব সামরিক যান দিয়ে বড় ধরনের ভ্রাম্যমাণ লড়াইয়ের বাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হবে।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০০১ সালের তুলনায় বর্তমানে তালেবান বাহিনী আরও কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী হয়েছে। এই ধারণায় কোনো সন্দেহ নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের তথ্য মতে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তালেবানীদের হাতে ৬,০০০ মার্কিন সেনা সহ ১,১০০ ন্যাটো সেনা, ৭৩,০০০ আফগান সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং কমপক্ষে ৪৬,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যানের বিপরীতে তালেবান বাহিনীর ১০,০০০ বা এর চেয়ে কিছু বেশি সদস্য নিহত হয়েছে। দুই দশকের গেরিলা যুদ্ধে তালেবান বাহিনী পশ্চিমাদের বিপরীতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে তা এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়। এছাড়া পশ্চিমা বাহিনীর পুরোদস্ত তৎপরতার মাঝেও তালেবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের প্রায় উনিশ শতাংশ দখল করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো ২০২১ সালের প্রারম্ভ পর্যন্ত, যা এখন ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। ন্যাটো বাহিনীর কড়া নজরদারি এবং জাতিসংঘের অবরোধ সত্ত্বেও তালেবান বাহিনী পপি চাষ, মাইনিং, মাদক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের অর্থায়ন সচল রাখতে পেরেছে।
জাতিসংঘের এক রিপোর্টে দেখানো হয় ২০১৮ সালে মাদক বাণিজ্যের মাধ্যমে তালেবানদের আয় হয়েছিলো ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বোঝাই যাচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানের খুঁটি কতটা শক্ত। আর শুধু আফগানিস্তানই নয়; ধারণা করা হয় তালেবানের আরেকটি শাখা পাকিস্তানেও সক্রিয় আছে, যা পাকিস্থানী তালেবান নামে অধিক পরিচিত। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল উভয় দেশের তালেবানীদের কল্যাণে সন্ত্রাসবাদের "অভয়াশ্রম"-এ পরিণত হয়েছে।
এমতাবস্থায় বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যে তালেবান বাহিনী পুরো আফগানের দখল নিয়ে বসবে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তালেবানের ব্যাপারে আফগানী জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? তারা কি আবারও তালেবান শাসনকে স্বাগত জানাবে? এখানে স্বাগত জানানোর প্রশ্ন আসার কারণ, ১৯৯৬ সালে যখন তালেবান প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন সোভিয়েত অভিযান এবং সেই থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত, অতিষ্ট জনসাধারণ তালেবান সরকারকে স্বাগতই জানিয়েছিলো। কিন্তু সে সময়ের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের তালেবান শাসনে ইসলামী মৌলবাদী বেশ কিছু নিয়ম কানুন জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। যেমন- নারী শিক্ষা প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়, নারীদের বাধ্যতামূলক পর্দার বিধান রাখাসহ আরও বেশ কিছু নিয়ম কানুন, যা জাতিসংঘের দৃষ্টিতে ছিলো মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সে সময় পশ্চিমা বিশ্বসহ অধিকাংশ দেশ আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের বিরোধিতা করেছিলো। আর ওসামা বিন লাদেন ও তার দল আল-কায়েদাকে সমর্থন দিয়ে সেই বিরোধিতার আগুনে ঘি ঢেলেছিলো তালেবান সরকার নিজেই। ফলাফল, আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযান। তবে ২০০১ সালে মার্কিন অভিযানে তালেবান সরকার উৎখাত হওয়ার মাধ্যমে বিগত দুই দশকে আফগান জাতীয় জীবনে নারীদের সম্পৃক্ততা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে নারী শিক্ষার হারও। সুতরাং, এই মুহূর্তে যদি তালেবান বাহিনী আবারও ক্ষমতায় এসে পূর্বের ন্যায় মৌলবাদী নীতি জনগণের উপর চাপিয়ে দেয় তাহলে কি জনসাধারণ তা মেনে নেবে? এ এক জটিল প্রশ্ন!
শুরুতে আফগানী জনগণ বিশেষ করে পশতুন জাতিগোষ্ঠী মার্কিন অভিযানের তীব্র বিরোধিতা এবং তালেবান গোষ্ঠীর জন্য সহমর্মিতা জ্ঞাপন করলেও ধীরে ধীরে বর্তমানে সেই অবস্থায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এশিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০০৯ সালে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ তালেবান বাহিনীর প্রতি সহমর্মিতা দেখালেও ২০১৯ সালে দেখা যায়, মাত্র সাড়ে তের শতাংশ জনগণের তালেবানদের উপর সহমর্মিতা রয়েছে। অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই এখন তালেবানীদের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে জটিল সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র কাবুলে এক হাজার সেনা রাখতে চায়। তুরস্কও তার সব সেনা প্রত্যাহার করবে না এমন ঘোষণা পূর্বেই দিয়েছে। কিন্তু তালেবান তার অবস্থানে অনড়। তারা চায় আফগান ভূমি থেকে সকল বিদেশী সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে দোহা চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটুক।
সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দিন দিন যে জটিলতর হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। চুক্তি অনুযায়ী যদিও তালেবান অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে তারা আল-কায়েদা, আইএসআইএস কিংবা অন্য কোনো ধরণের সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না ভবিষ্যতে, তথাপি জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে আল-কায়েদার সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ এখনও অব্যাহত আছে। এছাড়া এ অঞ্চলে আইএসআইএস খোরাসান শাখারও তৎপরতা রয়েছে। সুতরাং তালেবান গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া তার অঙ্গীকার যথাযথভাবে পালন করবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
মোটকথা সম্পূর্ণরূপে বিদেশী সেনা প্রত্যাহারে ন্যাটোর অবস্থান, আল-কায়েদা এবং আইএসআইএসের মত সন্ত্রাসী দলগুলোর তৎপরতা, সেই সঙ্গে তালেবানের প্রতি বর্তমান আফগানী জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এসব কিছুর প্রেক্ষিতে তালেবানের প্রতিক্রিয়া আফগান ভূমিতে অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়ার জোর সম্ভবনা রাখে। আফগানী সামরিক বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ভিনদেশে পালিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা মূলত তারই প্রমাণ। তাছাড়া তালেবানী আগ্রসনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষা করা যায় না। ইউরোপ ইতোমধ্যেই আফগানী অভিবাসীর ছোটখাটো ঢলের সম্মুখীন হয়েছে। সহিংসতা বাড়লে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এরূপ ঢলের সম্মুখীন হবে। আর সেই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি তো থাকবেই।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ইমেইল: [email protected]
আরও পড়ুন: