বাংলাদেশ সগৌরবেই টিকে আছে
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে আর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজে নিজে বিশ্লেষণ করে আমাদের বাবা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, দেশে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। আর গৃহযুদ্ধ মানে হচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ প্রতিপক্ষের আক্রমণ, অনির্ধারিতকাল ঘরে অবরুদ্ধ থাকা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট ইত্যাদি। এসব ভেবে তিনি চাল, ডাল, লবণ, চিনি, গুড়, চা-পাতা, সরষের তেল, কেরোসিন তেল, দেশলাই, মোমবাতি, পেঁয়াজ, আলু, শুকনো লঙ্কা, আটা, জ্বালানী কাঠ, নোভালজিন, সিবাজল এমনসব সংরক্ষণযোগ্য প্রয়োজনীয় জিনিস ঘরে মজুত করলেন – যাতে গৃহযুদ্ধ বাঁধলে অবরুদ্ধ সময় সামাল দেয়া যায়। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে যখন ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ অঞ্চল টের পেলো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখনও প্রায় কেউই বুঝে উঠতে পারেননি সেই যুদ্ধটার ভয়াবহতাটা কী মাত্রার।
আমাদের পাড়ার ঠিক বাইরের বড় রাস্তায় শহীদুল্লাহ্ মামা, মুজিবর মামা, নবী হোসেন ভাইদের মতো তরুণ-যুবকরা গাছ কেটে ফেলে, ঠেলাগাড়ি-ইট-বালি দিয়ে অবরোধ তৈরি করেছিলেন। ২৭শে মার্চ সকালে পাকিস্তানী বাহিনী যখন আসলো, তখন তারা পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। অবরোধ দেখে তারা গোলা ছুঁড়লো, রাস্তার সামনের দিকে আর দু'পাশে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু করলো। প্রতিরোধকারীদের প্রতিরোধ খুব অল্প সময় টিকতে পেরেছিল। পাকিস্তানীরা তখন রাস্তার দুপাশে লোকালয়ে ঢুকে পড়লো। চাকা লাগানো ড্রামে কেরোসিন তেল বিক্রি করা ওমর আলী, রাস্তার পাশের মাটিকাটা শ্রমিকেরা প্রথম ধাক্কায় শহীদ হলেন। তারপরে ঘরে ঢুকে ঢুকে হত্যার উৎসব শুরু হলো। সেদিনের প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৫৪ জন।
২৭শে মার্চের সকালের আক্রমণের সময় আমাদের পরিবারের সদস্যরা প্রাণ বাঁচাতে এক বস্ত্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তখন গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে আমাদের বাবার প্রস্তুতি কোন কাজে আসেনি, পরে সেসব রাজাকারদের ভোগে গেছে। তার পরের নয়টি মাস কেমন গেছে সেটা সারা বাংলাদেশ জানে, কিছুটা বাকি দুনিয়াও জানে। প্রাণ বাঁচাতে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে যারা জিঞ্জিরা-কেরাণীগঞ্জ-নবাবগঞ্জের দিকে গিয়েছিলেন তাঁদের কথা পরবর্তীতে নানা জনে নানা জায়গায় অল্প স্বল্প লিখেছেন। ঐ দলে আমাদের পরিবারও ছিল। তাদেরকে কখনো খোলা মাঠে, কখনো খড়ের গাদায়, কখনো কারো বাড়ির উঠোনে এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে, লঙ্গরখানার পাতলা খিচুড়ি খেতে পেলে সেটাকে সৌভাগ্য বলে মানতে হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হাতে গোনা অল্প কিছু পরিবার ছাড়া গোটা দেশের দেড়-দুই কোটি পরিবার আমাদের পরিবারের মতো বা তারচেয়ে বহু বহু গুণে বেশি এবং অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন। চোখের সামনে প্রিয়জনকে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন, খুন হতে দেখেছেন। নির্মম শারিরীক অত্যাচারের শিকার হওয়া, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া, সম্পদ হারানো, লুটের শিকার হওয়া নিত্যদিনকার ঘটনা ছিল। এইসব দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও দেশের মানুষ একটা বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন – বিজয় আমাদের হবেই। ভারত এখনো কেন স্বীকৃতি দিলো না, চীন ভেটো দিলো, আমেরিকা নাকি যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে, আবারও বিমান হামলা শুরু হলো – এসব বিষয় নিয়ে তাঁরা উৎকণ্ঠিত থাকতেন, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন; তবু জয়ের ব্যাপারে আশা হারাতেন না। তাঁরা ভাবতেন সময়টা কি পাঁচ বছর লাগবে নাকি আরও বেশি!
দেশের সাধারণ মানুষের মনের এই জোর কোথা থেকে এসেছিল? আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত এক লাখের অধিক প্রশিক্ষিত সেনার বিরুদ্ধে প্রায় প্রশিক্ষণবিহীন, অতি অল্প ও পুরনো ধাঁচের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনী জয় লাভ করবে এই বিশ্বাসের ভিত্তি কী ছিল? এর উত্তরটা খুব সংক্ষিপ্ত; কারণ ওটি যুদ্ধ ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ ছিল। নিকট ইতিহাসে তাঁরা দেখেছেন পরাশক্তি হয়েও ফরাসীদেরকে ভিয়েতনামে বা আলজেরিয়ায় পরাজয় বরণ করতে হয়েছে, কারণ সেসব জায়গায় তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তান তো পরাশক্তি নয়। তার বেস ১,৩০০ মাইল দূরে, মাঝখানে তার শত্রুদেশ ভারত, সাপ্লাই চেইন মোটামুটি কাটা; মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে তাদের পরাজয় তো অবধারিত। গৃহস্থের গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগী কেড়ে খাওয়া বা ব্যাপক ধর্ষণে মনোযোগী হওয়া সেনা দলের এবং মদের নেশায় চুর হয়ে থাকা সেনা নেতৃত্বের একটি যুদ্ধ জয়ের নৈতিক জোর থাকে না। যারা এই স্বপ্নে বিভোর থাকে হিমালয় ডিঙিয়ে চীন আর বঙ্গপোসাগর ডিঙিয়ে আমেরিকা এসে তাদেরকে উদ্ধার করে দিয়ে যাবে, যুদ্ধে তাদের জয় হতে পারে না। এসব কারণে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জন্ম নেওয়া তাদের শিশুগুলোকে বাইরের মানুষের সামনে খোকা-খুকু-আবু-বাবু নামে ডাকলেও ভেতরে ভেতরে তাদের নাম আসলে রেখেছিলেন স্বাধীন-বিপ্লব-মুজিব-মুক্তি! যথাসময়ে সেই নামগুলো প্রকাশিত হয়েছে।
খুব যৌক্তিকভাবেই ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। ভারতীয় সহযোগিতা না পেলে অথবা পরাশক্তিরা যুদ্ধটিতে জড়িয়ে গেলে বিজয়টা পেতে হয়তো আরো কিছু বেশি সময় লাগতো, তবে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত ছিল।
এর পরে বহু পণ্ডিত, জ্ঞানী, বিশ্লেষক নানান ভাবে হিসাব নিকাশ করে বার বার দেখিয়েছেন-
বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না, এটি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ টিকতে পারবে না, এটি পাকিস্তানের সঙ্গে পুনরেকত্রিত হবার জন্য মিনতি করবে।
বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষে প্রতি বছর লাখে লাখে মানুষ বাংলাদেশে না খেয়ে মরবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ, শেষ পর্যন্ত এটি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পরে দেখা যাচ্ছে, এসবের কিছুই সত্যি হয়নি। বরং পরনির্ভর পাকিস্তানের তুলনায় স্বনির্ভর বাংলাদেশ আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিছু কিছু সূচকে বাংলাদেশ এমনকি ভারতের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় চলে এসেছে। কৃষিতে জাদুকরী বিপ্লব দেখিয়ে খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে, শিক্ষায়, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, স্বাস্থ্য খাতে দর্শনীয় উন্নতি করেছে। মিলিয়ন মিলিয়ন বাংলাদেশি কাজ করার জন্য বা পড়াশোনার জন্য সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন, শরণার্থী শিবিরে থাকার জন্য নয়।
এখনো আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে পারিনি বটে, কিন্তু আমাদের সেসব অর্জনের ইচ্ছা আছে, সাহস আছে, চেষ্টাও আছে। সর্বোপরি আমাদের এই আস্থা আছে, আমরা দুনিয়ার বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকব।