এই সংহতিটা যদি ‘কাজের’ সময় তাঁরা শিক্ষার্থীদের সাথে বোধ করতেন!
সাইবার পর্যালোচনা করলে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে ৩৪ বা ৩৫ জন উপাচার্য একযোগে পদত্যাগের হুমকিটা আসলে দিয়েছেন কি না। সম্ভবত গুজবই। কিন্তু এই খবরটা চাউর হবার পর নেটিজেনদের যে প্রতিক্রিয়াগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তা একেবারেই জ্যান্ত। মেলা লোকজন খুশি হয়েছেন। সাইবারের ভাষায় যাকে ট্রল করা বলা হয়, তা অজস্র পাওয়া গেছে। লোকজনের এই খুশিকে আমরা কীভাবে দেখতে পারি? কেন এত লোক উপাচার্যদের 'বিদায় ঘোষণাতে' এত খুশি হচ্ছেন? এমনকি তেমন বাস্তবসম্মত কোনো কথা নয়, তাও ভেবে মনের শান্তি নিচ্ছেন কেন লোকজন? কেবল উপাচার্যদের পদের প্রতি ঈর্ষাবশত এই অভিব্যক্তি হওয়া কি সম্ভব?
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য যখন শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতা ছিলেন তখন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন পদমর্যাদা নিয়ে অসন্তোষ-আন্দোলন চলছিল। তিনি পদাধিকার বলেই ছিলেন সেই আন্দোলনের কাণ্ডারীর জায়গায়। ওই সময়ে আমি একটা রচনা কোনো একটা দৈনিকে লিখেছিলাম 'পদমর্যাদা ও বেতনকাঠামোরও বাইরে' শিরোনামে। পত্রিকাগুলোতে লেখা ছাপানো, আর তার পাঠক পাওয়া গুরুতর একটা অর্জন বটে বর্তমানে। আমার রচনাটার গীত গাইতে কথাটি তুলিনি। লেখাটিতে আমি গুরুত্ব দিয়েছিলাম এই প্রসঙ্গে যে, এভাবে আমলা ও মন্ত্রীদের সাথে পদমর্যাদার কুস্তি লড়ে, অথচ নিবিড় ও লাগাতারভাবে হাত কচলে, পরিশেষে যাহাই তাঁরা এনে দিন না কেন তা হতে যাচ্ছে শিক্ষকদের জন্য মারাত্মক অবমাননার। বাংলাদেশের শিক্ষা পরিষেবা গ্রহণকারী লোকজন এখন জানেন সেই ভবিষ্যদ্বাণী কী নির্মমভাবে সত্য হয়েছে। একজন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদকে এই পুরা বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করার মতো অবিবেচক লোক আমি নই। কিন্তু যে পাটাতনটা তিনি ও তাঁর অনুসারীরা বানিয়েছেন সেটাকে উপেক্ষা করারও উপায় নেই।
এটা মোটামুটি এখন একটা সাধারণ বাস্তবতা। উপাচার্য ও প্রশাসক-শিক্ষকদের সাথে ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষতার সম্পর্ক। এটা টের পাবার জন্য আলাদা করে কোনো ক্যাম্পাসে গিয়ে আপনার গবেষণা করতে হবে না; কোনো গুরুতর অনুসন্ধানী সংবাদ সংগ্রহ কার্যক্রমেরও দরকার পড়বে না। এটা কেন হচ্ছে তা বুঝবার জন্য আসলে উপাচার্য ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকদের সাথে 'অসাধারণ' শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের দিকে নজর দিতে হবে। আর কোনো সরল রাস্তা নেই। প্রতিটা ক্যাম্পাসেই গুণ্ডাবৃত্তির একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়ে আছে, প্রতিনিয়ত পুনর্গঠিত হচ্ছে। এই গুণ্ডাগোষ্ঠীটার নাম যাই দেন না কেন, সরকারী ছাত্র সংগঠনের নামে চললেও, গোষ্ঠীটা প্রতি ক্যাম্পাসে অনন্য ও কাস্টমাইজড। ভবন নির্মাণের ঠিকাদারী থেকে ঠিকাদারদের কাছ থেকে বখরা আদায়, রিকশাওয়ালার ভাড়া মেরে খাওয়া থেকে ক্যান্টিনের খাবার মেরে খাওয়া, বাইকে গোঁ গোঁ করে ঘুরে বেড়ানো থেকে অপছন্দের লোকজনকে চড় থাপ্পড় মারা, ক্যাম্পাসে দোকানদার বসানো থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের আশপাশের জমির দালালী – যদি আমরা জব ডেস্ক্রিপশন ভাবি, তাহলে অবশ্যই অনেকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। সকলেরই ছত্রছায়া এক হতে পারে; সকলের স্বার্থ যে সাংঘর্ষিক তা বোঝাও জরুরি। এর থেকেও জরুরি এটা মনে রাখা যে উপাচার্য এবং প্রশাসকদের এই বর্গের সাথে সম্পর্ক মাখনের মতো নরম।
একজন বেচারা উপাচার্যের ঘুষপ্রদানের ঘটনাটা গোয়েন্দা ও সাংবাদিকেরা এমন মাত্রাতিরিক্ত সম্প্রচার করে ফেলেছিলেন, কিংবা আরেক বেচারা উপাচার্যের নৃত্যদৃশ্য, যে প্রকট বাস্তব প্রশাসনিক পরিস্থিতি আড়াল হয়ে থাকার সুযোগ পেয়ে গেছে। সেই গোয়েন্দাদের অবস্থা আমার জানা নেই। কিন্তু সরকারী সংগঠনের 'হুইসল ব্লোয়ার' যে কোণঠাসা হয়ে আছেন, তার থেকেই আমরা পুরা ব্যবস্থাটার দুরাবস্থা সম্বন্ধে বুঝতে পারি। কেন উপাচার্যদের কথায় কথায় পুলিশ ডাকতে হয়, গ্রেপ্তার করাতে হয় মধ্যরাতে, কিংবা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ সংলাপমূলক কাজকর্মের মধ্যেই গুণ্ডারা এসে জবরদখল নিয়ে নেন সেসব নিয়ে ভাবতে বসলে আমাদের খুব কঠিন কোনো ফয়সালায় পৌঁছাতে হবে না। সর্ষের মধ্যেই ভূত! ঠিক যেসব কারণে এই লোকগুলোর নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে, সেসব কারণের মধ্যেই এই প্রশাসনিক বিপর্যয় লুকিয়ে আছে।
শাবিপ্রবিতে যেখান থেকে বর্তমান সঙ্কটের সূচনা সেটার দিকে মনোযোগ দিই চলুন। বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে তিনি তাঁর 'স্বাভাবিক' প্রশাসনিক গলাতেই কথা বলেছেন, এবং কণ্ঠগ্রহীতা ছাত্রী এটাকে অতিরঞ্জিত করেছেন, তাহলেও এই প্রশ্ন করা যায় মোটের উপর হল প্রশাসনে সাম্প্রতিক কালে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের পাবলিক-কম্যুনিকেশনের হাল কী! আচ্ছা, এটা যদি কঠিন প্রশ্ন হয়, অন্য প্রশ্ন করি। বাচ্চাকাচ্চা সন্তানাদি দিয়ে উদাহরণ দেয়া আমার খুব পছন্দের রাস্তা নয়। কিন্তু সহজ ও নিরুপায় রাস্তা হিসাবে সামনে আনছি এখন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও গুরুতর পদপ্রশাসকদের বাচ্চাকাচ্চারা কি হলে থাকেন? সাম্প্রতিক বাংলাদেশে দেশে পড়েন? পড়লেও কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন? পাবলিকে পড়লেও কি হলে থাকেন? হলে থাকবার উৎসাহ দেন তাঁদের অভিভাবকেরা? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেও হবে না আপনাদের।
কিন্তু কেন এসব প্রশাসকদের নিজেদের বাচ্চাদের জন্য এই আবাসন ব্যবস্থাকে আকর্ষণীয় ভাবতে পারেন না? এমনকি গ্রহণযোগ্যও ভাবেন না? কেবল ঘর ছোট বলে? তিনটা বা চারটা খাট থাকে বলে? কেবল রাত্রিবেলা বাসার খাবার খেতে পারবে না এই মায়ার টানে? এসব প্রশাসকের 'পিতৃমাতৃচেতনা' উৎকৃষ্ট বলে? কেন তা হবে? তাঁরাই তো ক্লাসে 'দশে মিলে করি কাজ'-এর জয়গান গেয়েছেন। উৎসবে মাথায় তাজ পরে ঢোলক-পালক দিয়ে হেঁটে এসে যৌথতার গুরুত্ব শিখিয়েছেন। সাবলম্বী হবার জন্য 'হল জীবনের' তাৎপর্য নিয়ে রচনা লিখেছেন। এসব ভুজুংভাজুং তো শিক্ষকেরা কম করেন না! তাঁরা নিজেরাও জানেন, নিজ-মালিকানাধীন বাচ্চাদের হলে রাখতে না-চাইবার কারণ এগুলো নয়। দুটো স্পষ্ট কারণ তাঁরা জানেন। মুখে না বললেও অন্তরাত্মা জানে। এক হলো হলগুলোতে গুণ্ডাদের প্রাদুর্ভাব। লিঙ্গভেদে হলের গুণ্ডাগিরি কিছু ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তাঁরা জানেন। দুই হচ্ছে তাঁরা আসলে জানেন বর্তমানের হল প্রশাসকেরা কী বস্তু। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বুক-আগলে দেয়া প্রভোস্টের গল্প করতে-করতে চোখে দেশাত্মবোধক পানি আনা এক জিনিস; আর এখন সাধারণ আলাপে হলের সাধারণ ছেলে-মেয়েদের চোখের পানি টেনে আনা সম্পূর্ণ আরেক জিনিস।
আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, বিশ্লেষণ ছাড়া অভিজ্ঞতা দিয়েও বলতে পারি যে আসলে হলগুলো গড়ে কীভাবে পরিচালিত হয়। আমার এটা বলতেও মুখে বা কর্তব্যবোধে বাধবে না যে শিক্ষকদের বড় একটা অংশের যোগাযোগপ্রণালী অতিশয় খারাপ। এত খারাপ যে, শিক্ষার্থীর বাপের বড় নাম বা খান্দান অথবা গুণ্ডাগার্দির পরিচয় না পেলে কী বলবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। আর পরিচয় পেলে যেটা করেন তার আরেক বাংলা নাম ভ্যালভ্যালামি। সমস্যাটা আরো তীব্র সেসব প্রশাসকের জন্য যাঁরা এই প্রকট দলাদলির মধ্যেও একজন শিক্ষার্থী-বৎসল হিসাবে কাজ করতে যান। স্বাধীনতা দিবসের ভোজনে অপেক্ষাকৃত বড় মুরগির টুকরা দেবার কারণে প্রভোস্ট কমিটির সভাতে তিরস্কৃত হয়েছেন এমন প্রভোস্টও আমাদের চাকুরিজীবনে দেখেছি।
উপাচার্যবৃন্দ সভা যে সেটা তাঁদের পেশাগত নিষ্ঠারই পরিচয় দিয়েছে। একজন উপাচার্য যখন কঠোর সময় পার করছেন তখন তাঁকে সহায়তা বা সংহতির বার্তা পৌঁছানো জরুরি। কিন্তু আরো জরুরি ছিল তাঁদের স্বীয় স্বীয় নিয়োগ প্রক্রিয়াটা স্মরণ করা। ক্যাম্পাসে কোন কোন অংশীদারদের সাথে তাঁদের দহরম-মহরম সেটা খতিয়ে দেখার সুযোগ ছিল। সুযোগ ছিল কলিগকে বলা, কামান দাগিয়ে প্রশাসন চালানো বোধহয় সেরা উপাচার্যগিরি নয়। হোন তাঁরা উৎকট আনুগত্যের কারণে নিয়োজিত পদধারী। কিন্তু বিপদে কিছু আত্ম-পর্যালোচনার সুযোগ না নিয়ে তাঁরা ক্ষতি করছেন আরো।
শুনেছি উপাচার্যবৃন্দ দাবি করেছেন, উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ এই আন্দোলন। জ্বি, আমাদেরও মনে হয় যে উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে গুরুতর ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু হলবাসী দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই ষড়যন্ত্র করছেন এটা মানা অসম্ভব আমাদের পক্ষে। আমাদের বরং মনে হয়, বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ে দৌড়ে চেয়ার-টেকানো, মন্ত্রণালয় দৌড়ে 'ব্যক্তিগত' 'রিসার্চ ফান্ড' আর 'উন্নয়ন বাজেট' বরাদ্দগ্রহণকারী, বৈদেশ সফরের টিকেটের জন্য মুখ আকাশে তুলে-রাখা, ক্যাম্পাস গুণ্ডাদের দেখলেই বাবা-বাছা করতে-থাকা, ক্লাস চলাকালীন বাইকের গর্জন বন্ধ করতে অপারগ নাদান-লোভী এই প্রশাসকেরা বরং ষড়যন্ত্র করছেন। বুঝতে কোনোই সমস্যা হবার কারণ নেই কারো।
- লেখক: শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগন বিশ্ববিদ্যালয়