ভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্য যমজ বোন
প্রাণ, প্রকৃতি ও ভাষা
অভিন্ন যমজেরা যেমন হয়- একজন চোট পেলে আরেকজন কঁকিয়ে ওঠে। কারো বুকে ব্যথা হলে আরেকজন তড়পায়। ভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্যও তেমনি অভিন্ন যমজ। একজন আরেকজনের সাথে জড়াজড়ি করে, পালককুসুম মেলে বিকশিত করে যোগাযোগের ময়দান। ভাষা তাই কোনোভাবেই একপাক্ষিক, একসূত্রীয় কোনো মাধ্যম নয়। আমাদের কাছে ভাষার একধরনের চলতি দৃশ্যমানতা এর প্রকাশভঙ্গি, বিরাজমানতা এবং পরিসরসমূহ। যতভাবে ভাষা বর্ণিত ও অবর্ণিত হয় তার সব খোলনলচেই অধিপতি ক্ষমতার তাবত বাহাদুরির কড়া শাসনে বন্দি। বনপাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে উজান থেকে ভাটিতে সংসার সাজায় নদী। নদীসংসারের চারধার জুড়ে অববাহিকা থেকে অববাহিকায় সেই নদী ঘিরে নিম্নবর্গের জীবনে তৈরি হয় নদীভাষার এক অবিস্মরণীয় ব্যাকরণ। লুটতরাজ রাষ্ট্র কী উন্নয়নের বাণিজ্যদম্ভ যখন সেই নদীকে ফালি ফালি করে হত্যা করে, গুম করে, দখল করে তখন কিন্তু নদীঅববাহিকার নদীভাষা বদলে যেতে বাধ্য হয়। নদী অববাহিকার আপন ভাষা তখন আর যোগাযোগের আপন 'ঠাহর' হিসেবে বিরাজিত থাকে না। ভাষা এমনই এক নিরন্তর বিকশিত জটিল প্রণালী যেখানে ভাষা টিকে থাকবার শর্ত ও কারিগরিগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাষার এ অনিবার্য ব্যাকরণকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই 'মাতৃভাষার' মায়াকান্না চলে না। সাঁওতালি ভাষায় 'বীর' মানে অরণ্য-জংগল। একটা সময় দেশের উত্তরাঞ্চল জুড়ে গহিন শালঅরণ্য আর সাঁওতাল জনগণের অরণ্য-সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। যে কারণে দিনাজপুর অঞ্চলের অনেক জায়গার নাম বীরগঞ্জ, বিরল, বীরটোলা, শারশা বীর। উল্লিখিত স্থাননামে 'বীর' শব্দটি থাকলেও শালবন ও সাঁওতালি সভ্যতা এখান থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এই নিদারুণ অরণ্যহীনতা এ অঞ্চলের সাঁওতালি ভাষায় কোনো স্থাননামের ক্ষেত্রে আর কোনোদিনও 'বীর' শব্দটি ব্যবহৃত হবে না। দিনাজপুরের বীরগঞ্জের একটি সাঁওতাল গ্রামের নাম ছিল 'রাটেন আতো'। সাঁওতালি ভাষায় রাটেনআতো মানে গভীর অরণ্যের গ্রাম। বহিরাগত বাঙালিরা বনবিনাশ করে সাঁওতাল গ্রামটি দখল করে বর্তমানে এর নাম রেখেছে 'মাটিয়াকুড়া'। চলতি সময়ে সাঁওতালি ভাষায় 'রাটেনআতো' কেবলমাত্র এক বহুদূরের স্মৃতি। নতুন প্রজন্মের সাঁওতালি ভাষায় এ শব্দধারণাটি একেবারেই অপ্রচলিত।
বলা হয় 'ভাষা' যোগাযোগ বহাল রাখে। ভাষা বলতে যদি কেউ কিছু 'অক্ষর' আর কেবলই মুখের বুলিকে বোঝাতে চায় তাহলে আমাদের আজকের আলাপের 'ভাষার' সাথে তার মেলা ফারাক রয়ে যাবে। ভাষা আমাদের চারপাশের প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যকে ধরেই বিরাজিত হয়। মেঘকণা, রোদ্দুর, পাথর, অবিরাম জলরাশি, হাজারো ধানের জাত, পাখি, পতঙ্গ, বাঘ কি কুমির, সাপ ও সরীসৃপ, বৃক্ষগুল্মলতা, মাটি, কেঁচো, মানুষ, ব্যাঙের ছাতা কি উঁইঢিবি প্রাণের এমনতর শতকোটি বিন্যাসই তৈরি করেছে মানুষের ভাষাপরিসর। এটি বিজ্ঞান, একে অস্বীকার করা যায় না; এটি প্রমাণিক দলিল-দস্তাবেজ নিয়েই বিকশিত হয়ে চলে। প্রাণবৈচিত্র্যের এই একটি প্রাণের অদলবদল কি নিরুদ্দেশ সরাসরি ভাষাপরিসরকেই আহত করে। প্রাণবৈচিত্র্যের একটি প্রাণের বিলুপ্তি মানে ভাষা থেকে তার সকল আমেজ ও অস্তিত্ব মুছে যাওয়া।
আমন মওসুমের এক ছোট্ট আকারের ধান 'পিঁপড়ার চোখ'। ধানের খোসায় পিঁপড়ার চোখের মতো কালো বিন্দু আছে বলেই এই ধানের এমন নাম। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণা অঞ্চল এ ধানের আদিবসত। পিঁপড়ার চোখ ধানটি হারিয়ে গেছে। অধিকাংশ সময়ই এসব ঘটনাকে কেবলমাত্র প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, পরিবেশ বিপর্যয়, উৎপাদন জটিলতা, কৃষি ঐতিহ্য এসব দিয়েই ব্যাখা করা হয়। কিন্তু একটি ধান হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কোনো ভাষায় ওই ধানসম্পর্কিত রূপকল্প ও শব্দবিন্যাসের যে পরিবর্তন ঘটে আমরা 'ভাষা পরিসরের' আলাপে কখনোই তা দেখতে পাই না। এখন পিঁপড়ার চোখ বলতে ধান নয়, কেবলমাত্র পিঁপড়া নামক এক ক্ষুদে পতঙ্গের চোখকেই আন্দাজ করতে হবে। একটা সময় বাংলাদেশে বিশ হাজার ধান জাত ছিল, এখন তা হাজারখানেকে নেমেছে। তার মানে বাংলাদেশের ধান অভিধান থেকে প্রায় আঠার হাজার শব্দ নিরুদ্দেশ হয়েছে। প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে ভাষার, ভাষার সাথে প্রাণবৈচিত্র্যের এই যে গলাগলি সম্পর্ক আজকের আলাপে আমরা সেটাই তুলতে চাই। পুরুষতান্ত্রিক করপোরেট বিশ্বায়িত দুনিয়ায় প্রাণ ও প্রকৃতি যে ভোগবিলাসী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, ভাষার আপন পরিসরও তাই। তাই ভাষা ও প্রাণের এ বৈচিত্র্য অভিন্ন যমজ বোন। পুরুষতান্ত্রিক বাহাদুরির কবলে রুদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত।
একটি পাখি হারিয়ে গেলে কি হয়?
কোনো এলাকা থেকে একটি পাখি হারিয়ে গেলে ওই এলাকার মানুষের ভাষা থেকেও ওই পাখিটি হারিয়ে যায়। ওই পাখি সম্পর্কিত সকল বিশ্বাস-আচার-রীতি হারিয়ে যায়। এভাবেই একটি ভাষা তার পাখি নিয়ে গড়ে ওঠা শরীরে জখমপ্রাপ্ত হয়। বাহাস উঠতেই পারে আরেকটি নতুন পাখি এসে সেই পাখিটির জায়গা দখল করে যদি। কিন্তু নয়া পাখি কি আগের পাখির অস্তিত্ব ও পরিসর পূরণ করতে পারে? ভাষার আপন অস্তিত্বের জখম সারাতে পারে? আর এভাবেই দেখা যায় দেশজুড়ে প্রাণবৈচিত্র্যের নৃশংস নিরুদ্দেশ আমাদের আপন ভাষা পরিসরকে বারবার উল্টেপাল্টে দিচ্ছে।
একটা সময় দেশের বর্ষারণ্য, শালবনসহ গ্রামীণ অরণ্যে বনরুই নামে এক প্রাণি ছিল। প্রাণিটির নিদারুণ বিলুপ্তি দেশের অধিকাংশ জাতির ভাষা থেকে এই শব্দ ও বনরুইকেন্দ্রিক ধারণাসমূহ হারিয়ে যাচ্ছে। মান্দিদের আঞ্চলিক ভাষায় বনরুই মানে কাওয়াথি এবং কোচ ভাষায় কাওতাই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের মান্দি ও কোচ শিশুদের মাতৃভাষা থেকে শব্দদ্বয় নিদারুণভাবে হারিয়ে গেছে।
আজকের কোচ শিশুরা বুঝবেই না 'ওলামাখরাই' কী? কারণ লজ্জাবতী এই বানরটি প্রায় দুই দশক আগে শালবন থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মান্দিদের নকমান্দি (মান্দিঘর) তৈরীতে ব্যবহৃত হত জেংগেম নামের এক উদ্ভিদ। জেংগেম বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে চলতি মান্দি কুসুকে (ভাষায়) আর এটি ব্যবহৃত হয় না। জেংগেম দিয়ে নকমান্দির বেড়া দেয়া হত, এখন মাটির ঘরই মান্দি এলাকায় বেশী, বা বাঁশ-ছন-টিন-ইট দিয়ে বেড়া দেয়া হয়। আমরা কী বলবো 'বাঁশ-ছন-টিন-ইট' জেংগেমের স্থান পূরণ করে ঐতিহাসিকভাবে মান্দি ভাষাকে শক্তিশালী করছে। আমরা কি বলবো এটি সমাজ রূপান্তরে ভাষার ঐতিহাসিক পরিণতি। আমরা কি একটিবারও জেংগেমের হাহাকারের তলানি দিয়ে টিন-মাটির ঐতিহাসিক ক্ষমতা সম্পর্ককে বিচার করবো না। আমরা কি বারবার টিন-মাটির ভাষাকে বারবার মেনে নিয়ে চিৎকার করে উঠবো 'আদিবাসী সংস্কৃতি বাঁচাতেই হবে', 'মাতৃভাষা রক্ষা করতে হবে'। মি.গারু, খাংখাওয়ি, থারেং, ফংসা জংদবা, নিলি, নাদিল, খিল, থিনারাং, দেমব্রা জাগেদং, সারেংমা রংথাম্বেন এই শব্দগুলো আর মান্দি ভাষায় ব্যবহৃত হয় না। কারণ এগুলো সবগুলোই হাবাহুছাআ (জুম) ফসল, যা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বরেন্দ্র এলাকার সাঁওতালেরা বিশ্বাস করেন, প্রথম বর্ষায় হুদুর (বজ্রপাত) হলে মাটি ফুঁড়ে বেরুয় খাদ্য উপযোগী বুনো মাশরুম 'দামারিওট'। গত ত্রিশ বছর ধরে কমতে কমতে এটি এখন নিরুদ্দেশ। বরেন্দ্র এলাকার সাঁওতালি ভাষা ও মনোজগত থেকেও বিদায় নিয়েছে এটি। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন করপোরেট অক্সিডেন্টাল কোম্পানির মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটে লাউয়াছড়া বর্ষারণ্যে, পুড়ে যায় বনভূমির এক বিশাল অংশ। নিশ্চিহ্ন হয় বর্ষারণ্যের প্রতিবেশ ভারসাম্য। লিবাং, পেইচি বদুক, কেইচি বসুক, মসুয়া ফাই, সকসুমা, আবিথি এই গাছগুলো গ্যাসক্ষেত্রের আগুনে নিশ্চিহ্ন হওয়ায় ত্রিপুরাদের নয়া প্রজন্মের ভাষা থেকে এইসব গাছের নাম উধাও হয়ে যাচ্ছে। ঠিক একইভাবে নয়া প্রজন্মের খাসি ভাষায় আর পরিচিত শব্দ নয় ক্রাপেরদা, ক্রাসেয়া, তিয়ারমেন, ক্রাক্রিং, চিরাসের মতো গাছের নাম।
ভাষার রূপ প্রাণের রূপ
দেশের মঙ্গোলয়েড মহাজাতির অংশ খাসি, মান্দি, ম্রো ও মারমা ভাষায় এক বহুল ব্যবহৃত শব্দ 'চি'। খাসি ভাষায় এর মানে ভাত, মান্দি ভাষায় জল, ম্রো ভাষায় গাছ আর মারমা ভাষায় এর মানে ঔষধ। একই শব্দ, একই উচ্চারণ ব্যঞ্জনা নানান জাতির নানান ভাষায় নানান অর্থ নিয়ে দাঁড়ায়। এটিই ভাষার রূপ, আর ভাষার এই রূপশরীর গড়ে তুলেছে চারদারের প্রাণের অবারিত রূপ-ঐশ্বর্য। সাঁওতালি ভাষায় 'কুল' মানে সিংহ। নয়াপ্রজন্মের সাঁওতালি ভাষায় এখন এটি এক স্বল্প পরিচিতি শব্দ।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের শারশা বীরে জন্ম কবিরাজ ফগা হাঁসদার। যিনি এখনও এক টুকরো সিংহের হাড় নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন পূর্বসুরীদের স্মৃতি হিসেবে। জীবিত সাঁওতাল প্রবীণদের ভাষ্য, দিনাজপুর অঞ্চলের শালবনে একসময় সিংহের বিচরণ ছিল, যা আজ হয়তো এক অবিশ্বাস্য কাহিনির মতো শোনায়। নয়াপ্রজন্মের সাঁওতাল শিশুরা বইপুস্তক, টেলিভিশন, ছবি, দুর্গাপূজার সময় সিংহ দেখেছে কেউ কেউ, কেউ চিড়িয়াখানায়। শেরপুরের ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া শালবনে মারগান কোচ ভাষায় গাছের খোঁড়লে থাকা এক সবুজ ব্যাঙের নাম লুয়া সাকরাং, সাঁওতালি ভাষায় বিষাক্ত এক গাছ-ব্যাঙের নাম কাঠ-রটে। দুঃখজনকভাবে বর্তমান প্রজন্মের মারগান কোচ ও সাঁওতালি ভাষায় এ শব্দ দুটি বহুকাল ধরে অব্যবহৃত। কারণ ব্যাঙ দুটির আর কোনো হদিশ নেই। গাকগিল গাছের বিগিল (ছাল বাকল) থেকে আগে লাল রঙ বের করা হত মান্দি সমাজে। এই লাল রঙ ব্যবহৃত হত কাপড় রাঙাবার কাজে। মান্দিদের সালজং দুবকনিয়া আমুয়াতে (পূজা) লাল টকটকা দো (মুরগী) লাগে, অলিবক আমুয়ায় শাদা রঙের ১ জোড়া কবুতর লাগে। ওয়ান্নার (জুম ফসল তোলার পরের বড় আয়োজনের উৎসব) সময় ঘরদরজায় ওয়ানছি-থক্কার সময় সাদা রঙের ওয়ানছি (জুম ধানের চালের গুড়া পানিতে গুলে তৈরী করা এক পবিত্র প্রলেপ) ব্যবহৃত হয়। এই যে রঙের নানান ধারণা ও ব্যবহার এই সব কিছু মিলেই তো ভাষার পরিসর। এই পরিসর বিপন্ন হয় বারবার রঙের মানে ও ব্যবহার যদি পাল্টে যায় বা নিখোঁজ হয়ে যায়। এই যে ভাষার নানান আমেজ ও বিস্তার, নানান ভঙ্গি ও প্রকাশ। এই সবতো স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যেকে ঘিরেই। স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যই যদি নিরুদ্দেশ আর খুনজখম হয়ে যায় তখন ভাষার আর থাকে কি?
বাহাদুরি বনাম যমজের আহাজারি
ইংরেজিসহ ভাষিক বাহাদুরি প্রতিদিন নিম্নবর্গের ভাষাসমূহকে গলাটিপে হত্যা করছে। পণ্যদুনিয়ার ভাষিক-বাহাদুরিতে দুনিয়ার ৬০০০ এর বেশি ভাষার ৩০০টি মাতৃভাষাও আর টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। প্রতি দু'সপ্তাহে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। গত ১০০ বছরে প্রায় ৪০০০ ভাষা হারিয়ে গেছে। ভাষা পালক মেলে প্রাণের যে বৈচিত্র্য ঘিরে, সেই প্রাণের বিস্তারও আজ করপোরেট উন্নয়ন বাহাদুরির অনিবার্য নিশানা। প্রতিদিন ভাষা ও প্রাণসম্পদ প্রশ্নহীন কায়দায় খুন হচ্ছে, নিরুদ্দেশ হচ্ছে। যখন একজন কড়া কি লালেং আদিবাসী তার জন্মমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়, তখন কিন্তু তার বিকশিত মাতৃভাষাও উচ্ছেদ হয়। ভাষা টিকে থাকার শর্ত ও কারিগরি এখানেই। ভূমি, প্রতিবেশ, উৎপাদন সম্পর্ক, প্রাণবৈচিত্র্যর মতো ভাষা টিকে থাকবার ও বিকশিত হওয়ার শর্তসমূহকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই মাতৃভাষার ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরে বাংলাদেশ হারিয়েছে দেশের অবিস্মরণীয় অরণ্য অঞ্চলগুলো। দেশের ভাষা অভিধান থেকেও আমরা হারিয়েছি অরণ্য-ভাষার ভাষিক-ঐশ্বর্য। ১৯৬২ সনে রাঙামাটির কর্ণফুলী গাঙে যখন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প চালু হল, এক লাখ পাহাড়ি আদিবাসীর পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষাসমূহও দুমড়েমুচড়ে নিরুদ্দেশ হলো। আজ তাই মাতৃভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দাবি তোলা মানেই সকল ক্ষমতা বাহাদুরিকে প্রশ্ন করে ঘুরে দাঁড়ানো। অধিপতি রাষ্ট্র, করপোরেট কোম্পানি, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বহুপাক্ষিক দাতা সংস্থা, ক্ষুদ্রঋণ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ও অসম বাজারব্যবস্থা সকলেই নিম্নবর্গের ভাষিক ময়দান ও প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষা প্রশ্নে এক প্রবল হুমকি।
দেশে অঞ্চলগত ভিন্নতাসহ রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলাও আজ অরক্ষিত, ক্ষতবিক্ষত। বাংলা বাদে দেশের অপরাপর পঁয়তাল্লিশ কি তার কমবেশি আদিবাসী জাতির মাতৃভাষার ময়দান আরো বেশি ঝুঁকি ও নৃশংসতা সহ্য করে টিকে থাকার লড়াই করছে। আদিবাসী ভাষা এবং বর্ণমালার স্বীকৃতি ও সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্র বরাবর উদাসীন। পাশাপাশি বাংলা ভাষাও আদিবাসী ভাষাসমূহের প্রতি জিইয়ে রেখেছে এক তীব্র প্রশ্নহীন ভাষিক-বাহাদুরি। প্রতিনিয়ত আদিবাসী ভাষাসমূহ নির্দয়ভাবে বদলে যাচ্ছে, বদলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। গপ্পা, নাপ্পি, ব্রেংআ, খারি, বিশিভাত, বুকনি, লেবা, আরাক, মেরা, খর, সেঞ্জু, শুনশুনিয়া খিচরি, জাডো, দখলে এসব দেশের বিভিন্ন আদিবাসীদের ভেতর প্রচলিত প্রিয় সব খাবারের নাম। রাষ্ট্রের বাঙালি বাহাদুরির কাছে এসব এখনও পর্যন্ত 'খাবার' হিসেবে স্বীকৃত নয়। নিদারুণভাবে দেশের সর্বত্র হাট-বাজারে, প্রতিষ্ঠান, টার্মিনালে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে এসব খাবার পাওয়া যায় না। কর্মসংস্থান, পড়াশোনা, চিকিৎসা ও নানান কাজে যখন আদিবাসীদের গ্রামের বাইরে যেতে হয় তখন দেশব্যাপী প্রচলিত 'বাাঙালি খাবারেই' দেশের আদিবাসী জনগণকে অভ্যস্থ হতে হয়। খাবারের জাতিগত টান ও আপন খাদ্য-ভাষাকে পিষে থেঁতলে 'বাঙালি খাবারই' এক এক করে দখল করে ফেলছে আদিবাসী খাদ্য ভাষা অভিধান। এ বাহাদুরিকে প্রশ্ন করে দাঁড়ানো জরুরি। যদি আমরা মাতৃভাষার সুরক্ষার প্রশ্নে সজাগ থাকি। মাতৃভাষা বিরাজিত হয় যেসকল আপন খাদ্য-সীমানায় তার সুরক্ষাও সমান জরুরি। আমরা আলাপের প্রথম থেকেই বলছি ভাষা কোনো একপক্ষীয় গোঁজামিলের কায়দাকানুন নয়। এটি জীবনের বিজ্ঞান, যাপিত জীবনের গণিত।
বলা হয়ে থাকে, চর্চাকারীর সংখ্যার উপরে কোনো ভাষা টিকে থাকার শর্ত জড়িত। দেশে কড়া আদিবাসীদের মোট সংখ্যা ১০০। মারগান কোচদের প্রায় ত্রিশটি পরিবার টিকে আছে। লুসাইদের সংখ্যা ৫০০। চাক, খিয়াং ও লালেংদের সংখ্যা পাঁচ হাজারের কম। ভাষা বিজ্ঞানের সূত্র মতে এসব ভাষা কি তাহলে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাবে? যদি একটি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, এসব মানুষও কি দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাবে? হয়তো মানুষ থাকবে, নিজ ভাষা হারিয়ে অন্য কোনো ভাষায় যোগাযোগ করতে বাধ্য হবে। তার মানে শুধু মানুষ বা কোনো জাতি থাকলেই চলে না, তার মাতৃভাষা টিকে থাকার শর্ত ও কারিগরিসমূহও টিকে থাকতে হয়। ভাষা গড়ে ওঠা ও বিকশিত হওয়ার উপাদান সমূহের নিশ্চিত সুরক্ষা না হলে সেই ভাষা অবশ্যই বদলে দুমড়ে অন্য কোনো যোগাযোগ কায়দা হিসেবে অচিন রূপে দাঁড়াবে। দাঁড়াচ্ছেও তাই, প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্র ও ক্ষমতার অধিপতি মারদাঙ্গার ভেতর। ভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্যর যমজ আহাজারি বুঝতে, শুনতে, মানতে, জানতে রাষ্ট্রকে ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। ভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্য এই যমজ বোনদের টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের সভ্যতার ঠিকুজি।
- লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ