‘কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না’
জাতি গঠনের প্রথম শর্তই হচ্ছে- ভাষা। ভাষা দ্বারা জাতি যত সুস্পষ্টভাবে একটি পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে- তা হয়তো পারে না অন্য কিছুতে। সংস্কৃতির সংমিশ্রণ অনেকভাবে ঘটতে পারে, কিন্তু ভাষা সেদিক থেকে নিজস্ব স্বকীয়তায় স্বতন্ত্র। আজকের ইউরোপ নানাভাবে নানা বিষয়ে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, ভৌগলিক প্রবেশাধিকার, চাকরির ক্ষেত্রে কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে তারা এক অনন্য অবস্থান নিয়েছে। এমনকি গ্রেট ব্রিটেনের ভেতরে নেটিভ ওয়েলশরা 'ওয়েলেশ' ভাষায় কথা বলে পাশাপাশি আছে ইংরেজির প্রচলন। আইরিশরা গেইলিক ভাষী ছিলেন, তবে এখন ইংরেজি সবখানেই। বৃটেনে অন্যত্র ইংরেজি উচ্চারণে পার্থক্য রয়েছে।
যেমন স্কটিশরা যে ইংরেজি বলে তার সাথে বৃটিশ ইংরেজির সঙ্গে মিল নেই। উচ্চারণগত ভাবে কিছুটা তারতম্য আছে। আবার লিভারপুলের অংশের মানুষদের মধ্যেও ব্যাপারটা তাই। কিন্তু ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় ভাষার ভিন্নতা প্রবল।
প্রায় প্রতিটি দেশই মাত্র কয়েক কোটি জনসংখ্যা নিয়ে নিজস্ব ভাষায় তাদের জীবন পরিচালনা করছে। শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুতেই তারা নিজ ভাষায ব্যবহার করছে। আয়তনে আমাদের থেকে ছোট ছোট একেকটি দেশ, তারা তাদের সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থা নিজ ভাষায় করে আসছে।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা যারা এই সমাজে নিজেদেরকে অভিভাবক মনে করেন তারা কেউই ভাষার প্রশ্নে একক অবস্থানে আসতে পারেনি। এখনও উচ্চ আদালতের দু-একটি রায় বাংলায় লেখার পর গর্ব করা হয়। কিংবা 'বাংলায় লিখতে হবে' বলে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করতে হয়। তারপরও বাংলা সঠিকভাবে কতটা চালু হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
দেশে তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শহরভিত্তিক যে শিক্ষাব্যবস্থা তা মূলত ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা। অপরদিকে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার বাংলা মাধ্যম গ্রামীণ জনগোষ্ঠীই বেশি গ্রহণ করছে, আবার এই গ্রামীণ জনপদের একটি বিশাল অংশ আরবি ভাষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এই হচ্ছে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ফসল!
আমরা প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করি। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য যারা আত্মহুতি দিয়েছেন তাদের স্মরণ করি। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানিয়ে গর্ব অনুভব করি। শহরের রাজনীতিবিদরা বেশ কিছু বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে থাকেন। রেডিও-টেলিভিশনে ভাষা নিয়ে ইতিহাসের নামে বেশ কিছু গল্প অনুষ্ঠান হয়। যদিও পরের দিন ২২ তারিখ থেকেই আবার ভাষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা আমাদের জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে যায়।
তাহলে এমন বলা যায়, স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরেও 'বাংলা' ভাষা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সাধারণ মানুষের কথা নাহয় বাদই দিলাম, যারা ভাষা নিয়ে কাজ করেন বা ভাষার অধ্যাপক, ভাষা বিজ্ঞানী- তাদেরও কারো জানা নেই বাংলা ভাষায় মোট শব্দ সংখ্যা কয়টি! যদিও বাংলা ভাষায় নানা রকমের শব্দের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই। কিন্তু এই দেশের ভাষাবিদরা আজ পর্যন্ত এই ভাষার সঠিক শব্দ সংখ্যা নিরূপণ করতে পারেননি। এনিয়ে আমাদের কোনো কার্যকর গবেষণা আছে বলেও আমার জানা নেই।
ভাষা কোনো আধিপত্য মানে না। নিজের ভাষার উপর অন্য ভাষা চাপিয়ে দেবার ইতিহাস সুখকর নয়। ভাষার জন্য যেমন আমরা রক্ত দিয়েছি তেমনি পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ইতিহাস কম নয়।
ভাষার অধিকার নিয়ে সবচেয়ে বড় রক্তপাতের ঘটনা ঘটে ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। স্কুল শিশুদের চলা আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। অনেক ছাত্র প্রাণ দেয়। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় ৪৫০ জনের বেশি মানুষ জীবন দেয়। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণার স্মারক হয়ে থাকে স্কুল শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন। ভারতের স্বাধীনতারও ১০ বছর আগে ভারতের তামিলভাষী মানুষ তাদের ভাষার উপর অন্য ভাষার আধিপত্য মেনে নেয়নি। তামিলনাড়ুর মানুষ সেদিন আন্দোলন করে, জীবন দিয়ে সর্বত্র হিন্দি প্রচলনের চেষ্টা রুখে দিয়েছিল। স্বাধীনতা উত্তর কংগ্রেস সরকার আবার চেষ্টা চালায় হিন্দি ভাষা প্রচলনের। মাধ্যমিক শিক্ষায় হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পরিণতিতে কংগ্রেসকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল।
হিন্দি প্রচলনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল কেবল নয়, তারপর থেকে কংগ্রেস আর কখনো তামিলনাড়ুতে সরকারে যেতে পারেনি। তামিলনাড়ুতে ৭০ ভাগ মানুষ তামিলভাষী, কিন্তু পাশাপাশি বাকি ৩০ ভাগ মানুষ আরও ৪টি ভাষায় কথা বলে। সেকারণে তামিল নেতারা সাধারণ ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নেয়। তামিল নেতাদের এই সমঝোতার উদ্যোগ আজও একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
ভারতে এখন ২০টির অধিক ভাষাকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যদিও সেখানে শতাধিক ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে।
ভারতের ১৯৩৭ সালের সেই আন্দোলন আমাদের বাংলাদেশেও সংক্রমিত হয়েছিল। যখন পাকিস্তানের জন্মের পরেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে আবার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভাষা দ্বারা বিভক্ত সমাজ ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি 'সাধারণ ভাষা' ভারতের জন্য যেমন ছিল- হিন্দি, তেমনি পাকিস্তানের জন্য বেছে নেওয়া হয়- উর্দুকে। ভারত-পাকিস্তান উভয় অংশের নেতারা ভেবেছিলেন, একটি সাধারণ ভাষা দিয়ে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। এই তত্ত্বের ভয়ানক পরিণতির কথা জানার পরও পাকিস্তানের নেতৃত্ব কেন একই ভুল করলো- তা নিয়েও গবেষণা হতে পারে। তামিলনাড়ুর আন্দোলন ভারতীয় রাজনীতির মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছে। একইভাবে পূর্ববঙ্গে গড়ে ওঠা মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন বাঙালি জাতির স্বাধীকারের চেতনার বীজ বপন করে। তবে এটাও ইতিহাসেরই চরম সত্য- কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক