বিদ্যা-বন্দনা ও বন্দনার বিদ্যা
সরস্বতী পূজাতে ছোটবেলায় চাঁদা দিতাম না। তখন কেউ আমার কাছে চাঁদা চাইতেনও না। তখন ছিল কেবল অর্ঘ্য আর নৈবেদ্য। বিদ্যাদেবীর প্রতি আমার অবারিত ভক্তি ছিল শিশুকালে। আমার প্রতিও ছিল তার অকাতর স্নেহ। আমার তখন কোনোই সন্দেহ ছিল না যে আমার বিদ্যাবুদ্ধির সকল সম্ভাবনা ও সামর্থ্য কেবল তার ওপরেই ন্যস্ত। আমি তাকে প্রাণভরে ডাকতাম। পূজার দিনে তো বটেই, অন্যান্য দিনেও। বড় হবার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে, দুচার পয়সা চাঁদা দেওয়া লাগত। চাঁদা দেওয়া ছাড়াও বাড়তি কিছু কাজ করেছি দুয়েকবার। সর্বধর্ম জমায়েতে গান গেয়েছি।
আরও পরে বিদ্যার দেবীর সাথে আমার কেবল চাঁদার সম্পর্কই ধার্য হয়। এই বছর ৫ই ফেব্রুয়ারি ছিল পূজা। এবার ইলেকট্রনিক মুদ্রাতেই চাঁদা দেওয়া গেল। পরে আয়োজকদের ফোনে ঠিকঠাকমতো আর উত্তরও করিনি, পাছে শনিবার দিন ক্যাম্পাস যাবার অনুরোধের মুখোমুখি হওয়া লাগে। বিদ্যাদেবী অসন্তুষ্ট হতেন কি না ভাবিনি, আয়োজকবৃন্দ হয়তো মুখের ওপর যাব না বললে মনভার করতেন। অনেকেই জানেন বিদ্যাদেবীর এই বন্দনাকে বাণী-অর্চণা বলা হয়। বিদ্যাদেবী বা আর কারোরই বন্দনা আমার আর পোষায় না।
রবীন্দ্রনাথের 'মুক্তধারা' নাটকে উত্তরকূট রাজ্যের বিদ্যাপ্রণালী মনে পড়ল। এই নাটকটা আমার খুবই পছন্দের। আসলে রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো নাটকই আমার পছন্দের। 'রাজা', 'বসন্ত', 'তাসের দেশ', 'অচলায়তন', 'বিসর্জন', 'মুক্তধারা', আসলে 'রক্তকরবী'ও কিংবা 'চিত্রাঙ্গদা' বা 'বাল্মিকী প্রতিভা'ও। অনেকেই নাটক, গীতিনাট্য আর নৃত্যনাট্য একাকার করার কারণে বিরক্ত হবেন। কিন্তু আজকে কাজ চলবে। মঞ্চে যে অনেক নাটক দেখেছি তা নয়। মঞ্চে যা দেখেছি তা যে আমার খুব ভালো লেগেছে তাও নয়। বস্তুত অধিকাংশ নাট্যনির্মাতা রবীন্দ্রনাথের নাটকের তাফসির যা হাজির করেন তাতে আমার পেট ভরে না। আমার জন্য রবীন্দ্রনাথের নাটক তার শাসনদর্শন বা রাজ্যচিন্তার সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ। এই ভদ্রলোকের রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে গবেষকরা নানান কাজ করেছেন। আলসেমি ডিঙিয়েও কিছু কাজ আমার চোখে পড়েছে। অস্বীকার করব না যে, আমি খুব চমৎকৃত হইনি বেশি কাজে। অথবা আমার চোখে যা পড়েছে সেগুলো ভোঁতাই। যাহোক, এই বিষয়ে দরকার মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা আলাপ অন্য কোথাও অন্য কোনোদিন তোলা যাবে।
উত্তরকূট রাজ্য আর শিবতরাই রাজ্যের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এই নাটকের একটি অন্যতম উৎকণ্ঠার এলাকা। নাটকের অবস্থিতি অবশ্য উত্তরকূট রাজ্যে। তো সেখানকার বিদ্যাপ্রণালীর কথা হচ্ছিল। এক গুরুমশাই গাছতলায় শিশুদের নিয়ে বসে উৎকটভাবে রাজবন্দনা করান, করাতেই থাকেন। উত্তরকূটের রাজাকে বন্দনা করা ছাড়া বস্তুত গুরুমশাই বা শিক্ষকদের আর কোনো কাজ নাই। ওটাই তার ডিফাইন্ড জব ডেস্ক্রিপশন। এর সহজ হিসাবে যা আসে তা হলো- কেন উত্তরকূটবাসীরা শ্রেষ্ঠ, শিবতরাইয়ের থেকে তো বটেই, এমনকি জগৎশ্রেষ্ঠ ধরনের একটা প্রচারণা করাও মাস্টারমশাইয়ের কাজ। রাজা ও শিক্ষকের এই নিবিড় আনুগত্যের বন্ধন রবীন্দ্রনাথ চাঁছাছোলা রঙ্গরস করতে করতে এই নাটক বানিয়েছেন। এটা একটা বেদনাত্মক পরিসমাপ্তির নাটক। 'বিসর্জন'-এও রবীন্দ্রনাথ প্রটাগনিস্টকে অবলোপের মাধ্যমে তার যুক্তি হাজির করেছেন। সেসব আরেক প্রসঙ্গ।
মহামারির কারণে শিশুরা স্কুলে যাচ্ছিল না বলে যারা অতিশয় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তাদের চিন্তার শরিক আমি নই। একটা কারণ তো অবধারিত যে আমি কোনো শিশুর মালিক নই। কিন্তু নিজেকে শিশুদের মালিক হিসাবে রেখেও আমি এই সময়কালে ভাবার চেষ্টা করেছি । খুব গুরুতর কোনো আছর পড়েনি। যে স্কুলগুলোতে বাচ্চারা কোনোমতে হোগলা, ছালা, ভাঙা বেঞ্চে বসে 'দেশের উন্নতি' ঘটাচ্ছেন, সেসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে গুরুতর এমন কী ভাবনা আপনিই বা ভাবতে পারেন? কিংবা যেসব স্কুলের শিক্ষক বেতন পাবার পরও তার দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ আয়ের উৎস খতিয়ে দেখতে হয় তাদের কথা ধরুন; আয়ের ভিন্ন উৎস না হলে তিনি নিজের বাচ্চার স্কুলের পোশাকই কিনতে পারবেন না। কিংবা ধরুন, যেসব স্কুলের বেতনই আটকে আছে, এমপিওভুক্ত নয় বলে; মহামারি-ভর্তুকি যায়নি বলে? আবার যেসব স্কুলের বাচ্চারা বাসায় সারাক্ষণ আইপ্যাড-মোবাইল টেপাটেপি করছেন, অন্য সময়ে টিভি রিমোট, সারাক্ষণ গরিব-বিদ্বেষী আচরণে প্রশিক্ষিত হচ্ছেন, শুনছেন যে গরিবগুলো 'খাসিলতে'র কারণেই কেবল গরিব থাকেন, বাবাকে বাসায় ঢুকেই 'এই কে আছিস' বলতে শুনছেন– সেসব বাচ্চারা স্কুলে গিয়েও বা এর থেকে কী এমন ভিন্ন জিনিস শিখছেন? শিখছেন কী? এখন সমবয়সী একই রকমের কিছু ননীর পুতুলের সঙ্গে মিশতে না-পারার যে বেদনা সেটা কম নয়, আমি মানি। আর সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করতেই পারেন তাদের পিতামাতা। সেই সমবেদনা আমার আছে।
আমার বলার বিষয় সহজই। স্কুলগুলো নানাবিধ। নানাবিধ এগুলোর গড়ন আর সামাজিক বিন্যাস। স্কুল বন্ধ থাকার মায়াকান্না করার সাথে এই রকমফের বিষয়ে সজাগতা প্রকাশ পায় না। এই রকমফের এই রাষ্ট্রের জন্য, এই সমাজের জন্য, এই রাষ্ট্রসমাজের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ সেটা কেউ আলাদা করে না বললে তার বক্তব্য আমার জন্য জরুরি মনে হয় না। এমনকি যদি এই অতিমারীয় পরিস্থিতি নাও আসত, রাষ্ট্রের বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেভাবে স্কুল 'সচল' ছিল সেটাতে এই আহাজারি সমর্থনসূচক লাগে। এই আহাজারি কেবল নিজ-বাচ্চার জন্য 'আনন্দময়' পরিবেশের আকাঙ্ক্ষা আর সচ্ছলতার ঘোষণা বোঝায়। এটি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে না। আরও দুটো বাক্য তাহলে আপনার আগে-পরে বলে নিতে হবে।
অতিমারির আগেও, গত কয়েক বছরে অন্তত কিছু উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। মধ্যবিত্ত মানুষজন, বাচ্চাদের অভিভাবক মানুষজন, শিক্ষা বিষয়ক এজেন্ডা আছে এমন রাজনৈতিক মানুষজন। এদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে নানান ফোরামে; মুখ্যত সাইবার প্রতিক্রিয়াগুলোতে। কিন্তু সেসব উৎকণ্ঠার মধ্যে এই সীমাহীন বৈষম্য ও চালিয়াতিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিক্রিয়া সামান্যই। মূলত, মানুষজন দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের সারবস্তু বা কন্টেন্ট নিয়ে। তাদের সেসব দুশ্চিন্তার সঙ্গত সব কারণ রাষ্ট্রপক্ষ ঘটিয়েছে। সেই অর্থে তাদের দুশ্চিন্তা নিয়ে আমার কটাক্ষ নেই। খুবই দ্রুতগতিতে সহিষ্ণু ও সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার কার্যক্রম অপসারিত হচ্ছে। আমার বক্তব্য এটা নয় যে, আগের শিক্ষা কার্যক্রমের প্রবণতা সমতাধর্মী ছিল। কিন্তু বদলগুলো মারাত্মক ধরনের। তবে যে কারণে আমি এমনকি সেসব দুশ্চিন্তাকারীদের সাথেও খুব এক কাতারে থাকতে পারি না সেটা হলো তাদের মোটের উপর 'স্যেকুলার বনাম ধর্মপন্থী' মডেলের কারণে। যদি সরকার এই কার্ড খেলে থাকেন, যদি বৃহত্তর ধর্মপন্থী শিক্ষাপ্রণেতাগণ এই কার্ড খেলে থাকেন, তাহলে এই কার্ড 'স্যেকুলারপন্থী'রাও খেলছেন। অথবা একদম অজান্তে সেই খেলায় অংশ নিচ্ছেন। আমার এটা আগ্রহ নয়। বরং অজান্তে যদি কেউ কন্টেন্ট বিতর্কে অংশ নিয়ে শিক্ষাকাঠামোর আরও জরুরি বিষয়ে কথা বলতে ভুলে যান, আমার আগ্রহ হবে তাকে সতর্ক করে দেওয়া।
ঠিক যেরকম শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশে চলছিল, এই বিশ্ব-মহামারিরও বহু আগে থেকে, তা নিয়ে হাজার কথা আছে। এখন হঠাৎ নতুন এই বাস্তবতাতে সেসব কথা নাই ধরে নিয়ে বসে থাকা আত্মঘাতী। তবে নতুন ব্যবস্থাটার মাত্রাগত ও গুণগত প্রভাব মারাত্মক। এখানে 'বিশ্বসেরা' বণিকেরা যা-কিছু করে নিতে পারছেন; যেকোনো শর্তে তাদের মুনাফা বাড়াতে পারছেন। বণিকেরা স্বাস্থ্য থেকে চলচ্চিত্র সকল খাতে কিলবিল করছেন। বাস্তবে শিক্ষাতেও তারা জাল বিছিয়েই ছিলেন, করোনা পরিস্থিতি তাদেরকেও নতুন সুবিধা দিয়ে থাকবে। ধরুন, করোনা পরিস্থিতিরও বহু আগে 'জ্ঞানের রাজ্যে' বৈশ্বিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের কথা যদি বাদও দেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রিয়া, চীনের মতো শিক্ষা-ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রও এই প্রকাশনা-বিদ্যা কারখানার কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এসব বণিকের কাছে আমাদের মতো রাষ্ট্রের শাসকেরা ছোটখাটো অফিস কর্মচারি মাত্র। বিশেষত, সেসব রাষ্ট্রের শাসকরা, যেখানে জনবিরোধী অগণতান্ত্রিক কাঠামো ও লুটপাট সাধারণ বিধিব্যবস্থা হয়ে পড়েছে। যেখানকার শাসকেরা সকাল-বিকাল হয় বিভ্রান্ত থাকেন, না হয় নয়া নয়া ফন্দিফিকিরের ঘটকালি করেন। ফলে করোনাতে শিক্ষাকাঠামো বিষয়ে চিন্তিত না হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু কোথায় মনোযোগ দিতে হবে সেটা ভাবা জরুরি।
স্থানীয় পর্যায়েও যদি ভাবি, শিশুরা স্কুলে যাবেন। বর্তমান ব্যবস্থায়, কিংবা বণিকদের তৈরি করা নতুন কোনো ব্যবস্থায়। সেখানে গিয়ে তারা বন্দনামূলক কতগুলো বাণী আবারও আওড়াতে থাকবেন– স্থানীয় মহাপ্রভুর কিংবা বিশ্ব মহাপ্রভুর। আমরা ঠিক সেটাই চাইছি কি না!
- লেখক: শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়