প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্য ঘিরে নারী সমাজের স্বপ্ন দেখার শুরু
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ এর আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে 'পুত্র' বা 'কন্যা'র পরিবর্তে আইনে শুধুমাত্র 'সন্তান' শব্দটি ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাতে করে সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে ভাবার দরকার হবে না। এরকম মানবিক ও নিরপেক্ষ চিন্তা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে।
দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের আলোকে এদেশের নারী সমাজ কিন্তু স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এই স্বপ্ন বাবার অর্জিত সম্পত্তিতে সমান অধিকার পাওয়ার এবং কন্যা সন্তান হিসেবে বাবার সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার ভোগ করার।
সেই পথ ধরেই আজকে নারী দিবসের এই দিনে আমরা কি আবার স্বপ্ন দেখতে পারি না যে নারীর সমানাধিকারের পথ প্রশস্ত হবে, সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বছর নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে "টেকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য।" এরমানে সবক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে, জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে এবং সমাজে প্রচলিত পক্ষপাতমূলক আচরণ, সিদ্ধান্ত, নিয়ম, সংস্কৃতি সব ভেঙে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংরক্ষণের কথা বলেছেন। তিনি এও বলেছেন পিতার অর্জিত সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে যেন শরীয়া আইনের অপব্যবহার করা না হয়। বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন যে, হ্যা আমরা শরীয়া আইন মেনে চলবো, সেই সাথে এমন কোন উপায় বের করতে হবে, যেন ইসলামি আইনের নাম ব্যবহার করে নারীকে কেউ স্বামী ও পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে না পারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে আমরা সবসময় বলছি, দুই সন্তানই যথেষ্ট। সেখানে কারো যদি দুটিই কন্যা সন্তান হয়, তখন সেই পরিবার কী করবেন? কাজেই সবকিছুই বাস্তবতার নিরিখে ভাবতে হবে।
কোন মা-বাবাই তাদের সন্তানের মধ্যে ফারাক করেন না বা করতে চান না। কোন বাবা কি তার মেয়ে সন্তানকে কম ভালবাসেন, নাকি কম যত্ন করেন? আইনে আছে বলে তারা বাধ্য হন এভাবে ভাগ করে দিতে। আজকাল মেয়েরাও বাবা-মায়ের প্রতি অনেক দায়িত্ব পালন করেন। অনেকে পুরো দায়িত্বই পালন করেন। সেক্ষেত্রে এই মেয়ে কি বাবার সম্পত্তিতে সমান ভাগ দাবি করতে পারে না? কিংবা বাবার কি ইচ্ছা করতে পারে না যে তিনি তার এই মেয়েকে নিজের সম্পত্তিতে সমান ভাগ দেবেন?
নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই যে আমরা কাউকে শরীয়া আইন পরিবর্তন করতে বলছি না। কিন্তু সম্পত্তি আইন ধরে এই বিষয়টির নিষ্পত্তি করা সম্ভব। উনি আশ্বাস দিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তিনি নিজেই অনেক ইসলামি চিন্তাবিদের সাথে কথা বলেছেন এবং তারা অনেকেই বিষয়টির প্রতি তাদের সম্মতি জানিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, এর চাইতে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে মনে হলো স্বনামখ্যাত আইনজীবি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর কথা। আমি ওনার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম উত্তরাধিকার আইন নিয়ে এবং সেজন্যই ওনার কথা মনে হলো। ভোরের কাগজে ঐ সাক্ষাতকার গ্রহণকালে আমি মন্ত্রী মহোদয়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "স্যার মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে কেন ছেলেমেয়ের মধ্যে সমানভাবে সম্পত্তি ভাগ করে দেয়ার বিধান কায়েম করেন না? আপনাদের সরকার তো আইনে অনেক ধরণের প্রগতিশীল পরিবর্তন এনেছেন।"
উনি আমার কথার উত্তরে বলেছিলেন, "নানা কারণে আমাদের হাত-পা বাঁধা। তাই চাইলেও সরকার এরকম ইতিবাচক একটি পরিবর্তন আনতে পারবেনা। আমার নিজের এক ছেলে এক মেয়ে। আমি মনেপ্রাণে চাই দু'জনকে সমানভাগে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যেতে। আমি বাবা হিসেবে দু'জনকে সমান ভালবাসি। কিন্তু আমারও হাত পা বাঁধা। পারছি কই উত্তরাধিকার আইনে কোন পরিবর্তন আনতে!" উনি এই কথাগুলো বলেছিলেন সাক্ষাৎকারের বাইরে, অফ দ্য রেকর্ড-এ।
আওয়ামী লীগ সরকার যখন ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল, তখন নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ এর ৭.২ অনুচ্ছেদে বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছিল। ইচ্ছে করলেই হয়তো সরকার একটি আইন পাস করতে পারতো বা নীতি গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু না, তারা তখন সেটা করতে পারেনি। বোঝাই যায় নবনির্বাচিত সরকার হয়তো এত বড় ঝুঁকি নিতে চায়নি।
মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে আসছে। মুসলিম পরিবারে যে বাবা-মায়ের শুধু কন্যা সন্তান রয়েছে, তারা জানেন নিজের আত্মজাকে নিজের সম্পত্তিটুকু দিয়ে যেতে কতটা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। হয় তাদের জীবদ্দশায় হেবা করে দিয়ে যেতে হয় বা উইল করে দিতে বাধ্য হন। যদিও এই পদ্ধতি বাবা মায়ের জন্য বিপদজনক হতে পারে। তাও মানুষ এই পদ্ধতির দিকেই হাঁটছেন, নয়তো কন্যা সন্তান কখনোই আইনত বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির শতভাগের মালিক হতে পারবে না। তার বাবার ভাইয়ের ছেলে সন্তানরা এর থেকে ভাগ পাবেন।
কেন একজন নারী হিসেবে, একজন কন্যা সন্তান হিসেবে এবং একজন কন্যা সন্তানের মা হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এতো কিছু আশা করছি? এর কারণ হচ্ছে উনিই পেরেছেন এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে, যাতে দেশের হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী বাবার সম্পত্তিতে অধিকার পেতে পারেন।
এরকম একটি কথা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটাই বলেছেন এবং করে দেখাতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পত্তি আইন মুসলিম শরীয়া অনুযায়ী চলে। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কোন অধিকার ছিল না।
শুধু সম্পত্তি কেন, এদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী সবসময়, সবক্ষেত্রেই অধিকার বঞ্চিত। এইবার প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এমন একটি আইন প্রণয়নের কথা সরকার ভাবছে, যাতে হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। ২০১৯ সাল থেকে তারা ভোটাধিকারও পেয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে বলছি স্বপ্নার কথা। একটি এনজিওর মাধ্যমে স্বপ্না হিজড়া বিউটি পার্লারের কাজ শিখে আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বাবার অনেক সম্পত্তির একটা কানাকড়িও স্বপ্না পাননি, এই দুঃখ স্বপ্না এখনো ভুলতে পারেন না।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর স্বপ্না হিজড়াকে তার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল ভাইবোনেরা। বলেছিল বাবার সম্পত্তিতে স্বপ্নার কোন অধিকার নেই, কাজেই ওর খাওয়া-পরার খরচ কে দেবে? সহায় সম্বলহীন অসহায় স্বপ্না যেদিন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল, সেদিন ছিল ঈদের দিন। এরকম একটি আনন্দের দিনে ওকে আশ্রয়চ্যুত করা হয়েছিল। স্বপ্না বলেছেন এইবার উনি পরিবারে ফিরে গিয়ে সম্পত্তির ভাগ দাবি করবেন।
ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া ১৯৩৭ সালের মুসলিম পারসোনাল আইন (শরীয়া আইন) পাকিস্তান আমলে এসে পরিবর্তন করা হয়েছে, সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে। যেমন দাদা বা নানার সস্পত্তিতে, নাবালক সন্তানের সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার কার্যকর হয়েছে। এখন চাইলেই কোন মুসলিম একসাথে চারটি বিয়ে করতে পারে না। তাকে নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। হিল্যা বিয়েও অনেক কঠিন করা হয়েছে এবং সর্বোপরি মুসলিম নারী তার স্বামীকে কারণ উল্লেখ করে এবং চার বছর নিরুদ্দেশ থাকলে তালাক দিতে পারেন।
শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য না, দেশে একটি ইউনিফর্ম ফ্যামিলি আইন হওয়া দরকার, সব ধর্মের মানুষের জন্য। বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেই সিভিল ল' আছে, আবার শরীয়া আইনও আছে। যে পরিবার, যেভাবে সুবিধা পাবেন, তারা সেভাবেই সম্পত্তি ভাগ করবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বাংলাদেশের নারীদের সবক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে দিয়েছেন, কাজেই এই কাজটুকু আপনার হাত দিয়েই হোক। আমরা চাই এদেশের মেয়েরা বাবার সম্পত্তির ভাগ ছেলেদের সমান পাক। বাবার অর্জিত সম্পত্তি ছেলে সন্তান না থাকলেও মেয়ে ও স্ত্রীর মধ্যে পুরোটা ভাগ হবে- এটাই এই সময়ে ন্যায্য কাজ হবে, এর মাধ্যমেই জেন্ডার সমতাও প্রতিষ্ঠিত হবে।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন