পাঁচের মধ্যে চারটির ফলাফলে সব সমীকরণ কী করে পাল্টে গেল!
পাঁচের মধ্যে চারটিতেই বইছে গেরুয়া ঝড়। সকল জল্পনা- কল্পনার অবসান ঘটল। নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা, সাত ধাপের নির্বাচন, বুথ ফেরত সমীক্ষা, সব অনুমান পাশে সরিয়ে রেখে অভূতপূর্ব জয়। যোগী আদিত্যনাথ ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশে ৫ বছরের মেয়াদ পুরণের পর দ্বিতীয়বার মূখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন যোগী। এর আগে এমনটি হয়নি। সর্বভারতে কংগ্রেসের হাতে ছিল, রাজস্থান, ছত্তিসগড় ও পাঞ্জাব। এবার পাঞ্জাব হাতছাড়া হলো।
কিশোরী ধর্ষণ। অভিযুক্ত বিধায়ক। রাজ্যজুড়ে তোলপাড়। কোভিড ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতা। নদীর জলে করোনা রোগীর লাশ বিসর্জন। দিল্লির প্রবেশদ্বারে বছরাধিক কাল ধরে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক বিক্ষোভ। লখিমপুরে কৃষক মিছিলে গাড়ি উঠিয়ে কৃষক হত্যা। অভিযুক্ত মন্ত্রীপুত্র। রাজ্যজুড়ে বেকারত্ব। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা। মানুষ এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এবং চমকে উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সিদ্ধান্ত টেনে নিশ্চিন্তবোধ করেছেন। এ দল এবার তো নয়ই, আর কখনো ক্ষমতায় আসতে পারবে না। কিন্তু ফলাফলে সকল সমীকরণ পাল্টে গেল।
কী কারণে এমন সবকিছু পাল্টে গেল তা জানতে আরও একটু সময় হয়তো লাগবে। তবে নির্বাচনী প্রচারাভিযান লক্ষ্য করলে দেখা যায় ক্ষমতাসীনরা সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশলে এবার মাঠে নেমেছে। নানাবিধ কারণে রাজ্যের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে এটা ক্ষমতসীনরা অনুমান করেছিল। রাজ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ক্ষত তখনো দূর হয়নি। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই কৃষি আইন বিরোধী বিক্ষোভ সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলে ক্ষমতাসীনদের।
এছাড়া, লখিমপুরের ঘটনা আরও বেসামাল করে তোলে পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় কৃষি আইন প্রত্যাহারে মোদীর ঘোষণা উত্তরপ্রদেশ সরকারের পায়ের নিচে মাটির সন্ধান এনে দেয়। কৃষি আন্দোলনে মূলত যুক্ত ছিল উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের কৃষক।
ভারতের সর্বাধিক জনবহুল এই রাজ্যের অধিবাসী প্রায় ২০ কোটি। ৪০৩ আসনের বিধানসভা। এখানে ২০ শতাংশ মুসলিম অধিবাসী, যারা সংখ্যায় প্রায় ৪ কোটি। এই সংখ্যাটাই যোগী সরকারের মাথাব্যথার কারণ হতে পারত।
কিন্তু ক্ষমতাসীনরা কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। হিন্দু মুসলিমের চিরায়ত বিভেদকেই সামনে নিয়ে আসে জোরের সাথে। মুসলিমদের সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। গোটা রাজ্যজুড়ে মুসলিমদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে হিন্দুত্ববাদের একটা ঘোরলাগা অবস্থা তৈরি করা হয়। মুসলিমদের জন্য অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি অবশিষ্ট রইল। ঘোষিত ফলাফলে সমাজবাদী পার্টির এগিয়ে থাকার তালিকায় মুসলিম প্রার্থীই বেশি। অথচ নির্বাচনী জনসভাগুলোতে ব্যাপক মানুষের সমাগম হয়। হিন্দু, মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দেন এসবে।
অখিলেশ যাদবের সম্ভাব্য মিত্র চিহ্নিত করে সরকার গঠনের প্রস্তুতির কথাও জানা যায়। অন্যদিকে দলিত ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের 'রাণীমাতা' মায়াবতীর প্রতিও এবার তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই সম্প্রদায়ের মানুষ এবার জানিয়ে দেয়, ''আমরা দলিত হলেও- হিন্দু''। হিন্দু ধর্মীয় জাগরণ তারা এমন জায়গায় নিতে সক্ষম হয়েছে। যোগী-মোদির কৃতিত্ব এখানেই।
ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস এখন একটা 'কেইস'। এটা অধ্যয়ন বা গবেষণা হতে পারে। ৪০৩টির মধ্যে মাত্র ২ টিতে এগিয়ে কংগ্রেস। কংগ্রেসের টানা শাসন আমল এখন ইতিহাস। এখানে গত ৩০ বছর তারা ক্ষমতার বাইরে। কংগ্রেস চেষ্টা করেছে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধি দিনরাত চষে বেড়িয়েছেন।
জনসভাগুলোতে বিপুল মানুষের সমাগম ঘটেছে। জয়লাভ করলে সরকারের দায়িত্ব নিবেন এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তারপরও মানুষ ভোট দেয়নি। এই পরাজয়ের দায় ভাইবোন কেউ নেননি। তবে রাহুল টুইটে 'জনরায় মেনে নিলাম এবং ভবিষ্যতে জনকল্যাণেই কাজ করবো,' জানিয়েছেন।
পাঞ্জাবে নেতৃত্বের ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য। নির্বাচনের তিনমাস আগেও জয় নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ীর বেশে ঘরে ফেরার সুফল কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলো। সেখানকার নেতৃত্বের অদুরদর্শী প্রতিযোগিতা এবং কেন্দ্র যথাযথভাবে বিহীত করতে না পারার মাশুল দিল কংগ্রেস।
ভারতীয় রাজনীতিতে 'ক্লিন ইমেজ' আম আদমি পার্টি 'আপ' ও তার নেতা এবার পাঞ্জাবের মসনদে। কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তারা পরিকল্পনা করেই এগুচ্ছেন। আগামীতে আরও কয়েকটি রাজ্যে তারা ভাল করবেন।
ভারত কি তবে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে? এর উত্তর- বড় না। ভারতে এমন নেতা পাওয়া যাবে না যার পরবর্তী প্রজন্ম রাজনীতিতে নেই।
তাহলে কংগ্রেসের প্রতি কেন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া? নাকি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি চর্চায় কোনো ভুল ছিল? ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা ও অনুশীলনে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে কোনো তফাৎ আছে কিনা। সকল ধর্মের তোষণই কী ধর্মনিরপেক্ষতা!