হলুদ রঙের রুমাল বা পেলহু! আর শ্রীপন্থের ‘ঠগী’
'উপকরণ অতি সামান্য।
ঢাল নয়, তলোয়ার নয়, বোমা-পিস্তল-কামান-বন্দুক- কোন আগ্নেয়াস্ত্র নয়, একমাত্র হাতিয়ার সেই হলুদ রঙের রুমালটি। রুমাল নয়, ওরা বলত পেলহু। কিংবা—সিকা।
খুলে রাখলে মনে হবে যেন কোন পাগড়ী খুলে রাখা হয়েছে, অথবা "সাস"—কোমরবন্ধনী হিসেবে ব্যবহৃত কোন কাপড়। দু-ভাঁজে ভাজ করার পর সেটি দৈর্ঘ্যে মাত্র তিরিশ ইঞ্চি। আঠারো ইঞ্চি দূরে একটি গিঁট। গিঁটের প্রান্তে একটি রুপোর টাকা বাঁধা। নয়তো তামার একটি ডবল পয়সা। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে মেপে মেপে অতি যত্নসহকারে ওরা যখন সেটি তৈরি করে, তখন দেখলে কিছুই বোঝা যাবে না। রুমালটা আসলে একটা ফাঁস। প্রান্তে বাঁধা সিদুর মাখান টাকাটা তাকেই আরও নির্ভুল, আরও নিটোল করার জন্য।'
এইভাবেই নিখুঁতভাবে নির্লিপ্ত স্বরে ইতিহাসের আঁধার থেকে শ্রীপান্থ তুলে নিয়ে এসেছেন এক ভয়ংকর অদ্ভুত সম্প্রদায়কে, যাদের তিনি বলেছেন—ওরা হৃদয়হীন মানুষ, ইতিহাসের হিংস্রতম, নিপুণতম খুনী—ওরা ঠগী।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত 'ঠগী' বইটি শুরু হয়েছে কিছুটা অপ্রচলিত নিয়মে, বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে, দেখানো হয়েছে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের বিশেষ সময়ে, এবং তার আগেও বছরে চল্লিশ হাজার লোক স্রেফ উধাও হয়ে যেত! তিনশ বছর এমন হয়েছে! কোনো রকম পাত্তা মিলত না তাদের। কোথায় যেত তারা?
ঠগীদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় তাদের আদি গোত্র মাত্র সাতটি মুসলিম পরিবার, এখান থেকে শাখা-প্রশাখা মেলে তারা শত শত বছরে। শিকারের সব নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেলে চলতে হতো ঠগীদের, রক্তপাত ছিল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। বিশেষ করে সুবর্ণ যুগে নিজের থেকে জালে এসে ধরা দিলেও কায়স্থ, ফকির, কামার, কুমোর, ছুতোর মিস্ত্রী, গানের ওস্তাদ, নাচের মাস্টার বা গৃহপালিত গরু-মোষ নিয়ে রাস্তা হাঁটছে এমন কোনো পথিককে হত্যা করা চলবে না। স্ত্রীলোকদের হত্যা নিষিদ্ধ ছিল প্রথম দিকে।
'ভবানী দেবীর পূজারী ছিল ঠগীরা, তাঁর ইশারা ছাড়া কিছুই করত না, সারা বছরের স্বাভাবিক গৃহস্থগুলো যখন বর্ষা শেষে দিনক্ষণ দেখে শরতের ভোরে পথে নামল তখন তারা সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, ভবানীর সন্তান। ওদের হাসি তখন হাসি নয়, কান্না তখন আর কান্না নয়, ওরা তখন ভিন্ন জগতের মানুষ—ওরা ঠগী, আপাদমস্তক শিকারি খুনি।'
আর বইয়ের নায়কের নাম উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান, যাকে ইউরোপিয়ানরা বলতেন ঠগী স্লিম্যান। ইতিহাসের প্রবল অনুরাগী এই তরুণের মনে প্রবল ঔৎসুক্য ছিল এই গুপ্ত খুনি সম্প্রদায়দের নিয়ে, যাদের খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন একাধিক ধূসর পাণ্ডুলিপির মাঝে। চোস্ত হিন্দুস্তানি ভাষা বলতে পারা স্লিম্যানকে ঠগী নিয়ে অতি উৎসাহের কারণে আড়াল থেকে টিপ্পনি কাটত অনেকে। কিন্তু দিন-রাত ঠগী নিয়ে গবেষণা করে তিনিই কিন্তু প্রথমবারের মতো এদের পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন, খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করেন সত্যিকারের ঠগীদের। মূলত তাঁর কারণেই ভারতবর্ষ থেকে এই খুনে সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে ইতিহাসবিদরা মনে করেন ঠগীদের এমন বিশ্বাস ছিল যে শ্বেতাঙ্গরা অজেয়, দেবী তাদের কোনো ক্ষতি হতে দেবেন না, এই কারণেও নিজেদের অজান্তেই বিশাল সুবিধা লাভ করে স্লিম্যানের বাহিনী।
ঝিরনী অর্থাৎ গলায় ফাঁস লাগাবার সংকেত, কাসসি নামের কোদাল, জলের ঠগী ম্যাকফানসাঁ, ধুতুরা খাইয়ে ছিনতাইকারী ধুতুরিয়া এমন সব গোপন গা ছমছমে রহস্যের মাঝে হারিয়ে যাবেন কয়েক ঘণ্টার জন্য বইটি হাতে নিয়ে। সেইসাথে আছে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া কজন ঠগীর সাক্ষাৎকার। আরও জেনে অবাক হবেন যে পূর্ববঙ্গে কতটা শক্ত ছিল ঠগীদের রাজত্বের ভিত, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করে তবেই তাদের নাই করে দেয়া গিয়েছিল।
আসলেই কি তাই? শেষ ঠগী সম্প্রদায় যদি রংপুর, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জে টিকে থাকে শত বছর আগে, তাদের কোনো কোনো বংশধরই কি আজও মলমপার্টি, ধুতুরা পার্টি ইত্যাদি নামে সক্রিয়?