পাকিস্তানের জনগণের একটি সংবিধান আছে!
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেই সপ্তাহান্তে পাকিস্তানের জনগণ উদযাপন করার মতো দুটো উপলক্ষ পেয়ে গেছে। বিচারকরা এবার তাদের পূর্বসূরিদের পথে হাঁটেননি; বরং সংবিধানে প্রতিশ্রুত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন।
আদালতের সর্বশেষ ঐতিহাসিক দুই রায় আগামী দিনে পাকিস্তানের রাজনীতি বদলে দিতে ভূমিকা রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করা ও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতির সংসদ ভেঙে দেওয়াকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার রাতে দেওয়া এই রায়ে সংসদ পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনাস্থা ভোটগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
ইমরান খান ও তার কট্টর অনুসারী ছাড়া দলমত নির্বিশেষে পাকিস্তানের জনগণ শীর্ষ আদালতের রায়ের প্রশংসা করে তাকে স্বাগত জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বেশ স্বস্তির সঙ্গেই ঘুমাতে গেছে পাকিস্তানের মানুষ। আপাতত সাংবিধানিক সংকট থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে।
শুক্রবারও ছিল পাকিস্তানের জন্য চমৎকার এক দিন। গত ফেব্রুয়ারিতে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে ইমরান খান সরকারের প্রণীত কঠোর সাইবার আইন বাতিল করেছে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট। ইমরান খানের মন্ত্রিসভার পরামর্শে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি করা অধ্যাদেশকে হাইকোর্ট অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, আইনটিতে সামরিক ও বিচার বিভাগসহ অনলাইনে সরকারের 'মানহানি' ঠেকাতে কঠোর বিধান প্রণয়ন করা হয়।
বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্র যখন নিম্নমুখী তখন এই রায় নিশ্চিতভাবেই গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের জন্য একটি বড় জয়।
বিশ্বের অন্যান্য সরকার ও প্রতিবেশি দেশগুলোর মতো ইমরান খানও জানান যে 'মিথ্যা সংবাদ' নিয়ন্ত্রণ করতেই এই আইন প্রণীত হয়েছে। তবে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরোধীদের দমন করার পাশাপাশি গণমাধ্যমকে হাতের মুঠোয় আনাই ছিল আইনটির মূল উদ্দেশ্য।
'পাকিস্তান ইলেকট্রনিক ক্রাইমস অ্যাক্ট' নামের এই সাইবার আইনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের সূচনার মধ্য দিয়ে মানুষের বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাওয়ার উদাহরণ স্থাপিত হয়েছে।
দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের মতে, পাকিস্তান ব্রডকাস্টার অ্যাসোসিয়েশন (পিবিএ), অল পাকিস্তান নিউজপেপার সোসাইটি (এপিএনএস), কাউন্সিল অফ পাকিস্তান নিউজপেপার এডিটরস (সিপিএনই), অ্যাসোসিয়েশন অফ ইলেকট্রনিক মিডিয়া এডিটরস অ্যান্ড নিউজ ডিরেক্টরস (এইএমএনডি)-সহ পাকিস্তানের সাংবাদিক সমিতি ও দেশের বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক আইনের বিরোধিতা করে পিটিশন দায়ের করেন।
চার পৃষ্ঠার আদেশে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট বলেছেন, সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত বাকস্বাধীনতা "কোনো সমাজের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য, একই সঙ্গে একে দমন করা অসাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।"
ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ-র দেওয়া আদেশে বলা হয়েছে, "অসাধু উদ্দেশ্যে মানহানি, গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সুনাম হানি এবং তার ফলশ্রুতিতে জন্ম নেওয়া প্রভাব সংবিধানে উল্লেখিত অধিকারের পরিপন্থী এবং এর অসাড়তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত"।
আদালত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির সাইবার ক্রাইম উইংয়ের কর্মকর্তাদের আচরণ তদন্ত করার নির্দেশনাও দিয়েছে। পাকিস্তানি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহারের মাধ্যমে উইংটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে।
ইসলামাবাদ হাইকোর্টের সুবাদে পাকিস্তানি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারে প্রাণ সঞ্চার ঘটল, কেননা সংবাদপত্রগুলো জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যম।
হাইকোর্টের রায়টি সরকারের জন্য আরেকটি ধাক্কা। পাকিস্তানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংকট দীর্ঘদিন ধরেই। ইমরান খানের সরকারের আমলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণের অভিযোগকে 'ঠাট্টা' বলে উড়িয়ে দিয়েছে সরকার। ইমরান খান নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের আগে ২০১৭ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বৈশ্বিক সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ১৩৯তম। গত তিন বছরে দেশটি ছয় ধাপ নিচে নামে।
বৃহস্পতিবার রাতে সংবিধান সমুন্নত রাখার মাধ্যমে ঐতিহাসিক পরম্পরার বিপরীতে গিয়ে দেশকে সংকটের হাত থেকে উদ্ধার করে সুপ্রিম কোর্ট।
পাকিস্তানের শীর্ষ আদালত এর আগে বহুবার সংবিধান ও জনগণের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়। ১৯৫৪ সালে বেআইনিভাবে গণপরিষদের বিলুপ্তিকে সমর্থন করার মাধ্যমে স্বাধীন দেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে সুপ্রিম কোর্ট।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর শীর্ষ বিচার বিভাগ মাত্র দুই বছর আগে প্রণীত সংবিধান বাতিল করে পাকিস্তানের প্রথম সামরিক আইনের বৈধতা দেয়।
১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক অভ্যুত্থানকে বৈধ রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ও জনগণের কল্যাণের খাতিরে অভ্যুত্থানকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। দুই দশক পরে ১৯৯৯ সালে আবারও জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষ নেন আদালত।
প্রতিক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্ট মূলত বৈধভাবে নির্বাচিত সংসদ ভেঙে দিয়ে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষ নিয়েছে।
তবে এবার সুপ্রিম কোর্ট সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য ইমরান খান সরকারের সংবিধান বহির্ভূত পদক্ষেপকে বৈধতা দিতে 'প্রয়োজনীয়' পদক্ষেপের দোহাই দেননি।
সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান করলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিজ দেশ দখলের কুখ্যাত ইতিহাস থাকলেও এবার তাদের ভূমিকা ছিল ভিন্ন। সরকারকে উৎখাত করতে বিদেশি সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার কথা প্রচার করেন ইমরান খান। তবে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সমর্থন করেনি সেনাবাহিনী।
ইমরান খান প্রকাশ্যে তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য মার্কিন কর্মকর্তাদের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। কিন্তু সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। অর্থাৎ, সশস্ত্র বাহিনী স্পষ্টভাবেই এই তত্ত্ব মেনে নেয়নি।
পাকিস্তানের বিচারক ও জেনারেলদের ইতিহাস থেকে কৌতূহলী এক গল্প জানা যায়, যা এতটাই নাটকীয় যে তা কোনো ড্রামা সিরিজের প্লট হতে পারে।
কিন্তু এবার সর্বশেষ দুই রায়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ উচ্চকণ্ঠে জানান দিয়েছে, পাকিস্তানের জনগণের একটি সংবিধান আছে। এবং এই সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে হবে, রক্ষা করতে হবে। জনগণের সাংবিধানিক অধিকারও যে শুধু কাগজে-কলমে রয়ে গেলে চলবে না তার প্রমাণ এই রায়।
লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
মূল লেখা: People of Pakistan have a constitution!