ইমরানের বিদায় অনেক কিছুই বদলে দেবে
না, কোন ভাবেই শেষ রক্ষা হলো না। দিনভর সব নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে শনিবার মধ্যরাতে অনুষ্ঠিত আস্থাভোটে ইমরান খান সরকারের পতন হলো। বিরোধীদের 'ম্যাজিক ফিগার' ১৭২ এর স্থলে ১৭৪ ভোট পায় অনাস্থা উত্থাপনকারীরা। পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার 'ট্রাম্প কার্ড' কাজে আসেনি। আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ, চারদিনের শুনানি শেষে অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল ও পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়েই ইমরান খানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। গতরাতে পার্লামেন্টের মাধ্যমে তা আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। পাকিস্তান প্রবেশ করে রাজনৈতিক ইতিহাসের নুতন অধ্যায়ে। এই প্রথম কোন প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে আস্থা হারিয়ে পদচ্যুত হলেন।
পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ইতিহাসে ১৯৮৯ সালে ও ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও শওকত আজিজের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উঠলেও ভোটে প্রস্তাবগুলো পরাজিত হয় এবং সেই সরকার টিকে যায়। ইমরান খানের সরকার অনাস্থা ভোটে পরাজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কোন নির্বাচিত সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার 'ইতিহাস' 'অক্ষুণ্ণ' রাখলো। পাকিস্তানের ২৩ তম প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি শাহবাজ শরিফ যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফের ছোট ভাই।
পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ঘোষণা করেছেন, তারা সরকার গঠন করলে প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না। সাড়ে তিন বছর আগে ইমরান খান দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগে পাকিস্তানের আদালত প্রধানমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে। ইমরান খানের ক্ষমতায় আসার এটিই হলো প্রেক্ষাপট। দুর্নীতির অভিযোগ ইমরানকে ছুঁতে না পারলেও তার দল ও জোটের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিরোধী জোট "আর্থিক দূরবস্থা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতি'র" অভিযোগ তুললেও মূলত সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতিতে পাকিস্তানের অবস্থান ইমরান খানের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ বলে মনে করেন সেখানকার বিশ্লেষকরা। ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধাবস্থার মধ্যে ইমরানের মস্কো সফর এবং জাতিসংঘের নানা ইস্যুতে আমেরিকার বিপরীতে মস্কোর অনুকূলে ভোট প্রদান পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইমরানের অবস্থান দুর্বল করতে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানের অবস্থানের সাথে ভারতের অবস্থানের মিল খুঁজে পাওয়া যায়- এটাও স্থানীয় রাজনীতিতে ইমরানের বিরুদ্ধে যায়। ইমরান খানের সাড়ে তিন বছরের সময়কালে ভারত- পাকিস্তান সীমান্তাঞ্চলে বড় ধরনের গোলাগুলি হয়নি। সীমান্তে কোন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করেনি বা ভারতের বিদেশনীতির প্রশংসা এসবই ইমরানের বিরুদ্ধে গিয়েছে।
গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ইমরান খান ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করেছেন। গত তিন বছরের অধিক সময় ভারত- পাকিস্তান সীমান্তে কোন উল্লেখজনক উত্তেজনা দেখা যায়নি। ভারতের বিদেশনীতির প্রশংসা পাকিস্তানের যুব সমাজ ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়, পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা অনেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে। যদিও এই উদ্যোগ সেখানকার উচ্চ আদালত 'অসাংবিধানিক' বলে বাতিল করে দিয়েছে।
ইমরান খান পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন্, তারপর করোনা। ফলে মূদ্রাস্ফীতি, যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হয়েই ক্ষমতায় বসেছিলেন। আজকেই খবর বেরিয়েছে, ইমরান খান সেনাবাহিনী প্রধানকে সরাতে চেয়েছিলেন! যদিও এ খবরের সত্যতা কোন সূত্র নিশ্চিত করেনি। তবে গতবছরের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রাজনীতির প্রশ্নে 'নিরপেক্ষ' অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা ইমরান খানের পায়ের নীচের মাটি দুর্বল করে দেয়। গত বছরের শেষে গোয়েন্দা প্রধানের নিয়োগ প্রশ্নে সেনাবাহিনী প্রধানের প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়। ইমরান খান ফয়েজ হামিদকেই রেখে দেন। বিরোধী জোট এমন একটি সময়ের অপেক্ষাতেই ছিল।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ন্যূনতম সহনশীল অবস্থা দুই দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। ২০২৪ সালে ভারতের পরবর্তী নির্বাচন। ২০১৯ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনদের কাশ্মীর সীমান্তে বড় ধরনের যুদ্ধের প্রয়োজন হয়েছিল। যার উপর ভর করে হিন্দু জাতীয়তাবাদ পার পেয়েছিল। এবারের অবস্থা আরো নাজুক। ভারতের বিধান সভার নির্বাচনগুলো যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের জন্য কঠিন বলেই মনে হয়। ইতোমধ্যে পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেত্রী ইমরান খানকে ভারতে চলে যেতে বলেছেন। অনুমান করা যায়, ভারত- পাকিস্তান সীমান্ত অঞ্চল বর্তমান অবস্থায় থাকবে না এবং সীমান্ত উত্তেজনা আবার ফিরে আসবে।