স্বাগত বৈশাখ! এবং ফিরে দেখা ১৪২৮ বাংলা?
১৪২৮ বাংলা সনটি কেমন কেটেছে? করোনা মহামারির ভেতর? এর উত্তর নানাজনের অভিজ্ঞতায় নানাকিসিমের। কিন্তু যদি মানুষ বাদে এই প্রশ্ন দেশের প্রাণ ও প্রকৃতির কাছে রাখা হয় তবে এর উত্তর কী হবে?
যদি পাখির কাছে প্রশ্ন করি, পতঙ্গ বা বৃক্ষের কাছে? এর উত্তর নিদারুণ ও রক্তক্ষয়ী। বছরজুড়ে নদী কি কৃষিজমিন খুন হয়েছে, ইটের ভাটায় পুড়েছে অরণ্য ও মাটির কলিজা। দেশি জাতের বীজ উধাও হয়েছে, বাতাস হয়েছে দূষিত। আরেক দিকে বেড়েছে এডিস মশার বংশ ও জীবাণুর সংক্রমণ। কেবলমাত্র মানুষের সুখ আর বিলাসিতার কারণে, একতরফাভাবে মানুষের উন্নয়নের জন্য লাগাতার দেশ দুনিয়ার প্রাণ-প্রকৃতির গায়ে বিচারহীন জখমের দাগ লেগেছে। আসছে নতুন বছরে মানুষের কাছ থেকে প্রকৃতির ওপর এই জুলুম কী থামবে? মানুষ কি পারবে রেহাই দিতে প্রাণের অসীম সম্ভাবনাকে? আসছে নতুন বছরে তাই প্রাণ ও প্রকৃতির আরাধনার ডাক দিতে চাই। গ্রামবাংলার সহস্র বছরের প্রকৃতিসংলগ্ন জীবনকৃত্য আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক। আসছে বছর হোক প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মানুষ প্রজাতি হিসেবে আমাদের সংগ্রামী কৃত্যের বছর। 'কৃত্য' মানে যা করণীয়, মানুষ যা করে থাকে বা করতো বা করে চলে। বেশকিছু পুস্তকি দলিল ও অধিপতি উপস্থাপন কৃত্য বলতে বোঝাতে চায় পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠানসহ ধর্মীয় চর্চারীতির কিছু প্রশ্নহীন একক পরিবেশনাকে। কিন্তু বাংলাদেশের নিম্নবর্গের যাপিতজীবনে কৃত্য মানে এক স্রোতস্বী সঞ্জীবনী। যার পরতে পরতে জনজীবনের বিশ্বাস, রীতি ও চর্চার বীজদানাগুলো অংকুরিত হয়ে থাকে। নিম্নবর্গের কৃত্য-দর্শন হলো, প্রাণ ও প্রকৃতির আরাধনা। প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি আরাধনাই হয়ে উঠুক আসছে বছরে আমাদের এক দুবির্নীত শপথ।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে বাঙালি হিন্দু নারীর শস্য ফসলসহ মানুষের বীজ ও বংশরক্ষার নানান কৃত্য রীতি আছে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বাংলা কার্তিক সংক্রান্তিতে আয়োজিত 'জালাবর্ত' এমনই এক গ্রামীণ আয়োজন। কার্তিক ও আশ্বিন মাসে এখানকার গ্রামীণ জনপদ ভোলাসংক্রান্তি ও ওলাসংক্রান্তি পালন করে। এগুলো প্রতিটিই কৃষি লোকাচার। নারীরাই যে ক্ষেত কৃষির প্রাণ, নারীর মাধ্যমে পালিত এসব কৃষি আচার দেখলেই তা বোঝা যায়। মূলতঃ শস্য ফসলসহ সন্তানের আয়ু ও মঙ্গল কামনায়, বীজ ও সন্তানের বংশ রক্ষায় এই ব্রত পালন করা হয়। জালাবর্তে জালা হল মাঙ্গলিক চিহ্ন। জালা যেভাবে ফুটে উঠে এভাবে যেন বীজ ও বংশের বীজ ফুটে উঠে। জালাবর্তের প্রধান উপকরণ ধানসহ নানান শস্য ফসলের বীজ। প্রায় মাসব্যাপী গ্রামীণ নারীরা এইসব বীজকে সন্তানের মতো পরিচর্যা করে এর জালা (অংকুরোদগমিত চারা) তুলে ব্রত আচার পালন করেন। জালাবর্তের মাধ্যমে সংরক্ষিত শস্য ফসলের বীজের সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা সঠিক আছে কিনা তাও যাচাই হয়ে যায়। যদি বীজ ঠিকমত না গজায় তবে বীজ বদলে অন্য বীজ আরো কঠোর নিয়ম মেনে সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি এই বীজের মাধ্যমে বীজের অংকুরোদগম হার ফসল রোপণের পূর্বেই জানা যায় ফলে ফসল চাষের পূর্বে প্রস্তুতি সমূহও ঠিকভাবে নেয়া সম্ভব হয়। এই ব্রতের ভেতর দিয়ে কার বাড়িতে কী ধরনের ধানসহ শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষিত আছে এবং কে কোন ধরনের জাত সংরক্ষণ করছেন তাও একটি গ্রাম সমাজে নথিভুক্ত হয়ে যায়। আর এভাবেই গ্রাম জনপদের নারীরা বীজ ও বংশরক্ষার আপন দলিল সব আগলে রেখেছেন বৈচিত্র্যময়সব জালাবর্তের ভেতর দিয়েই, একটি পুরুষতান্ত্রিক পুস্তকি শাস্ত্রীয় রাষ্ট্র ধর্ম যাকে কেবলমাত্র 'লোকসংস্কৃতি' বলে আড়াল ও অপর করে রাখতে চায় চিরকাল।
বাংলাদেশের এক অচ্ছুত প্রান্তিক জাতির নাম বাগদী। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলেই বাগদীদের বসবাস বেশী। বাঙালি কৃষকরা মূলতঃ অগ্রহায়ন থেকে পৌষের প্রথম দিকে বিল এলাকার আমন ধান কেটে ঘরে তুলেন। আমন মওসুমে বিল এলাকার দেশী আমন ধানের শীষ কেটে কেটে ইঁদুরেরা তাদের গর্তে সংগ্রহ করে। ধান কেটে ঘরে তোলার পর বাগদী নারী এবং শিশু-কিশোরেরা ধান কাটা জমিনে ইঁদুরের সেসব গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করতে নামেন। ইঁদুরকে বাগদী সমাজে এক পবিত্র জীব হিসেবে দেখা হয়। বাগদীদের বিয়েতে কন্যা বরের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় তার শাড়ির আঁচলে ইঁদুরের গর্তের মাটি ও কিছু দেশী আমন ধানের বীজ বেঁধে দেয়া হয়। যাতে পরবর্তী জীবনে এই ইন্দুরগাতির ধানই তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে এই বিশ্বাসে।
একক আয়তনে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন কেবল বননির্ভর মানুষদের কাছে জীবিকার উৎসই নয়, বনই বনসংলগ্ন স্থানীয় মানুষের জীবনমরণের সীমানা, বনই গড়ে তুলেছে বাওয়ালি-মৌয়াল-জেলেদের মগজ-পেশী-রক্ত-মজ্জা-অস্থি। বনই সুন্দরবনের বনজীবীদের কাছে জীবনের পাঠশালা কী চিকিৎসাঘর। সুন্দরবনের বনজীবীরা বিশ্বাস করেন বনের রক্ষাকবচ মা বনবিবি। মধু, মাছ, কাকঁড়া কি গোলপাতা সংগ্রহকালে বনজীবী মৌয়াল-বাওয়ালিরা সুন্দরবনের কাছে বনে প্রবেশের অনুমতি নেন। বনবিবি, গাজী কালু, চম্পাবতী, আলীবদর, খোয়াজখিজির, দুখে, শাহ জঙ্গলী, দক্ষিণরায়, রায়মণি, বড় খাঁ এদের কাছে প্রার্থনা করা হয় যাতে বাদায় কোনো বিপদআপদ না ঘটে। বনবিবির কাছে প্রার্থনা করা হয় যাতে একযাত্রায় জুটে যায় বছরের খোরাক। বনজদ্রব্য সংগ্রহের আগে প্রতিবার বনের কাছে অনুমতি প্রার্থনার জিইয়ে রাখা এ রীতিই এক অবিস্মরণীয় কৃত্য হয়ে ওঠেছে দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ জীবনে।
দেশের নিম্নবর্গের মানুষ ভূমিকে 'কল্পনা' বা 'প্রতীক' বা কেবলমাত্র 'উর্বরতা' দিয়ে মাপে না বা বিচার করে না। ভূমি ও মাটি মানুষের যাপিতজীবনের অংশ, সংসারের একজন। তাই এই জনপদে ভূমিকে ঘিরে আছে নানান কৃত্য-আচার রীতি ও উৎসব। মাটি ও মাকে এক করে দেখার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করলেও মাটি কোনোভাবেই পুরুষ নয়। এর কারণ নারী ও ভূমি সকল নিপীড়ন সহ্য করে 'সর্বংসহা' হয়ে থাকবে বলেই নয়। এর আরো মানে আছে। জনমানুষের লোকায়ত ইতিহাসে ভূমির ব্যবহার ও সম্পর্ক বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দু ও আদিবাসীদের ভেতর অনেকেই পৃথিবীকে নারী হিসেবে বিবেচনা করেন। নারীর যেমন এক নির্দিষ্ট ঋতু ও কালে ঋতুস্রাব হয় ঠিক তেমনি এক নির্দিষ্ট কালে পৃথিবীরও ঋতুস্রাব হয় বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দু কৃষক পরিবারের নারীদের ভেতর এসময় মানে আষাঢ় মাসে অম্বাবচী ব্রত পালন করতে দেখা যায়। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী 'অম্বাবচী' নামটি বহুল ব্যবহৃত হলেও কোথাও কোথাও 'অম্বুবচী', 'অম্বুবাচী', অম্বুবুচী বলতে শোনা যায়। টাঙ্গাইল অঞ্চলের কোচদের ভেতর এই পর্ব 'আমাতি/আমতি' নামে পরিচিত। গাজীপুরের বর্মণ-ক্ষত্রিয়রা একে 'আমচি/আমাচি/আমাতি' বলেন। এ সময় মাটি খোঁড়াখুড়ি করা যায় না। বীজদানা রোপণ করা যায় না। কারণ ঋতুস্রাবের এ সময়ে ধরণী মাতা কষ্ট পেলে সকলেই কষ্ট পাবে এমনই বিশ্বাস নিম্নবর্গের জীবনে। বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের একভাগ জুড়েই হাওরভূমি। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি এলাকা নিয়ে যে বিশাল হাওর এলাকা তার অনবদ্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর নির্ভর করেই এখানে গড়ে উঠেছে জনজীবনের নানান বৈচিত্র্যময় কৃত্যের রূপ ও ছন্দ।
আমন ধান ঘরে তোলার পর মূলতঃ শীতকালে হাওরা অঞ্চলে আয়োজন করা হয় ষাঁড়ের লড়াই, স্থানীয়ভাবে যা ষাঁড়ের নাড়াই হিসেবে পরিচিত। মূলতঃ পৌষ থেকে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে ভাটি-বাংলার ক্ষেত ময়দান খোলা কিততাতে বসে আড়ঙ্গ, ষাঁড়ের লড়াই উপলক্ষ্যে গ্রামীণ মেলা। হাওর এলাকার কোনো গৃহস্থ বাড়িতে একটি ষাঁড়কে বিশেষ যত্ন নিয়ে পরিচর্যা করা হয়। নানান আচার রীতি পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে কবিরাজ বা কারিগর বা ফহির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কবিরাজের পাশাপাশি বাড়ি কি গ্রামের সকলেই একটি ষাড়কে সামাজিক মালিকানায় পরিণত করতে বছরব্যাপী যা পালন করেন তাই এক সমন্বিত কৃত্য রূপ পেয়েছে।
নিম্নবর্গের নিত্যদিনের পরিচিত অসুখ বিসুখের চিকিৎসায় নানান কৃত্য-আচার সমূহও এক সামাজিক উৎসবে রূপ নেয়। বাঙালি হিন্দু ও কোচ-বর্মণ-রাজবংশী সমাজে শীতলা হলেন বসন্ত রোগের দেবী। ফাল্গুন মাসে বসন্ত রোগ না হওয়ার মানতে বেশ ঘটা করেই আয়োজিত হয় শীতলা পূজা। সাংসারিক মান্দি সমাজেও নানান পূজা ও উৎসব পালিত হয় অসুখ বিসুখ সারাতে। গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরের চান্দারবিল এলাকায় হেচড়া দেবীও পূজিত হন বসন্তকালে খোস-পাঁচড়া নিরাময়ের মানতে। ফাল্গুন মাসে খোস-পাঁচড়া, চুলকানিসহ ত্বকের রোগগুলো বেশি ছড়ায় এবং শিশুদের হয় বলে এই পূজা বাঙালি হিন্দুদের ভেতর মূলতঃ শিশুদের মাধ্যমেই আয়োজিত এক ঐতিহাসিক ধারায়। চান্দারবিলে প্রতি বাঙালি হিন্দু বাড়িতেই ফাল্গুন মাসের পনের তারিখ থেকে মেয়ে শিশুরা (অবশ্য ছেলে শিশুরাও করে) হেচড়া ব্রত পালন করে পনের দিন। তারা বাড়ির উঠোনে নিজেরাই মাটি কেটে একটি হেচড়ার পুঁতা (বেদী) তৈরী করে। হেচড়ার পুঁতায় একটি বড়ই গাছের ডাল পাতা ফেলে পুঁততে হয়। প্রতিদিন ভোর ও বিকেলবেলায় শিশুরা স্থানীয় এলাকা থেকে মিষ্টিকুমড়ার ফুল ও বউন্যার ফুল জোগাড় করে বড়ই ডালে গেঁথে চিনি-কলা দিয়ে হেচড়ার সভা (সেবা) দেয়। সকাল বেলা মিষ্টিকুমড়ার ফুল এবং বিকেলবেলা সব পরিষ্কার করে আবার বউন্যার ফুল দিয়ে এটি করতে হয়। হেচড়ার পুঁতার কাছে একটি বুড়ির ঘর বানাতে হয়। এতে ব্রতের সকল উপাচার ও উপকরণ রাখা হয়। মূলতঃ ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন হেচড়া পূজা করা হয়। এদিনে শিশুরা স্নান সেরে আগের বড়ই ডালটি জলে বিসর্জন দিয়ে শিশুদের হাতের মাপে প্রায় তিন-চার হাত লম্বা একটি নতুন বড়ই ডাল পাতাসহ হেচড়া পুঁতায় পুঁতে পূজা শুরু হয়। পূজার দিন সকল ধরনের ফুল দিয়েই হেচড়া ডাল সাজানো যায়। তবে পূজার দিন অবশ্যই ভাটির ফুল লাগে। পূজার আগে হেচড়ার বেদী লেপে মুছে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে সাজানো হয়। বড়ই ডালে লাল সুতা বাঁধা হয়। কেউ কেউ বড়ইডালকে রঙিন কাপড় পড়ায়।
ডালেও সিঁদুর ফোঁটা দেয়া হয়। পূজা শিশুরা নিজেরাই নানান গান গেয়ে সেরে নেয় এবং খোসপাঁচড়া না হওয়ার জন্য হেচড়া দেবীর কাছে প্রার্থনা করে। অনেকে পূজার আগের দিন গ্রাম ঘুরে ঘুরে হেচড়া পূজার মাঙন সংগ্রহ করে। সংগৃহীত চাল ডাল দিয়ে শিশুরাই নিজেরা রান্না করে খায়। শিশুরা পূজার পরে সবাইকে চিনি কলা ও অন্যান্য ফলফলাদির প্রসাদ ভাগ বন্টন করে বিলিয়ে দেয়। পূজা শেষে হেচড়ার পুঁতা আবার সমান করে দেয়া হয়, বুড়ির ঘর ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং বড়ই ডাল নিয়ে শিশুরা পাড়া ঘুড়ে স্থানীয় কোনো পুকুর বা বিলে বিসর্জন দেয়। মূলতঃ হেচড়া পূজার পুরো পনের দিন জুড়ে থাকে শিশুদের আনন্দ আর নিত্যনতুন প্রকৃতি পাঠের আসর। এখানে শিশুরা প্রতিদিন নানান ফুলের নাম পরিচয় জানে, খোসপাঁচড়া ও চুলকানি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সচেতন করে তুলে, সংগঠিত হয়ে কাজ করার মানসিকতা জন্মায়।
মৌলভীবাজারের মণিপুরী মুসলিম পাঙাল আদিবাসীরা শবেবরাতের রাতে গোষ্ঠীর সকলে মিলে শিরণী রান্না করেন, কেউ কেউ ক্ষীর ও পিঠা তৈরী করেন। এসময় লুধাওৗবা/লুধৗওবা নামের পিঠা নিয়ত করে বানানো হয়। নিয়ত পূরণের জন্য এ পিঠা 'লুট' দেয়া হয়। আর দিনেদিনে এটিই পাঙাল সমাজে এক আনুষ্ঠানিক কৃত্যের রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশের জেলেজীবনে জল ও মাছের রক্ষাকবচ গঙ্গা। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর দাস-কৈবর্ত বর্মণ এবং বাঙালি মুসলিমদের ভেতর মাইমল সম্প্রদায় সরাসরি বংশগত মৎস্যজীবী। আদিবাসী বর্মণ এবং রাজবংশীদের ভেতর অনেকেই প্রথাগত জেলে জীবনের সাথেই জড়িত। জেলেদের বিশ্বাস জলের প্রাকৃতিক ধারা এবং মাছের বংশরক্ষা করেন দেবী গঙ্গা। জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাস মাছের রেণু ছাড়ার মাস। প্রথাগত জেলেরা এসময়টাতে মাছ ধরেন না। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে নদী-হাওর-বিলে গাছের মরা ডাল, বাঁশ, লতাপাতা, জারমনি (কচুরিপানা) দিয়ে 'কাটা/কাঠা' করে রাখা হয়। কাটা মানে মাছের পোনার বিশ্রামঘর, আবাসস্থল। পৌষ মাসে বেশ নিয়ম পালন করা হয় তারপর পৌষের শেষে বা মাঘে বা কখনো কখনো সময় সুযোগ বুঝে তারও আগেপরে গঙ্গাপূজা করা হয়। গঙ্গাপূজা করার পর কাটা ভেঙ্গে গ্রামের সকলে মিলে মাছ ধরা হয়। এর আগে কাটা দেয়া স্থানের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। কাটা দেয়ার জায়গাতে মা মাছেরা আরাম পায় বেশি, তাদেরকে কেউ জ্বালাতন করে না।
শিলাবৃষ্টি থেকে জমিনের ফসল রক্ষায় হাওর এলাকায় 'হিরালপ্রথা' চালু আছে। হিরালেরা নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে হাওরকে শিলাবৃষ্টির বরফ থেকে রক্ষা করেন। মধুপুর শালবনের মান্দিরা গরাইয়া আমুয়া (পূজা) পালন করেন বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি থেকে জুমফসল রক্ষার তাগিদে। আবার খেত একইভাবে যখন খরাময় হয়ে যায় চতুর্দিক, বৃষ্টিহীনতা রুক্ষ করে তুলে চারপাশ। সমতলের বাঙালি জনপদে ঘটা করে আয়োজন করা হয় ব্যাঙের বিয়ে। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও পালিয়া সমাজে আয়োজিত হয় হুদুমদেও ব্রত।
খাগড়াছড়ির ত্রিপুরাদের হউক (জুম চাষ) এর মাই বালাং (ধান কাটা) পর্বের একটি স্তুতিতে বলা হয়, মা লক্ষী তোমাকে নমস্কার! তোমাকে কেটে বাড়িতে নেয়ার জন্য এসেছি, তোমাকে কাটবো বলে তুমি রাগ কর না, আমাদের অনুমতি দাও তোমাকে কেটে নেয়ার, বাড়ীতে গিয়ে তুমি ঘর ভর্তি হয়ে থেকো, চিরকাল থেকো আমাদের লগে। হাওরা অঞ্চলে বাঙালি কৃষকেরা জমির প্রথম ধানের শীষ কেটে এনে ঘরের মধ্যমপালায় ঝুলিয়ে রাখেন। মধুপুরের মান্দি সমাজে হাবা বা জুমচাষের নিয়ম ছিল জুমের জমিনে পয়লা বুনতে হবে দেমব্রা জাগেদং ধানের বীজ। কারণ মান্দিরা বিশ্বাস করেন এ ধানই বাঘের আক্রমণ থেকে জুম রক্ষা করে। বাংলা পঞ্জিকা দেখেই ঘর সংস্কার, গৃহপ্রবেশ, হলকর্ষণ, জমিরোপণ, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সম্পর্কিত কৃত্য পালন করা হতো একটা সময়। চলতি সময়ে পঞ্জিকা দেখে চাষাবাদের রেওয়াজ অনেকখানিই পাল্টে গেছে। বাঙালি জনপদে চৈত্র মাসে শিমুইর (শিম), ফাল্গুনে মূলা, শ্রাবণে কচু, আষাঢ়ে ওল, জৈষ্ঠ্যে গিমাতিতা শাক, কার্তিকে ওল খায় না অনেকেই। তবে এই বাছবিচার মুসলিম পরিবারের চেয়ে হিন্দু পরিবারগুলোতেই বেশি। যেমন গ্রামের প্রবীণ অনেকেই এখনও মনে করেন বাংলা জৈষ্ঠ্য মাসে কোনো শস্য ফসল লাগাতে হয় না, কারণ এতে জেষ্ঠ সন্তানের অমঙ্গল হয়। শ্রাবণ মাসে কলা গাছ লাগানোর নিয়ম নেই। শ্রাবণ মাসে মনসাবর্ত হয় এবং এর সাথে জড়িত বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনিতে বেহুলা কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে ছিল বলেই শ্রাবণ মাসে কলাগাছ পুতার নিয়ম নেই। শনি ও মঙ্গলবারে সাধারণত কোনো শস্যফসল লাগানোর নিয়ম নেই। ত্রিসন্ধ্যা, সন্ধ্যা, রাত ও ভোর রাতে কোনো কিছু লাগানোর নিয়ম নেই। স্থানীয় মুসলিমরা বুধবারে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটে না, কারণ তারা বুধবারকে মাদারিয়া বার হিসেবে দেখে। মাদার পীরের বারকে মাদারিয়া বার বলে। স্থানীয় হিন্দুদের ভেতর রবি ও বৃহস্পতিবার বাঁশ কাটার নিয়ম নেই। টাঙ্গাইলের চারান বিলের বাঙালি জেলে পরিবারে রাগা মাছ খাওয়া হয় না। অনেকে বিশ্বাস করেন এই মাছ সর্পদর্শনের পর ভেলায় ভাসমান লক্ষিন্দরের পায়ের টাখনুগিরা খেয়ে ফেলেছিল। ঠিক যেমন সিলেটসহ দেশের অনেক অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম পরিবার হযরত শাহজালালের স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত বলে জালালি কবুতরের মাংস খান না।
সুনামগঞ্জসহ দেশের বিস্তীর্ণ হাওরা অঞ্চলে করচ, বরুণ, হিজল, তমাল, কদম, শ্যাওড়া, বট, পাকুড়, অশ্বত্থ গাছগুলো পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে কালের ধারাবাহিকতায় হাওর-ভাটির সংস্কৃতি হিসেবে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এসব গাছকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হাওরাঞ্চলের স্থানীয় লোকবিশ্বাস ও জীবনযাপনের বিস্তার। এসব গাছই হাওরবাসীর জীবনে কখনো রূপসী গাছ, হোমাই ঠাকুর, সোমেশ্বরী, কৃষ্ণ গাছ, বুড়ির গাছ, পাগল গাছ কি কালাচাঁদ ঠাকুর নামে পরিচিতি পেয়েছে। হাওর-ভাটির সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে মুসলিম সম্প্রদায় এবং হাজং-কোচ-মান্দি-বর্মণ আদিবাসীদের কাছে এসব পবিত্র বৃক্ষ ও স্থানের সম্পর্ক গভীর ও চিরন্তন। নিত্যদিনের পূজাপার্বণ থেকে শুরু করে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সম্পর্কিত কৃত্যসমূহ পালিত হয় এসব গাছতলাকে ঘিরে। হাওর জনগণ যেকোনো বালামুসিবত থেকে রেহাই পেতে আশ্রয় নেয় এসব গাছের কাছে। মানত থেকে শুরু করে বাৎসরিক পার্বণ কি মেলা অনেক কিছুই আয়োজিত হয় এসব পবিত্র বৃক্ষস্থানে। মূলত চৈত্রমাসে এসব গাছতলাকে ঘিরে হাওরাঞ্চলের নানান স্থানে জমে ওঠে মেলা ও বাৎসরিক কৃত্য। হাওরাবাসী শ্রদ্ধা-বিশ্বাস ও ভালোবাসায় সংরক্ষিত এসব পবিত্র বৃক্ষ ও স্থান রক্ষায় হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছেন প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক দুর্দান্ত প্রতিবেশীয় সংগ্রাম। সারা দুনিয়ায় বিলুপ্ত নরম কালো কাছিম এখনও সংরক্ষণ করে চলেছেন দেশের নিম্নবর্গের জনগণ চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারে। বাগেরহাটের খান জাহান আলী মাজারের কুমির বা সিলেটের হযরত শাহজালাল মাজারের জালালি কবুতর ও প্রবীণ গজার মাছ তো বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশের প্রান্তিক জনগণ তাদের বিশ্বাস ও ভালবাসায়। প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার নিম্নবর্গের এ সংগ্রামই দেশের কৃত্যজীবনের মূল সুর ও ব্যাঞ্জনা। কৃত্য কেবলমাত্র কোনো একটি বা একদিনের বা কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের কোনো অনুষ্ঠান বা আচার বা পার্বণ বা উৎসব বা পূজাপদ্ধতি নয়। কৃত্য একটি অঞ্চলের জনমানুষের প্রাত্যহিক ক্রিয়া ও আরাধনার সমন্বিত আখ্যান। আমরা যখনই একে বিচ্ছিন্ন করে আলাদাভাবে কেবলমাত্র কোনো একটি রীতি বা অনুষ্ঠান হিসেবে দেখি তখনই তা নিম্নবর্গের যাপিতজীবনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। কৃত্যকে দেখা ও জানাবোঝার এ অধিপতি ধারা থেকে সরে এসে নিম্নবর্গের যাপিতজীবনের সামগ্রিক প্রণালী হিসেবেই একে পাঠ করা জরুরী। কারণ নিম্নবর্গ কৃত্যের ভেতর দিয়ে কাল থেকে কালে রক্ষা করে চলে দুনিয়ার প্রাণ ও প্রকৃতির বংশধারার গতিময়তা। নিম্নবর্গের কৃত্য স্পষ্টতই জানান দেয় জল কি মাটি পতঙ্গ কি বীজ, মাছ কি মেঘ, মানুষ কি পাখি সকলেই এ দুনিয়ার সমান অংশীদার। এখানে কাউকে অন্যায়ভাবে দাবিয়ে রেখে বা বিপন্ন করে কোনোভাবেই কারো একক বিচ্ছিন্ন জীবন বিকাশ করা সম্ভব নয়। নিম্নবর্গের কৃত্যজীবন সরাসরি তার ঐতিহাসিক শ্রম ও উৎপাদন সম্পর্কের সাথে জড়িত। অধিপতি ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় বাহাদুরির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের কৃত্যসমূহ বারবার দ্রোহী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। রাষ্ট্র জনজীবনের এসব প্রশ্ন জানতে ও মানতে বাধ্য। কারণ নিম্নবর্গের লড়াকু কৃত্যজীবনের ভেতর দিয়েই রূপান্তর ঘটবে স্বপ্নময় আগামীর। প্রাণ ও প্রকৃতির আরাধনায় যেখানে সামিল হবে সকলে এক যৌথ কৃত্যের পরম্পরায়।
- লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ