বাংলাদেশ কি ১৯৬০-এর চীন হতে যাচ্ছে?
সবার জানা একটা গল্প আগে বলে নিই। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং যখন ক্ষমতায় আসেন তখন চীনের অর্থনীতি ছিল খুবই দুর্বল। ১৯৫০ সালে কোরিয়ান যুদ্ধে জড়ানোতে তা আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মাও রাশিয়ার অনুকরণে শিল্পায়নে মনোযোগ দেন। কিন্তু ১৯৫৪ সাল নাগাদ বুঝতে পারেন যে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করার মতো পুঁজিও তাদের নেই। তখন তিনি দেশকে কৃষিতে স্বনির্ভর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন যার নাম দেন 'গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড'।
আসল গল্প এটা না; এখন যেটা বলব, সেটা।
১৯৫৫ সালে মাও একটা কৃষি খামার পরিদর্শনে গিয়ে খেয়াল করেন একটা চড়ুই পাখি বারবার এসে শস্যদানা খেয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে তিনি চড়ুই পাখিকে ফসলের জন্য ক্ষতিকর এবং কৃষির উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা বলে ঘোষণা করলেন এবং পুরো দেশের সব চড়ুই পাখি হত্যার আদেশ দিলেন।
শুরু হলো পুরো দেশের সব চড়ুই হত্যার মিশন। বন্দুক, গুলতি দিয়ে হত্যা তো চললই, সাথে দেশের সব মানুষকে আদেশ দেওয়া হলো থালা-বাসন যা কিছু আছে সব নিয়ে বের হয়ে শব্দ করে চড়ুইকে তাড়া দিতে, উড়ে এসে কোনো গাছে যেন বসতে না পারে। তাড়া খেয়ে উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে মারা পড়বে চড়ুই।
সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলো চড়ুই মারার উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য। এভাবে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে দেশের সব চড়ুই মেরে ফেলতে সক্ষম হলো চীন।
কিন্তু ঘটনা ঘটলো উল্টো। দেখা গেল চড়ুই না থাকার কারণে খেতে পোকামাকড় প্রচুর বেড়ে যাচ্ছে। কারণ চড়ুই শুধু শস্য খেত না, পোকামাকড়ও খেত।
পোকার আক্রমণে সব ফসল শেষ হয়ে গেল, মানুষের খাওয়ার জন্য আর কিছুই থাকল না। শুরু হলো দুর্ভিক্ষ। ১৯৬০ সালের এই দুর্ভিক্ষে পুরো চীন জুড়ে মারা গিয়েছিল প্রায় ৪ কোটি (মতান্তরে) মানুষ।
মাও সে তুংকে আবার চড়ুই পাখি কিনে আনতে হয়েছিল।
এর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী?
আমার বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায়। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি আমন ধান ওঠার পর মাঠে তিল লাগাতে। এই ফসলে কোনো সেচ লাগত না, কোনো কীটনাশক লাগত না। সাত বা আট বছর আগে বাণিজ্যিক আকারে তরমুজ চাষ শুরু হলো, তা-ও খুব সামান্য কয়েকজন দিয়ে। তারা লাভবান হওয়ায় আস্তে আস্তে বেড়ে এখন পুরো এলাকাতেই শুধু তরমুজ চাষ হয়, তিল চাষ আর নেই। এই চাষ পুরোটাই সেচ, রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের উপর নির্ভরশীল।
আজ শুনলাম এই বছর তরমুজ খেতে পরাগায়নের জন্য কোনো পোকামাকড় আর অবশিষ্ট নেই। কীটনাশকের সৌজন্যে সব বিদায় নিয়েছে। এখন কেউ কেউ মাও সে তুংয়ের মতো মধুচাষিদের কাছ থেকে মৌমাছির বাক্স কিনে আনছে। তার থেকে ভয়াবহ সংবাদ হলো সেইসব মৌমাছি এনে বাক্স থেকে ছেড়ে দিলে তারা খেতে যাচ্ছে ঠিকই, আর ফিরে আসছে না—খেতেই সমাধি হয়ে যাচ্ছে পূর্বসূরিদের মতো। কোনো কোনো চাষি হাত দিয়েই ঘটাচ্ছেন পরাগায়ন।
এসব রাসায়নিক কীটনাশকের ফলে পরাগায়ন যারা করে, সেই পোকামাকড় আর পাখপাখালি এলাকাছাড়া হয়ে যায়ে। ফলে গোটা এলাকাই ধীরে ধীরে প্রাণবৈচিত্র্য হারাতে থাকে। তাতে ব্যাহত হয় ওই এলাকার পুরো পরাগায়ন নেটওয়ার্ক।
পরাগায়নে যেসব পোকামাকড় আর পাখি সাহায্য করে, তারা না থাকলে এলাকার পরাগায়ন প্রক্রিয়া ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের দেশের বহু এলাকার কৃষিতেও এরকম ঘটনা দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন বাঁচা যাবে? কিংবা আদৌ যাবে তো? নাকি আমরা এগিয়ে যাব ১৯৬০ সালের চীনের পরিণতির দিকেই?