বাংলাদেশের সঙ্গে সোনালি সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়া ভারতের উপরেই নির্ভর করে
মাত্র ১০ দিন আগে ঘোষিত কর্মসূচিতে জয়শঙ্কর ঢাকায় এলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং ফিরে গেলেন। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা গেল আগমনের হেতু। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানাতে তিনি এসেছিলেন।
ঘটনাটির মধ্যে খানিকটা চমক সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্যে। হঠাৎ করেই বিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা প্রকাশ করেছিলেন জয়শঙ্করের আগমনের পূর্বে। ভারতের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দ্বিপাক্ষিক একটি বিষয়। সেখানে বাংলাদেশের র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার নিষিদ্ধকরণের বিষয়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি ভারতের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য।
মজার বিষয় হলো, জয়শঙ্কর বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে যখন কথা বললেন, তখন তার দিক থেকে র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে কোনো কথাই উত্থাপিত হলো না। প্রসঙ্গটি তিনি প্রকারান্তে এড়িয়ে গেলেন। জয়শঙ্করের বাংলাদেশ ভ্রমণকে কেন্দ্র করে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের এখন সোনালি সম্পর্ক বিরাজমান। এই সময় এমনই এক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক যে দল দেশ চালাচ্ছে সেই সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা কত মধুর এবং কত গভীর হবে তা প্রশ্নযোগ্য। ভারতের সর্বত্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তথা মুসলিমবিদ্বেষী যে রাজনৈতিক মেরুকরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের মৌলবাদীদেরকে শক্তি জোগাবে কি না সেটিই আজকের বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে এক বিশাল জনগোষ্ঠী সবসময় ভারতবিরোধিতার রাজনীতি করে আসছে। তার মধ্যে অন্যতম বর্তমানের ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক দল। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের প্রধান রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতবিরোধিতা। যে জনগোষ্ঠী এখনো বাংলাদেশে সদর্পে টিকে আছে।
এমনই এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রকাশ্যে ভারতের কাছে সহযোগিতা চাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন সামনে আসে। কারণ এর ফলে দেশের মৌলবাদীদের মধ্যে নতুন শক্তি জোগাবে ভারতবিরোধিতার। হয়তো তারা নতুন যুক্তি পাবে যে ভারতীয় ইন্ধনেই এই নিষেধাজ্ঞার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সহযোগিতা চাচ্ছেন। এ বিষয় নিয়ে এমনই সব উদ্ভট রাজনৈতিক শব্দচয়ন হতে পারে।
বিশ্ব ভূরাজনীতিতে আমরা যে আমাদের মতন করেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তা প্রমাণিত হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের দুই দফা ভোটাভুটিতে। প্রথম দফায় আমরা ভারতের সঙ্গে মিলে ভোটদানে বিরত থেকেছি। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আমরা ভারতের বাইরে আমাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ভোট প্রদান করেছি।
এটাই ভূরাজনীতি। দেশ তার নিজের স্বার্থে, নিজের প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সেই কারণে ভারতের কাছে আমরা সহযোগিতা চাইতে পারি, কিন্তু সেই সহযোগিতা প্রকাশ্যে জনসম্মুখে নিয়ে আসা কতটা যুক্তিযুক্ত তা বুঝতে পারবেন আমাদের এই মেধাবী পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জয়শঙ্করের আগমন-প্রস্থানে আগামী দিনের সম্পর্ক উন্নয়নের পরবর্তী পদক্ষেপ ঘোষিত হয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন যাবত আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমোদনের প্রচেষ্টায় আছে। এ বিষয়টিতে আমাদের গভীর মনোযোগ দিতে হবে, কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের ভ্যন্তরীণ চাহিদায় এই বন্দরের কার্যক্ষমতা অনেকাংশেই ব্যর্থতার রাস্তায় হাঁটছে। পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাপক বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোকে এই সুযোগ দেওয়া কতটা সম্ভব, তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।
এনআরসি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা, তার বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করার যে রাজনীতি চলছে, তারও একটি সমাধান আসা উচিত। ভারতের আসামে বর্তমানে বিজেপি শাসন রয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশ-বিরোধিতা আসামেও ব্যাপকভাবে আছে।
পারস্পরিক সহযোগিতা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হয় না, সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রয়োজন । বাংলাদেশের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনুভূতির দিকে ভারতের বর্তমান শাসকচক্র কতটা অনুভূতিশীল সেদিকেও আমাদের রাজনীতিবিদদের মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিস্তা পানি চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল, যা এখন আমাদের দুই দেশেরই আলোচনার কেন্দ্র থেকে সরে গেছে। তিস্তা পানি চুক্তি না হওয়াতে আমাদের বড় আকারের তিস্তা প্রকল্পের কথা ভাবতে হচ্ছে। বিশাল ব্যয়বহুল এক প্রকল্পের দিকে যেতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। এমন সব অসম্পূর্ণ বিষয়ের নিষ্পত্তি না করে বাংলাদেশ-ভারতের সোনালি অধ্যায় কতটা শক্তিশালী হবে সেটাও ভাবতে হবে আমাদের ভারতীয় প্রতিপক্ষকে।