'তুমি গতজন্মে আমার মা ছিলে'
(মণীন্ত্র গুপ্তের 'অক্ষয় মালবেরি' বই থেকে ফেসবুকে এক পাতা তুলে দিয়েছেন লেখক-গবেষক কৌশিক মজুমদার। আমরা মা দিবস উপলক্ষে লেখাটি টিবিএসের পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম)
আমাদের চেনাশোনা, ভালোবাসা হবার আগেই মা যখন মারা গেলেন তখন তাঁর বয়স উনিশ বছর, আর আমার দশ মাস। মায়ের এই অসমাপ্ত জীবন বা আমার জীবন থেকে তাঁর এই চিরঅপসরণ একটা প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র। কিন্তু জন্মমৃত্যুর সঙ্গে স্ত্রীজাতির একটি অতি গহন যোগ আছে, অতএব পড়শী কুটুম্ব স্ত্রীলোকেরা আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে নিরীক্ষণ করতে করতে সখেদে বলতেন, 'হায় পোড়াকপালিয়া, জন্মাইয়াই মায়রে খাইছ! অপেক্ষাকৃত তরুণীরা ভুরুতে দুঃখ এঁকে বলত, 'আহা, অর মা নাই। কাকে খেয়েছি ? কে নেই? এসব কথায় প্রথম দিকে আমার একধরনের নির্বোধ অস্বস্তি হত। কিন্তু ক্রমাগত শুনতে শুনতে শেষে, যে নেই তার না থাকার জন্য একটা আবছা কুয়াশাভরা অপরাধ ভিতরে ছায়া ঘনিয়ে আনত। মনে হত, কোনো দুর্গম কারণে সংসারে আমি অস্বাভাবিক, এবং একা।
এই নকল দুঃখই বোধ হয় আত্মকরুণা। দুষ্টুমি করে মারধর খেলে আমি ঐ দুঃখকে খুঁজতে বেরুতাম। মুখখানা ম্লান ম্লান করে একা একা ঘুরতাম খালপাড়ে অথবা উঁচু ঢিবির উপর বিশাল শিরীষ গাছের তলায় যেখানে কেউ যায় না। সেখান থেকে দেখতাম, দিগন্তে মেঘের মধ্যে কি যেন ঘনিয়ে উঠছে। আমি মুখ নিচু করে দুঃখকে খুঁজতাম, মাটিতে কোথায় সে গেঁথে আছে ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরো হয়ে।
অবশেষে সহজাত পুরুষসংস্কার আমাকে একদিন বলল, এই জোলো হাওয়া ভালো না। তার পর থেকে স্ত্রীলোকদের ঐসব অহেতুক বাষ্পীয় মন্তব্যের সামনে পড়লে— কুমোরের ঘুরন্ত চাকায় একতাল মাটি যেমন আঙুলের চাপে টলতে টলতে শীর্ণ হয়ে ওঠে শূন্যের দিকে তেমনি কাঁচা শরীরের মধ্যে আমার স্নায়ুগুচ্ছের নাল লম্বা হয়ে হয়ে মাথা নীলের দিকে উঠত। এতকাল পরে এখন জানি, আসলে সুখও নেই, দুঃখও নেই। সংসার-সমাজের এজেন্সিগুলো আমাদের মধ্যে সুখ ও দুঃখের ধারণা জন্মিয়ে দেয়, যে ব্যথা ভোগ করার নয় সেই ব্যথা ভোগ করায়।
পরে, একটু বড় হয়ে, যেদিন মার ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, তাঁকে একমুহূর্তেই প্রত্যাখ্যান করলাম। সোজা দাঁড়ানো একটি ছিপছিপে কিশোরী, নাকে পাথর বাঁধানো নোলক। মাতৃত্ব দূরের কথা, তার ঠোঁটে চোখে চিবুকে তখনো নারীত্বই আসে নি। এই আমার মা! তবু একসময় হয়তো তাকে আমার দরকার ছিল। কিন্তু এখন, এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে, যদি সে আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়, হয়তো তাকে বলব— বোসো, একটু কিছু খাও— বিস্কুট, সন্দেশ? পারো তো আমার কাঁচাপাকা চুলে একটু বিলি কেটে দাও। যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেয়ো। তুমি গতজন্মে আমার মা ছিলে।