তিনবেলা মাংস থেরাপি!
'মাংস' শব্দটাই এদেশে বিতর্কিত। কেউ কেউ বলে থাকেন উট দুম্বা,ভেড়া মুরগী কিংবা গরু ছাগলের মাংসকে মাংস না বলে 'গোশত' বলা উচিত। জল না পানির মতো মাংস বা গোশত নিয়ে আলোচনায় না যাই। মাংস নিয়ে বাঙালির অনেক আদিখ্যেতা আছে। আজ সেসব নিয়েও আলোচনা না করি। একদা এদেশবাসীর অনেকের ভাবনাতে ছিল যে টাকা-পয়সাওয়ালারাই বেশি বেশি মাংস খেতে পারে!
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন ডিম সম্পর্কে। ছোটকালে তাঁর ধারণা ছিল একটা ডিম দুজনকে খেতে হয় কারণ তাঁর মা একটা ডিম ভেজে দুজনকে ভাগ করে দিতেন! 'সেই সব দিনরাত্রি' এখন আর নেই। এখন নাকি বাংলাদেশের মানুষ চাইলেই তিনবেলা মাংস খেতে পারে!
মাংস খাওয়া নিয়েও দুই তিনশো মতভেদ আছে! যত ডাক্তার তত মতভেদ। কোনো ডাক্তার যেমন বলেন ডিম সেদ্ধ করে খাবেন। কেউ বলবেন অনেকক্ষন ধরে ডিম ফাটাবেন,তারপর ভেজে খাবেন। কেউ ডিমের সাদা অংশ খেতে বলবেন। কেউ পানিতে ডিম 'পোচ' করে খেতে বলবেন। মাংসও তাই।
কতখানি কসাবেন সেটা কোন এক ডাক্তার বলে দেবেন। ঝোল ঝোল খাবেন না ভুনা খাবেন সেটাও কেউ কেউ সাজেস্ট করবেন। গরু ছাগল উট দুম্বার মগজ ও কলিজায় প্রোটিন কম কোলস্টেরল বেশি বলে কেউ কেউ এটা খেতে মানা করবেন। কেউ কেউ নারীদের জন্য বিশেষ দুই সময়ে আবার মাংস ডাবল খেতে বলবেন। এসব মনোযোগ দিয়ে পড়লে আপনার মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে। তারচেয়ে গরু ও বাঘ সিংহের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।
চিড়িয়াখানায় পাশাপাশি দুই খাঁচায় বাস করে বাঘিনী ও গাভি। গাভি নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব করে। বলে মানুষ আমারে নিয়ে রচনা লেখে! লেখে গরু খুবই উপকারি প্রাণী। দুধ দেয়। গাভির কথা শুনে বাঘিনী গর্জে উঠে বললো-মাংস আর দুধ দুইটাই আমার আছে। পারলে মানুষকে বলিস আমার কাছ থেকে এসব নিতে আসতে! মানুষের এই এক সমস্যা। তারা প্রশংসা করে বাঘ বা সিংহের। মাংস থায় গরুর। কিন্তু ভালোবাসে নাকি গাধাকে!
গাধা আর গরুর গোবর সম্ভবত এক সমতলের। যেমন আমার স্কুলের গনিতের শিক্ষক তৈয়ব স্যার। যে অংক পারতো না স্যার তাকে তিনবেলা গরু ট্রিটমেন্ট দিতেন। বলতেন- 'বুঝিছিস? তিনবেলা গরু খালিও তোর মগজে শুধু গোবরই জমতি থাকে,মাংস আর জমে না'। তিনবেলা গরু, মহিষ বা ছাগলের মাংস খেলে কী মাথায় গোবর জমার সম্ভাবনাও থাকে?
২০২২ এর মে মাসে দেশের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম.রেজাউল করিম বলেছেন- 'বাংলাদেশের মানুষ চাইলেই তিনবেলা মাংস খেতে পারে'। এটা ঠিক ১৮ কোটি মানুষের ভেতর বিশ ত্রিশ লাখ হয়তো তিনবেলা মাংস খেতে পারে। মন্ত্রী সাহেব কী তাদেরই মানুষ বলেছেন? বাকিরা কী তার মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্য কোন প্রাণী? যাই হোক আমরা আপাততঃ তিনবেলা মাংসের ভেতরেই থাকি।
মাংস মূলত দুই ধরনের। লাল ও সাদা! মাংসে মায়োগ্লোবিন নামের প্রোটিন বেশি থাকলে অক্সিজেনের সংস্পর্শে সেটা লাল অক্সিহিমোগ্লোবিন তৈরি করে এবং মাংস লালচে বর্ণ ধারণ করে। গরু,ছাগল,ভেড়া,উট,দুম্বা,শূকর এর মাংস হচেছ লাল মাংস বা রেড মিট। মুরগি,হাস,কবুতর,কোয়েল বা বিভিন্ন পাখির মাংসকে চিহ্নিত করা হয় সাদা বা হোয়াইট মিট হিসেবে। মন্ত্রী সাহেব অবশ্য নির্দিষ্ট করে বলেননি যে তিন বেলা মানুষ কোন মাংস খাবে? সাদা না লাল?
গরুর মাংসে মানব স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকলেও এই মাংসে প্রোটিন ও ক্যালরির মাত্রা বেশি থাকে। গরুর চেয়ে মহিষের মাংস ও দুধে উপকার বেশি। তবু এদেশে গরুর নামে মহিষের মাংস বিক্রি হয়। সৎ মা'র মতো এদেশে মহিষেরা বরাবরই অবহেলিত।
ছাগলের মাংস জনপ্রিয় হলেও ভেড়ার মাংস তেমন জনপ্রিয় নয়। তবে ছাগল ভেড়া বা মহিষের মাংস সব ধর্ম ও শ্রেণির মানুষ খেতে পারে। যদিও গত সাত বছরে মাংস খাদকদের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে ক্রমশঃ কমছে। যুক্তরাজ্যে প্রতি তিনজনে একজন মাংসাসী নন আর যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা তিনজনে দুইজন।
বয়স হয়ে গেলে নিয়মিত মাংস খাওয়ার অভ্যাস থাকলে বুকে প্রতিক্রিয়া হয়। হার্ট ডিজিজ বা হৃদয়ের রোগ হলে মাংস খেতে বারন করা হয়ে থাকে। আর 'পাইলসে'র রোগীরাও মাংস থেকে বেশ দূরে থাকেন। তারপরও তিনবেলা মাংস ট্রিটমেন্ট দেওয়া হলে মানুষ বাঁচবে তো?
এবার দামের দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০২০-২১-২২ সালে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লাল ও সাদা মাংসের দাম! ৭০০ টাকা কেজি দরে ক'জন প্রতিদিন গরুর মাংস কিনতে পারে? নাকি যারা কিনতে পারে মন্ত্রী তাদের কথাই বলেছেন? মাংস রান্না করতে তেলসহ আর যা যা লাগে তার দাম কত? জানি মনের দুঃখে খেটে খাওয়া মানুষ এই হিসেব করবে না। তারা হয়তো কোরবানি ঈদের জন্য অপেক্ষা করবে যদি কিছু মাংস 'দান' পাওয়া যায়! নাকি যে যায় লংকায় সে যেমন রাবন হয় তেমনি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সব কিছুতেই কী গরু ছাগল গাধার ছোঁয়া থাকে?
তাহলে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা? তিনবেলাই কী মাংস খাওয়া উচিত? পাইলস আর হার্টের রোগীদের তাহলে কী হবে? যারা মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন তারা কী করবেন? তিনবেলা মাংস রান্না কী তেলসহ করতে হবে নাকি তেল ছাড়া ঝলসে ঝলসে খেতে হবে? আচ্ছা পৃথিবীর কোন কোন দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মাংস খায়?
যুক্তরাজ্যে ও যুক্তরাষ্ট্রে শাক সবজি খাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও রেডমিট বা লাল মাংস খাওয়া লোকের সংখ্যাও প্রচুর। অস্ট্রেলিয়া,নিউজিল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের মানুষরাও প্রচুর পরিমাণে মাংস খায়। এক জরিপ থেকে জানা যায় আফ্রিকার কিছু গরীব দেশের মতো এশিয়ার তুলনামূলক গরীব দেশগুলোর মানুষও খুব কমই মাংস খায়। বাংলাদেশে মাংসাসী মানুষের কোন পরিসংখ্যান আছে নাকি মন্ত্রী এই ডায়ালগ দুম করে বলে ফেলেছেন কোন কিছু না ভেবেই? এদেশের মানুষের কাছে রাজকীয় খাবার মুরগির মাংস বা ছোট মাছ, গরু,ছাগল,মহিষ নয়! তাহলে?
তাহলে মন্ত্রী যা বলেছেন সেটাই মানতে হবে। কিন্তু কীভাবে? নীচের গল্পটা খেয়াল করুন।
এক লোক গরু নিয়ে কোরবানির হাটে গেছে। দুইদিন পার হলেও সেটা বিক্রি হয়নি। মন খারাপ করে গরু নিয়ে ফেরত আসার সময় তাকে ডাকাত ধরলো। লোকটি অনুনয় বিনয় করে বললো-ভাই আমার কাছে টাকা নেই। বিক্রি হলে না হয় কিছু টাকা পেতাম। ডাকাতরা তাকে আবার হাটে ফেরত পাঠালো। পরদিন গরু বিক্রি হলো। টাকা নিয়ে ফেরার সময় লোকটির ডাকাতদের কথা মনে হলো। সে গরু বেচা টাকা দিয়ে দুটো মাঝারি আকারের গরু কিনে ফিরছিল। পথে আবার ডাকাত ধরলো। লোকটা বললো-ভাই অবস্থা খুব খারাপ। গরু শুধু যে বিক্রি হয়নি এমনও না। লোকজন জোর করে গরু দান করছিল। আমি নিয়ে যেতে পারবো না বলে আমার গরুটার সাথে মাত্র একটা দানের গরু নিয়ে এসেছি!
ডাকাতদের চক্ষু ছানাবড়া। এই গল্প শুনে চক্ষু ছানাবড়া করে লাভ নেই। টিসিবির ট্রাকে চাল,ডাল তেল কম দামে দেবার মতো মন্ত্রী সাহেব যদি কিছু গরু দান করার ব্যবস্থা করতেন তাহলে এদেশের মানুষ নিশ্চিতভাবে তিন বেলাই মাংস খেতে পারতো!
আহসান কবির: রম্য লেখক