বিমার আদলে সর্বজনীন পেনশন: যেসব প্রশ্নের মীমাংসা করা জরুরি…
বেসরকারি চাকরিজীবীদের সবচেয়ে বড় আফসোস, তাদের কোনো পেনশন নেই। যত বড় পদেই চাকরি করুন না কেন, অবসরে যেতে হয় শূন্য হাতে। অবশ্য যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচ্যুয়িটি ইত্যাদি সুবিধা আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দীর্ঘদিন চাকরি করার পরে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে গেলে কিংবা অবসরে গেলে কিছু টাকা পান। তবে সেটা পেনশন নয়। অথচ খুব কম বেতনের একজন সরকারি কর্মচারীও অবসরে গিয়ে পেনশন পান—যা তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা কমায়। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি বেতন পেলেও পেনশন না পাওয়ার দুঃখবোধ তাদের থেকেই যায়।
এরকম বাস্তবতায় আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফাকা কামাল। ৯ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে বয়োজ্যেষ্ঠ জনসংখ্যার তুলনায় কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) থাকায় এটাই সর্বজনীন পেনশন চালুর উপযুক্ত সময়। মন্ত্রী জানান, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সকল বাংলাদেশি নাগরিক এর সুবিধা নিতে পারবেন।
কিন্তু যে পদ্ধতিতে এই সর্বজনীন পেনশন চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি আসলে একধরনের বিমা। অর্থাৎ নাগরিকরা প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা জমা রাখবেন এবং ৬০ বছর বয়স হওয়ার পরে তিনি সেই জমাকৃত টাকার অনুপাতে প্রতি মাসে পেনশন হিসেবে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা পাবেন।
তার মানে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পেনশনের যে পদ্ধতি, প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন সেরকম নয়। সরকারি কর্মচারীদের জন্য মূলত থোক বরাদ্দ দিয়ে পেনশন দেয়া হয়। কিন্তু যে পদ্ধতি ও শর্তে সর্বজনীন পেনশন চালুর কথা বলা হচ্ছে, সেটি একধরনের বিমা। ফলে এখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই অংশগ্রহণ করবে কি না; বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষেরা কী করে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা জমা দেবেন, নাকি তাদের জন্য আলাদা পদ্ধতি থাকবে—সেটিও পরিষ্কার নয়।
বাস্ততা হলো, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো না থাকায় সরকারি চাকরিজীবী এবং সচ্ছল মানুষেরা বাদে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। সরকারি হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। এই সংখ্যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ এখন যাদের বয়স ৪২ বা তার বেশি, যারা ২০৪১ সালে ষাটোর্ধ্ব হয়ে যাবেন। যেহেতু দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে; মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে; চিকিৎসা ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে, ফলে ষাট এখন আর বৃদ্ধ হবার বয়স নয়। কিন্তু চাকরি থেকে যদি অবসরে যেতে হয় এবং যদি পেনশনের ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সেই বিপুল জনগোষ্ঠীকে তাদের সন্তানদের উপরে নির্ভর করতে হয়। যদি সন্তান না থাকে বা সন্তান যদি দেখাশোনা না করে, তাহলে জীবনযাপন খুবই অনিশ্চয়তায় পড়ে। এরকম বাস্তবতায় একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাই পারে সেই বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনের অনিশ্চয়তা দূর করতে—কর্মহীন হয়ে পড়লেও বৃদ্ধ বয়সে যাদেরকে অন্তত ভাত-কাপড়ের চিন্তা করতে হবে না। সেই বাস্তবতায় আগামী অর্থবছর থেকেই সর্বজনীন পেনশন চালুর সিদ্ধান্ত সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু এর প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন নাগরিকদের মনে রয়েছে।
কত টাকা জমার বিপরীতে কত টাকা পেনশন?
সরকার যে পরিকল্পনা করছে তাতে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি কোনো নাগরিক যদি মাসে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা জমা করেন, তাহলে তার বয়স ৬০ পার হলেই সরকার তাকে প্রতি মাসে পেনশন দেবে ৩২ হাজার টাকা। আর অর্থের পরিমাণ যদি এক হাজার টাকা হয়, তাহলে তিনি পাবেন ৬৪ হাজার টাকা। সক্ষমতা অনুযায়ী ৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত জমা করা যাবে। এটা ঠিক যে, যিনি এখন সবচেয়ে কম আয় করেন, তিনিও প্রতি মাসে ৫০০ টাকা অনায়াসেই দিতে পারবেন। তাছাড়া ৬০ বছর বয়স পার হলে প্রতি মাসে তিনি ৩২ হাজার টাকা পাবেন—এই নিশ্চয়তা পেলে কে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা জমা করবেন না? কিন্তু এই হারে টাকা পেতে হলে তাকে টাকা জমা দিতে হবে ১৮ বছর বয়স থেকে।
আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ ১৮ বছর বয়সে আয় শুরু করেন না। যদি তিনি ২৫ বছর বয়সে আয় শুরু করেন, তাহলে ১৮ বছর থেকে ওই ৭ বছর তার অভিভাবককে টাকাটা জমা দিতে হবে। সেই সক্ষমতা সব অভিভাবকের না-ও থাকতে পারে। আবার যিনি ৩০ বছর বয়সে বা এখন যার বয়স ৫০ বছর, তিনি যদি পেনশন পাওয়ার জন্য টাকা জমা দেয়া শুরু করেন, তাহলে একটানা অন্তত ১০ বছর জমা দেয়ার পরে তিনি কত টকা জমা দিলেন সেই অনুপাতে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে পেনশন পাবেন। তার মানে সবাই যে মাসে ৩২ হাজার টাকা বা ৬৪ হাজার টাকা পাবেন, বিষয়টা এমন নয়। সুবিধা পাবেন তারা, যারা কম বয়সে চাঁদা দেয়া শুরু করবেন এবং দীর্ঘজীবী হবেন। ধরা যাক তিনি যদি ৮০ বছর বাঁচেন, তাহলে ৬০ বছর থেকে পরবর্তী ২০ বছর তিনি পেনশন পাবেন। এটা তার জন্য বিরাট সহায়ক হবে।
৬০ বছরের আগে মারা গেলে কী হবে?
কেউ ৫৮ বছর পর্যন্ত চাঁদার টাকা জমা দেয়ার পরে ৫৯ বছরে মারা গেলে তার পরিবার বা উত্তরসূরি ওই জমাকৃত টাকার বিপরীতে এককালীন কোনো টাকা পাবেন কি না, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ যে পদ্ধতিতে টাকা নেয়া হবে, সেটা একধরনের বিমা। বিমাকৃত ব্যক্তি মারা গেলে তার উত্তরসূরি আর্থিক সুবিধা পায়। সে হিসেবে সর্বজনীন পেনশনের জন্য যিনি টাকা জমা দেবেন, ৬০ বছর বয়সের আগে তার মৃত্যু হলে সেই জমাকৃত টাকার অনুপাতে তার উত্তরসূরি যাতে আর্থিক সুবিধা পান, সেটি বিবেচনায় নেয়া দরকার।
যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি ও ষাটের কম…
সর্বজনীন পেনশন চালুর বিষয়টি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও আরেকটি বিষয় পরিষ্কার নয়, তা হচ্ছে, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষেরা প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা জমা দিয়ে পেনশনের আওতায় আসতে পারবেন। কিন্তু যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি কিন্তু ষাটের কম, তারা কীভাবে এই ব্যবস্থার আওতায় আসবেন? যারা এখন ৬০ বছর বয়স অতিক্রম করেছেন, কিন্তু সরকারি চাকরি করেননি, তাদের জন্য কী বিধান হবে? স্বামী-স্ত্রী দুজনই কি একই স্কিমে পেনশনধারী হতে পারবেন, নাকি একজনের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে এবং একজনের অবর্তমানে অন্যজন একই সুবিধা ভোগ করবেন? এই প্রশ্নগুলোর সুরাহা করা জরুরি এবং বিমার আদলে সর্বজনীন পেনশন চালু করা হলে সেখানে সচ্ছল মানুষেরা যতটা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসবে, অসচ্ছল ও স্বল্প আয়ের মানুষ সেই উৎসাহ নাও দেখাতে পারে। সে কারণে দরিদ্র মানুষদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে।
৮০ বছরের বেশি বাঁচলে কী হবে?
প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশনের যে খসড়া আইন করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ৬০ বছর পূর্ণ হলে অর্থাৎ পেনশন পাওয়া শুরুর পরে ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি বাকি সময়কালের (মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। আর যদি তিনি বেঁচে থাকেন তাহলে ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত। অর্থাৎ একজন মানুষের বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ বয়স ধরা হয়েছে ৮০ বছর। যদি কেউ ৮০ বছরের বেশি বাঁচেন—তার ক্ষেত্রে কী হবে? তিনি যদি ৮৫ বছর বাঁচেন তাহলে বাকি ৫ বছর কেন তিনি এই সুবিধা পাবেন না? যদি তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল না হন, যদি তাকে দেখভালের মতো উত্তরসূরি না থাকে তাহলে তার জন্য কি বর্তমানে চালু থাকা বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচির কোনো একটি থাকবে?
আয়করের সঙ্গে একীভূত নয় কেন?
বস্তুত পেনশনকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তাদের আয়কর ও পেনশনকে একীভূত করা প্রয়োজন। অর্থাৎ আয়করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশনব্যবস্থা যুক্ত করতে হবে। সামরিক, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বাইরে যেসব বেসরকারি চাকরিজীবী ও অন্যান্য পেশার লোক কর দেন, ৬০ বছর বয়স হয়ে গেলে তাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এতে করে কর প্রদানে মানুষের উৎসাহ বাড়বে।
১৭ কোটি মানুষের দেশে এখন নিয়মিত কর দেন এমন লোকের সংখ্যা সম্ভবত ৮ লাখও নয়। এটা খুবই লজ্জার। অথচ কর দেয়ার সামর্থ্য রাখেন এরকম লোকের সংখ্যা এক কোটির কম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মানুষ কর দিতে চায় না। কারণ সে জিজ্ঞেস করে, কর দিয়ে কী লাভ? কর দিয়ে যেসব লাভ হয়, তা সে সাদা চোখে দেখতে চায় না। কিন্তু তাকে যদি এই নিশ্চয়তা দেয়া যায় যে আপনি নিয়মিত কর দিলে ৬১ বছর বয়স থেকে পেনশন পাবেন—তখন কর প্রদানকারীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। মানুষ উৎসাহী হবে। আর যেসব দরিদ্র মানুষ কর দিতে পারেন না, তারাও পেনশন পাবেন। সেজন্য তাদের মাসে মাসে চাঁদা দেয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। রাষ্ট্র এখন সরকারি কর্মচারীদের জন্য যেভাবে থোক বরাদ্দ দিয়ে পেনশন দেয়, গরিব ও কর প্রদানে সক্ষম নয় এমন মানুষদের জন্যও সেভাবে থোক বরাদ্দ দিয়ে পেনশন দেয়া উচিত। এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মানুষদের কিছু সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু এই সুবিধাকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা কমিয়ে আনা যাবে। তবে যাদের বয়স ৬০ বছরের কম, কিন্তু দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধিতা, প্রান্তিক পেশা ইত্যাদি নানা কারণে আর্থিকভাবে সচ্ছল নন, তাদের জন্য পেনশনের বাইরেও বর্তমানে চালু থাকা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে প্রতি বছরই এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
পরিশেষে, আগামী বাজেট হবে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট। কারণ আগামী বছরের ডিসেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সুতরাং, জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগের জাতীয় বাজেট রাজনৈতিক কারণেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বপূর্ণ বাজেটে সর্বজনীন পেনশনের মতো একটি বহুল প্রত্যাশিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি চালু করা গেলে সেটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভোটের রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা দেবে—তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যেসব প্রশ্ন ও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে, সেগুলো দূর করা দরকার। তাহলেই রাষ্ট্রের সব মানুষের বৃদ্ধ বয়সকে আর্থিক অনিশ্চয়তার হাত থেকে বাঁচানোর একটি মানবিক ও কার্যকরী উদ্যোগ সফল হতে পারে।
- আমীন আল রশীদ: নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর