বাইডেন কেন সৌদি আরব যাচ্ছেন?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন। পশ্চিম জেরুজালেমের রাস্তায় এখন যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের পতাকা শোভা পাচ্ছে।
প্রেসিডেন্টের আগমন উপলক্ষে শহরটিতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার ইসরায়েলি পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শহরটিতে।
জেরুজালেমের বাসিন্দা আভি আভিসানা বলেন, 'জেরুজালেমে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আগমন বেশ আনন্দ ও সম্মানের৷ কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের তার জন্য কিছু দাম চোকাতে হয়। শহর বন্ধ করে দেওয়া হবে আর আমরা বাড়িঘর ছেড়ে বেরোতে পারব না।'
মার্কিন মিত্রতায় পরিবর্তন
মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানাবেন ইসরায়েলের বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিড। বাইডেনকে ইসরায়েলে আমন্ত্রণ জানানো নাফটালি বেনেট কেবল দুসপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেছেন।
ইসরায়েল থেকে মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু করবেন জো বাইডেন। পশ্চিম তীরে খানিকক্ষণ যাত্রাবিরতি করে সরাসরি ইসরায়েলে যাবেন তিনি। সেখান থেকে সৌদি আরবে।
২০১৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইসরায়েল সফর করেছিলেন বাইডেন। তারপর থেকে ওই অঞ্চলে কমপক্ষে একটি নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ট্রাম্পের শাসনামলে দ্য আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেছিল ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও আরব লীগের অন্যান্য দেশগুলো।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরকে নিবিড় মিত্র হিসেবে বিবেচনা করলেও কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্য অঞ্চলেও নিজের কৌশলগত আগ্রহ বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে।
সেনিয়া ভেটলোভা নামক একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, 'এ অঞ্চল (মধ্যপ্রাচ্য) থেকে নিজেদের মনোযোগ সরিয়ে ফেলতে অক্ষম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমরা ইরানের সঙ্গে কিছু সন্ধিক্ষণে পৌঁছাচ্ছি। এ অঞ্চলে মার্কিন মিত্রদের একটি শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী আমেরিকার প্রয়োজন, যেটি কিনা অন্য শক্তি দ্বারা পূর্ণ হতে পারে এমন কোনো শূন্যস্থান এখানে তৈরি করে রেখে যাবে না।'
গত কয়েক বছরে ইরানের নিউক্লিয়ার শক্তি বিষয়ক দুশ্চিন্তা ইসরায়েল ও বিভিন্ন উপসাগরীয় দেশকে এক পাল্লায় নিয়ে এসেছে।
গত রোববার মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিড বলেন, 'এ সফরে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ দুটো নিয়ে আলোচনা করা হবে। চ্যালেঞ্জের আলোচনার পুরোভাগে থাকবে ইরান সমস্যা।'
সৌদি আরব বনাম ইসরায়েল
বাইডেনের বর্তমান সফর নিয়ে ইসরায়েল ও আরব কিংডমের মধ্যে সম্পর্কে নতুন হাওয়া লাগতে পারে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।
সৌদি আরব সবসময় জানিয়েছে, স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না দেশটি। তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো আপাত সমাধান দৃষ্টিগোচর না হওয়া সত্ত্বেও সৌদি আরবের অবস্থান কিছুটা নরম হয়েছে বলে ঠাহর করা যাচ্ছে।
গত শনিবার বাইডেনের লেখা একটি মতামত প্রকাশ করেছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। 'আমি কেন সৌদি আরবে যাচ্ছি' শিরোনামের ওই লেখায় বাইডেন জানিয়েছেন, তিনিই হতে যাচ্ছেন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েল থেকে সরাসরি সৌদি আরব যাবেন। এটিকে তিনি বর্ণনা করেছেন 'ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের বিকাশমান সম্পর্ক ও দুই পক্ষের মধ্যকার স্বাভাবিকীকরণের প্রতীক' হিসেবে।
বাইডেনের সৌদি আরব সফরের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নীতির পরিবর্তনও ইঙ্গিত করবে। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যা ও অন্যান্য মানবাধিকার বিষয়ক ব্যর্থতার কারণে নিজের প্রেসিডেনসিয়াল ক্যাম্পেইনের সময় বাইডেন বলেছিলেন সৌদি আরবের সঙ্গে 'একঘরে' হিসেবে আচরণ করা উচিত।
তবে এবারের সফরে বাইডেন জেদ্দায় গালফ কোঅপারেশনাল কাউন্সিল সামিটে আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিতর্ক শান্ত করবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের জন্য 'সোনালী যুগ'
এসব সত্ত্বেও সৌদি আরব ও ইসরায়েল সম্পর্কের এই প্রকাশ্য স্বাভাবিকীকরণ কিছুটা অকালপক্ব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
হার্জলিয়া'র ইনস্টিটিউট ফর পলিসি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি'র নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল আমস গিলিড বলেন, 'সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। ভালো খবর হচ্ছে, অতীতের তুলনায় সৌদি আরব এখন আর ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করছে না।'
তিনি আরও জানান, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে অনেক অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি এ পরিস্থিতিকে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর 'সোনালী যুগ' হিসেবে অভিহিত করেন।
২০২১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই বছর পেন্টাগন ইসরায়েলকে ইউএস ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল কমান্ড থেকে সেন্ট্রাল কমান্ডে (সেন্টকম) নিয়ে আসে। এ পরিবর্তনের ফলে ইসরায়েল এখন- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে- আরব দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহায়তায় যুক্ত হয়েছে।
বাইডেনের সফর প্রসঙ্গে বিভিন্ন ইসরায়েলি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে 'আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম' বা 'আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা জোট' ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এমনটা হলে এই অঞ্চলে ইসরায়েল আরও সংগঠিত হবে।
সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বেথেলহামে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে। এছাড়া তিনি পূর্ব জেরুজালেমে একটি ফিলিস্তিনি হাসপাতাল পরিদর্শন করবেন বলেও আশা করা যাচ্ছে।
বেথেলহাম ভ্রমণ প্রসঙ্গে ২০ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী সাইমন রিশমাওই বলেন, 'ফিলিস্তিনি জনগণের এটা সত্যিই দরকার। কারণ আমরা কেবল পেছনের দিকে যাচ্ছি। বিশ্ব আমাদের কথা শুনছে না, কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।'
আরেক শিক্ষার্থী মিরাল আসাফও এমনটাই মনে করেন। তার আশা, প্রেসিডেন্ট বাইডেন 'বাস্তব চিত্রগুলো' দেখবেন, 'এখানে যা ঘটেছে তার অনেকটাই গণমাধ্যমে বিকৃতভাবে দেখানো হচ্ছে।'
অতীতে বাইডেন দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের জন্য ইসরায়েলকে সেটেলমেন্ট আর না বাড়ানোর আহ্বান করেছিলেন। তবে এ সফরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে নিয়ে তিনি কিছু ঘোষণা দিলেও, সমস্যা সমাধানে আপাতত বড় কোনো পরিকল্পনা তার নেই।
দ্য পোস্ট-এর মতামতে বাইডেন জানিয়েছেন, 'তার প্রশাসন কংগ্রেসের সঙ্গে একত্রে ফিলিস্তিনের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা ও ইসরায়েলের জন্য ইতিহাসের সর্ববৃহৎ চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে।'
মার্কিন-ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা
মার্কিন-ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ হত্যার তদন্তে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া থেকে এখন পর্যন্ত বিরত থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেনের ফিলিস্তিন সফরজুড়ে এ ঘটনায় ফিলিস্তিনের অসন্তোষের ব্যাপারটিও জুড়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জো বাইডেনের প্রতি এক খোলা চিঠিতে শিরিন আবু আকলেহ'র পরিবার নিজেদের হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সাংবাদিকের খুনের ঘটনায় জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে আহ্বান করেছেন। এছাড়া চিঠিতে তার সফরের সময় ওই পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে প্রেসিডেন্টকে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে