ফোনের ডেলিভারি না পাওয়ায় যেভাবে মিলল কোটি ডলারের ব্যবসার আইডিয়া
স্যামি মার্টিনেন কিনতে চেয়েছিলেন সেকেন্ড হ্যাড মোবাইল ফোন। বছর সাতেক আগে তিনি অনলাইনে অর্ডারও করেন সংস্কার করা পুরোনো একটি আইফোন-৬। পণ্যের দামও মিটিয়েছিলেন, কিন্তু ডেলিভারি আর পাননি।
খোঁজ নিয়ে জানলেন তিনি একা নন, এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। খানিকটা অনুসন্ধানী গবেষণা করে স্যামি জানতে পারলেন, স্মার্টফোন যতটা দূষণ করে- তার ৮৩ শতাংশ হয় পণ্যটির উৎপাদন ও বিতরণ প্রক্রিয়ায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর স্মার্টফোনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে বাণিজ্যিক পরামর্শক ও অডিট সংস্থা ডেলইট্ট এর গবেষণা। অথচ, এনিয়ে খুব কম মানুষই ভাবছে। বেশিরভাগই ছুটছেন নিত্যনতুন মডেলের স্মার্টফোন কিনতে।
বাজার গবেষণা তাকে জানালো, বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ সংস্কারকৃত পুরোনো মোবাইল ডিভাইস কিনছে। অনলাইন জালিয়াতদের দৌরাত্ম কমিয়ে কীভাবে এই বিক্রি বাড়ানো যায় ভাবতে শুরু করেন মার্টিনেন। এই ভাবনা থেকেই ২০১৬ সালে ব্যবসায়ীক অংশীদার জিরি হেইনোন-কে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন সোয়াপি। পুরোনো আইফোন সংস্কার ও বিক্রির লক্ষ্যে ব্যবসাটি যাত্রা শুরু করে।
সোয়াপি যখন যাত্রা শুরু করে তখন ইউরোপে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোনের বাজার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ (মোট স্মার্টফোন বাজারের)। বর্তমানে বাজার দখল তিনগুণ বেড়েছে বলে জানাচ্ছে গ্লোবাল রিফ্রাব্রিশড স্মার্টফোন মার্কেট রিপোর্ট।
মার্টিনেন বলেন, '১৯৯০ এর দশকে সেকেন্ড- হ্যান্ড গাড়ির বাজার যেভাবে বিকশিত হয় সংস্কার করা স্মার্ট মুঠোফোনের বাজারেও তা ঘটেছে। যেমন ৯০ এর দশকে মোট গাড়ি বিক্রির মাত্র ১০ শতাংশ ছিল ব্যবহৃত গাড়ি, কিন্তু বর্তমানে ৫০ শতাংশ বা অর্ধেক বাজার নিয়ন্ত্রণ এ ধরনের গাড়ির বিকিকিনি। আশা করি, মুঠোফোনের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হবে'।
সোয়াপির সদর দপ্তর ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি-তে। গত পাঁচ বছরে তাদের সেকেন্ড-হ্যান্ড মুঠোফোন বিক্রিতে হয়েছে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি। ২০১৭ সালে কোম্পানির আয় ৫ লাখ ডলার হলেও, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৭০ লাখে।
১০ বছর ধরে জমানো ব্যক্তিগত সঞ্চয় লগ্নী করে স্টার্টআপটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মার্টিনেন। ২০২০ সালে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগকারী সংস্থা- ভারডান, লাইফলাইন ভেঞ্চার্স-সহ অন্যান্য পরিবেশবাদী বিনিয়োগকারীদের থেকে তিনি ১৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ লাভ করেন।
সোয়াপির দুই প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ করেছেন যে, নতুন স্মার্টফোনের দাম এখন ক্রমাগত বাড়ছে। অথচ ১০ বছর আগের স্মার্টফোনে যে মৌলিক উদ্ভাবনগুলি ছিল- তার চেয়ে সাম্প্রতিক মডেলে খুব বেশি উল্লেখযোগ্য রদবদল হচ্ছে না। মূল আপগ্রেড আসছে সফটওয়্যার।
মার্টিনেন বলেন, 'এখন ডিভাইস আপগ্রেডের চক্র বেশ দীর্ঘ। ভোক্তাদের অনেকে প্রতিবছর তাদের মুঠোফোন বদলান না। টাকা বাঁচাতে তারা পুরোনো মডেলের ফোন কিনতেও এখন আগ্রহ দেখাচ্ছেন।'
পরামর্শক সংস্থা ক্যান্টার- এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চে স্পেন, ইতালি, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের ভোক্তারা ২০১৯ সালের মার্চের তুলনায় গড়ে তিন মাস বেশি সময় ধরে ব্যবহার করেছেন তাদের মুঠোফোন ডিভাইস।
ভোক্তাপণ্যের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে ইউরোপে সচেতনতা বাড়ছে। সেকারণে ভোক্তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তেও পড়ছে এর প্রভাব। বিশেষ করে, তরুণরা বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। বিশেষত, মিলেনিয়ালরা এখন সংস্কার করা ডিভাইসে ঝুঁকছেন, পণ্যের টেকসইতার বিচারে।
এই ব্যবসার একটি বড় সমস্যা অবশ্য ব্যবহারকারীরাই। মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যবহারকারী তাদের ফোন পুরোনো হলে- সেটিকে সংস্কারের জন্য বিক্রি করেন। অর্থাৎ, তারা বাজারে পুরোনো পণ্য ছাড়তে নারাজ–কারণ তারা অন্যের হাতে কম মানসম্পন্ন যাক সেটি চান না। এক কথায় আস্থায় একটি বড় ঘাটতি আছে, যা কাটিয়ে উঠতে পুরোনো স্মার্টফোন কেনাবেচাকারী ব্যবসায়কে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
টেকসই ভোক্তাপণ্য
পুরোনো ফোন ব্যবহার করায় নতুন ফোন উৎপাদন ও বিপণনের দূষণ কমছে। ফলে পুরোনো ফোনই পরিবেশগত দিক থেকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই পণ্য হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে ১৫টি দেশে চলছে সোয়াপির কার্যক্রম। সবচেয়ে বড় বাজার- ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও ইতালি। বড় দুটি বাজারই উত্তর দিকে হওয়ার কারণ, দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলির তুলনায় নরডিক অঞ্চলের দেশগুলি পণ্যের পুনর্ব্যবহারে অনেক বেশি সচেষ্ট। সে তুলনায় দক্ষিণ ইউরোপীয়রা এখনও সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য কিনতে দ্বিধা করেন। এমনটাই জানান সোয়াপির স্পেন শাখার নির্বাহী পরিচালক ফ্যানি নিম্যান।
কোম্পানিটির সাম্প্রতিকতম জরিপ অনুসারে, ৭০ শতাংশ স্পেনিয় ভোক্তা সংস্কারকৃত পুরোনো পণ্য কেনার কথা ভাবলেও, কেনার সময় তাদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সংস্কারকৃত পণ্য কেনেন।
সোয়াপি তাদের পুরোনো আইফোনেও দেয় দুই বছরের ওয়ারেন্টি। কিন্তু, দক্ষিণ ইউরোপীয় বেশিরভাগ ভোক্তাই এসব বিষয়ে সচেতন নন।
ফ্যানি নিম্যান বলেন, 'সংস্কারকৃত পণ্য কেনার আগ্রহ ও প্রকৃত ক্রয়ের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। অনেক ভোক্তাই জানেন না, সেকেন্ড হ্যান্ড ডিভাইস খুঁটিনাটি পরীক্ষার পর তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কারিগরি যেকোনো ত্রুটি দেখা দিলে তার জন্য থাকে ওয়ারেন্টির ব্যবস্থা। সেজন্য এখন ব্রান্ডিং ও প্রচারণায় মনোযোগ দিচ্ছি আমরা। ইতালির বাজারে নতুন কৌশলের সাফল্যও মিলছে'।
- সূত্র: এল পাইস