মাছ ধরতে গিয়ে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া তামিলনাড়ুর জেলেদের বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন!
গত বছরের ২৭ নভেম্বর এডিসন ডেভিস আর অগাস্টিন নিমাস যখন দক্ষিণ ভারত উপকূলে মাছ ধরার জন্য বাড়ি থেকে রওনা দিচ্ছিলেন, তখন পরিবারকে বলেছিলেন বড়দিনের আগে বাড়ি ফিরে আসবেন, উদযাপন করবেন একসঙ্গে। কিন্তু এরপরে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলেও তাদের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এডিসন আর নিমাসের পেশা সমুদ্রে মাছ ধরা। ঝড়-বাদল, উত্থান-পতন তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। বিপদকে তারা ভয় পান না; হয়তোবা মৃত্যুকেও নয়! কিন্তু জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দিনের পর দিন যে সমুদ্রে আটকে থাকতে হবে, তা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি ভারতের এই দুই জেলে।
শুরুতে এডিসন ও নিমাসের পরিবার তাদেরকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেনি। যেহেতু সমুদ্রে মাছ ধরে তারা অভ্যস্ত, তাই কিছুদিন দেরি হওয়াকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল তাদের পরিবার। কিন্তু দিন যত পার হতে থাকে, বড়দিন আসে এবং চলেও যায়, তখনই চিন্তা বাড়তে থাকে পরিবারের। বুঝতে পারেন না কী হয়েছে এই জেলেদের। একবার পরিবারের সদস্যদের মনে হয়, কোনো ঘূর্ণিঝড়ে হয়তো নৌকা উল্টে গিয়েছে, সবার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের কোনো পূর্বাভাসও তাদের কানে আসেনি।
শেষ পর্যন্ত এবছরের ২ জানুয়ারি ঘরে ফেরেন জেলেরা। তাদের মুখ থেকেই শোনা যায় ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা- কিভাবে ব্রিটিশ মহাসাগর এলাকার অন্তর্ভুক্ত একটি জনহীন দ্বীপে দিন কাটিয়েছেন তারা, লড়াই করেছেন টিকে থাকার জন্য!
১৫ জন জেলের একটি দলের অংশ ছিলেন এডিসন ও নিমাস। এই দলটি আরব সাগরে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে তিন সপ্তাহের জন্য যাত্রা করেছিল।
তামিলনাড়ুর থেঙ্গাপত্তনম বন্দর থেকে কাঠের নৌকায় রওনা হয়েছিল ১৫ জন জেলের দলটি। নৌকার নাম ছিল ক্রিশা মোল। রওনা হওয়ার পর সপ্তম দিনে নৌকার ইঞ্জিন ভেঙে যায়, তারপর এটি গভীর সমুদ্রের দিকে এগোতে থাকে। এভাবে পাঁচ দিন চলার পর শ্রীলঙ্কার মৎস্যজীবীদের একটি নৌকা নিমাসদের দেখতে পায়।
শ্রীলঙ্কার জেলেদের নৌকাটি নিমাসদের নৌকাকে টেনে অগভীর সমু্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে জলের গভীরতা ছিল ২৬ ফুট। ওই জায়গায় গিয়ে নোঙর ফেলে নৌকাটি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার জেলেদের নৌকা ভারতীয় জলসীমানায় প্রবেশ করতে পারে না, তাই তারা পরামর্শ দেন- অন্য ভারতীয় জেলেদের নৌকাকে ওয়্যারলেস বার্তা পাঠাতে।
অনেক চেষ্টা করে তিন দিন পর একটি ভারতীয় নৌকা এডিসন-নিমাসদের বার্তার জবাব দেয়। কিন্তু সেই নৌকার ইঞ্জিন ততটা শক্তিশালী ছিল না; ক্রিশা মোলের মতো বড়সড় নৌকা টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম ছিল না এটি।
ক্রিশা মোলের মালিকও ছিলেন নৌকায়। তিনি গিয়ারবক্সটিকে সাহায্যকারী নৌকায় তুলে সেটিকে সারিয়ে আনার জন্য তাদের সাথে রওনা দেন। আর বাকি জেলেরা সিদ্ধান্ত নেন, নোঙরটি সেখানেই ফেলে যাবেন। এর ফলে নৌকা হালকা হয়ে যাবে এবং সাহায্যকারী নৌকাটি ক্রিশা মোলকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু এখানেই বিপত্তির শেষ নয়। মাঝসমুদ্রে একটি দড়ি ছিঁড়ে যায় এবং তিন দিন পর ১৯ ডিসেম্বর ঝড়ে আরও একটি দড়ি ছিঁড়ে যায়। ফলে সাহায্যকারী নৌকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ক্রিশা মোল। অগাস্টিন নিমাসের ভাষ্যে, ''তখন ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।'' জিপিএসে দেখা যায়, ২৯ নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে একটি দ্বীপ যা ব্রিটিশ ভারত মহাসাগরের সলোমন দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত।
নৌকার সঙ্গেই ছিল ডিঙি নৌকা, তাতে খাবার চাপিয়ে ওই দ্বীপের দিকেই এগোতে থাকেন বাকি নয়জন জেলে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বাকিদের পরে নিয়ে আসা হবে এবং পাঁচজন জেলে ক্রিশা মোলেই অপেক্ষা করছিলেন।
সাতজনকে ওই দ্বীপে রেখে দুজন জেলে বাকি পাঁচজনকে নিতে আসেন গভীর সমুদ্রে। ততক্ষণে ক্রিশা মোল স্রোতে ভেসে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুজির পর ওই পাঁচজনকে ডিঙিতে চাপিয়ে দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হন বাকি দু'জন।
কিন্তু দ্বীপে পৌঁছেই নতুন সমস্যায় পড়েন এই জেলেরা। তাদের খাওয়ার মতো ১০ দিনের খাদ্যদ্রব্য ছিল সাথে, কিন্তু পানীয় ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে সমুদ্রের পানি দিয়েই তারা রান্না শুরু করলেন। এছাড়া, দ্বীপে ছিল অনেক নারকেল গাছ, সেই নারকেলের পানি খেয়েই দিন কাটতে লাগল এডিসন-নিমাসদের।
পাঁচদিন পর, ২৭ নভেম্বর বেশ দূরে একটি ব্রিটিশ জাহাজ দেখতে পান তারা। জাহাজটি দেখেই তারা গাছে লাল কাপড় বেঁধে নাড়তে থাকেন যাতে ওই জাহাজের নাবিকেরা তাদের দেখতে পারেন।
দুই ঘণ্টা পর ওই জাহাজ থেকে খাওয়ার পানি আর ফলের ঝুড়ি নিয়ে দ্বীপে দেখা করতে আসেন দুজন মৎস্যজীবী। এরপর দ্বীপে আটকে থাকা জেলেদের ডিঙিতে চাপিয়ে নিজেদের জাহাজে নিয়ে যান।
ব্রিটিশ জাহাজে গিয়েই প্রায় এক মাস পর গোসল করার সুযোগ পেয়েছিলেন ওই ১৪ জন জেলে; পেট ভরে খেতে পেরেছিলেন। ২ জানুয়ারি মৎস্যজীবীদের ভিঝিনজাম বন্দরে নিয়ে এসে ভারতীয় কোস্টগার্ডের হাতে তুলে দেন ব্রিটিশ জাহাজের কর্মীরা। এর পর ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনী জেলেদের সবার নাম-পরিচয় খতিয়ে দেখে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। এভাবেই সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ঘরে ফেরেন এডিসন-নিমাসরা।
তবে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ফিরে এলেও, আবারও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে ভয় পাবেন না বলে জানান এডিসন ডেভিস। কিন্তু বিপরীতে অগাস্টিন নিমাস জানান, তিনি এ ঘটনায় প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন এবং এখন থেকে তিনি উপকূলের কাছাকাছিই মাছ ধরবেন।
সূত্র: বিবিসি