‘জ্বালানি তেলের চেয়ে বেশি আগামী পাঁচ দশকে ভূরাজনীতি নির্ধারণ করবে মাইক্রোচিপ সরবরাহ’
আগামী কয়েক দশকে বিশ্বের ভূরাজনীতিতে আধিপত্য করবে মাইক্রোচিপের সহজলভ্যতা, বাণিজ্য এবং এখাতে বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলো। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন- এর কাছে এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্বের বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর চিপ প্রস্তুতকারক- ইন্টেল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্যাট গ্যালসিঙ্গার। খবর সিএনএনের
মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে অংশগ্রহণকালে তিনি সিএনএন এর সাংবাদিক জুলিয়া চ্যাটার্লিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সরবরাহ শৃঙ্খল যেখানে রয়েছে, যেখানে সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেসবই আগামী পাঁচ দশকের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ'।
ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ইন্টেলের চিপ প্রস্তুতকারক স্থাপনা নির্মাণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এটা শুধু তাদের কোম্পানির ভবিষ্যত-ই নয়, একইসাথে 'ভবিষ্যতে বিশ্বের সবচেয়ে অপরিহার্য একটি সম্পদের বিশ্বায়ন নিশ্চিত করবে'।
'আমাদের একটি ভৌগলিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ, অদম্য সরবরাহ চক্র থাকা দরকার' বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত বছর ইন্টেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন দুটি চিপ প্রস্তুতকারক কারখানা নির্মাণে তারা দুই হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। ইউরোপে নতুন স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় করবে ৯ হাজার কোটি ডলার। এর মাধ্যমে তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকবে, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজ অবস্থান আগামীতেও সুসংহত রাখা।
এশিয়ায় মাইক্রোচিপ শিল্প লাভ করেছে বিস্ময়কর অগ্রগতি। চীন ও তাইওয়ানের প্রস্তুতকারকরা বৈশ্বিক স্তরে প্রতিযোগিতা করছে। কিন্তু, চীনে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা সংক্রমণের বিস্তার এবং তাইওয়ান নিয়ে দেশটির সাথে পশ্চিমা শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমে বাড়তে থাকায়– যেকোনো প্রকার সংঘাতে মাইক্রোচিপ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র এ শিল্পে ঠেকাতে চায় চীনের অগ্রগতি। এজন্য মার্কিন সরকার বিপুল প্রণোদনার ঘোষণাও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপনকারী চিপ প্রস্তুতকারকরা এই সুবিধা পাবে।
তাছাড়া, কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকেই জাহাজে পণ্য পরিবহনে দেরি হওয়ায়, কম্পিউটার, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে মোটরকার উৎপাদনেও সমস্যা দেখা দেয়। একারণে সরবরাহ চক্র আরো সংক্ষিপ্ত করার বা কাছাকাছি নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি হতে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটেই আসে ইন্টেলের নতুন বিনিয়োগের ঘোষণাগুলো।
এপ্রসঙ্গে গ্যালসিঙ্গার বলেন, 'কোভিড সংকট ও গত দুই বছর থেকে আমরা যদি কোনো শিক্ষালাভ করি– তাহলে সেটা হচ্ছে সরবরাহ চক্রে অদম্যতা থাকতে হবে'। একারণে চিপ প্রস্তুতে ইন্টেলের বিনিয়োগগুলোর লক্ষ্য 'বিনিয়োগের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, যাতে বিনিয়োগের সঠিক সিদ্ধান্তও নেওয়া যায়' যোগ করেন তিনি।
বছর দুই আগে কোম্পানির সংকটকালে প্রধান নির্বাহী পদে দায়িত্ব নেন গ্যালসিঙ্গার। তিনি স্বীকার করেন যে, কয়েক দশকব্যাপী কৌশলের অংশ হিসেবে নতুন এসব বিনিয়োগ– অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার এক সময়েই করা হচ্ছে।
'স্বল্পমেয়াদে (বিশ্বের) অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই ভঙ্গুর– একদিকে চীনে কোভিড-১৯ বিস্তার, অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইউরোপে জ্বালানি নিয়ে সংকট, আর যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা; সব দেখেশুনে আপনি বলবেন, এরমধ্যে শুভ সংবাদ কোথায়? কিন্তু, একইসময় আমাদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগও করতে হবে। তিন প্রান্তিকের অর্থনৈতিক চিত্র দিয়ে আসলে পাঁচ বা ছয় বছর মেয়াদি বিনিয়োগ চক্রকে নির্ধারণ করা যায় না। সবমিলিয়ে বলব, এই সময়ে সিইও হিসেবে দায়িত্বপালন আসলেই এক চ্যালেঞ্জ'।
গতবছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্থানীয়ভাবে সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদনে 'চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট' নামক আইন পাস করেছে। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে চিপ উৎপাদন ও গবেষণায় নিয়োজিত কোম্পানিগুলোকে ২০ হাজার কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দেবে সরকার।
এই আইন কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এবং তহবিল কীভাবে ছাড় করা হবে– সেটি নির্ধারণ করতে গত বছর বাণিজ্য সচিব জিনা রাইমোন্ডোসহ একটি স্টিয়ারিং কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
গ্যালসিঙ্গার জানান, ইন্টেল ও অন্যান্য চিপ প্রস্তুতকারকরা এখন এই আইনের আওতায় অনুমোদিত তহবিল ছাড়ের অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, 'চলতি বছরেই এসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করছি। আমরা বিনিয়োগ করছি, এখন তাদেরও অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, তারা (সরকার) আমাদের বিপুল বিনিয়োগে সহায়তা করবে এমন ধারণা থেকেই আমরা উদ্যোগী হয়েছি'।