মোদি-ভারতের উত্থানের সঙ্গেই উত্থান আদানির, এখন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে!
গৌতম আদানির বছরের শুরুটা হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী হিসেবে। বছরের শুরুতে তার শিল্পগোষ্ঠীর বাজারমূল্য মাত্র পাঁচ বছরে ২,৫০০ শতাংশ বেড়ে যায়। খবর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর।
আদানি তখন বলেছিলেন, তার এই উত্থান ভারতের 'প্রবৃদ্ধির গল্প' থেকে অবিচ্ছেদ্য। আদানি নিয়মিতই দাবি করতেন, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য আর দেশের চাহিদা একই। ভারতের প্রভাবশালী নেতা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আদানি তার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদ্যুৎ, বন্দর, খাদ্যসহ অন্যান্য শিল্পে নিয়োজিত করেন। একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা আর কোনো ধনকুবের বজায় রাখেননি।
এখন যেরকম উল্কার বেগে উত্থান ঘটেছিল, তারচেয়েও দ্রুত গতিতে নিচে নামছে আদানি গ্রুপ। আর এ গোষ্ঠীর পতন ঘটলে তার প্রভাব টের পাবে গোটা দেশ। টালমাটাল হয়ে যাবে ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল।
মাত্র এক সপ্তাহে আদানি গ্রুপের বাজারমূল্য কমেছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি—যা গোষ্ঠীটির মোট মূল্যের প্রায় অর্ধেক। ঠিক যেন বেলুন ফাটল। আর এই বেলুন ফাটার সূচটি এসেছে নিউ ইয়র্কের ছোট্ট একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান থেকে—হিনডেনবার্গ রিসার্চ। হিনডেনবার্গ এক প্রতিবেদনে বলেছে, আদানি গ্রুপ স্টক ও হিসাবের বিষয়ে জালিয়াতি করেছে। ভুল তথ্য দিয়ে বাজারকে প্রভাবিত করেছে। এর মাধ্যমে তারা বাজারে নিজেদের শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে।
এ প্রতিবেদনের জবাব দিতে গিয়ে আদানি গ্রুপ জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নিয়েছে। হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনকে তারা 'ভারতের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ' আখ্যা দিয়েছে। জবাবে হিনডেনবার্গ বলেছে, আদানি জাতীয় পতাকায় শরীর ঢেকে দেশকে লুটপাট করেছে।
এই প্রতিবেদন ভারতের বাকি শেয়ারবাজারের আত্মবিশ্বাসের ক্ষতি করতে পারে। সময় যখন তুঙ্গে, তখন ভারতের প্রধান দুটি স্টক এক্সচেঞ্জের ৬ শতাংশের বেশি শেয়ার ছিল আদানি গ্রুপের। এখন তা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
এহেন পরিস্থিতিতে ভারত সরকার প্রশ্নের মুখে পড়েছে, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেছে কি না।
এশিয়ান কর্পোরেট গভর্নেন্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারতের গবেষণা পরিচালক শর্মিলা গোপিনাথ জানান, গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একমাত্র আদানি এন্টারপ্রাইজেসই লাভজনক।
ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের নির্মাতা হিসেবে মোদি যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, রাজনৈতিকভাবে আদানির পতন সেই জাতীয় উন্নয়ন মডেলের ক্ষতি করবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। মোদি যে ধরনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান চান, তেমন কোম্পানির সংখ্যা ভারতে কম নেই। তবে আদানি গ্রুপের দেনা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে ভারত শক্তিশালী শিল্পনেতা না-ও পেতে পারে।
মোদি বা ভারত কেউই বিশেষ করে চলতি বছরে জালিয়াতি বা ব্যর্থতার ভাবমূর্তি গায়ে মাখতে চাইবে না। কারণ এ বছরই ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে আগ্রহী। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে।
মোদির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভাবছেন, দুর্বলতার মুহূর্তে তারা তাকে আগামী বছরের নির্বাচনে কুপোকাত করতে পারবেন। আদানিকে নিয়ে বিতর্কের জেরে দুই দিন সংসদের অধিবেশন ভেস্তে গেছে।
যেভাবে হাত ধরাধরি করে উত্থান আদানি ও মোদির
৬০ বছর বয়সি আদানি ও ৭১ বছর বয়সি মোদি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করেন ২০০২ সালে, যে বছর গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধে। ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি এবং আদানি গ্রুপের গোড়াপত্তনও এই গুজরাটে।
২০০২ সালের দাঙ্গায় ব্যাপক সহিংসতায় ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম। এ দাঙ্গায় মোদির ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় ছিল মোদির নিজ দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। গুজরাটের রক্তপাতের কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিল বিজেপি।
ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসয়িক গোষ্ঠীগুলোর অবস্থা ছিল আরও সঙিন। দেশটির সবচেয়ে প্রাচীন দুই ব্যবসা গ্রুপ বাজাজ ও গোদরেজ ২০০৩ সালে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সংগঠনের এক সভায় মোদিকে তার রাজ্যের 'আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি' সম্পর্কে প্রশ্ন করেন।
ওই সময় মোদিকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে গুজরাটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। গৌতম আদানি তখন নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা করেন, যা আগের বৃহত্তম বাণিজ্য সংগঠনটিকে বিলুপ্ত করে দেয়। আর মোদির রাজ্য সরকারের সঙ্গে মিলে 'ভাইব্র্যান্ট গুজরাট' নামের বিনিয়োগকারীদের জন্য বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। মোদির বিচক্ষণ নেতৃত্বে রাজ্যটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মুখ দেখে।
এর কদিন পরই দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় উন্নয়নের 'গুজরাট মডল'। এ মডেলের আওতায় পুরনো রাষ্ট্রচালিত উন্নয়ন কর্মসূচির জায়গা নেয় বাজারভিত্তিক কিংবা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মসূচি।
আদানির উত্থানের শুরু গুজরাটের পুরনো বন্দর পরিচালনা এবং নতুন বন্দর নির্মাণ শুরুর মাধ্যমে। তাই পশ্চিমবঙ্গে ভারতে ডিজাইন করা নতুন গাড়ির কাজ যখন ব্যর্থ হওয়ার পর ব্যর্থ হওয়ার পর সে কাজ গুজরাটে চলে যায়, তখন কেউই অবাক হয়নি।
এই নতুন গুজরাটকে উপেক্ষা করা বিজেপি কিংবা বাণিজ্য সংগঠনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মোদির সঙ্গে দেখা করে তার সমালোচনা করার জন্য ক্ষমা চান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোদির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার হয়।
২০১৪ সালে যখন জাতীয় নির্বাচন করেন, মোদি তখন নিজেকে আধুনিক, প্রযুক্তিচালিত অর্থনৈতিক উন্নতির আইকন হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। নির্বাচনে জেতার পর তিনি ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আদানির ব্যক্তিগত জেট বিমানে চেপে দিল্লিতে উড়ে যায়।
মোদি দায়িত্ব গ্রহণের পর বিনিয়োগকারীরা সম্ভবত নতুন সরকারের সঙ্গে আদানির ঘনিষ্ঠতাকে বিবেচনায় নিয়েছিলেন। এ কারণে আদানির শেয়ারমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। আদানি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারদর হুট করেই ২৩ শতাংশ বেড়ে যায়।
গত অক্টোবরে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আদানি বলেন, তার অভাবনীয় সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো ব্যবসায় সুশাসন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা, ঋণদাতা ও ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলোর আস্থা—এবং 'অবশ্যই দেশের দৃঢ় প্রবৃদ্ধি'।
ভারতের অর্থনীতিতে আদানির হিস্যা বিশাল। অবকাঠামো খাতের কাজগুলোর অধিকাংশই পাচ্ছে আদানি গ্রুপ।
মোদি সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো ভারতকে সবুজ-শক্তির হাবে পরিণত করা। অন্যদিকে কয়লায় বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে আদানি গ্রুপের। তবু গোষ্ঠীটি ফরাসি কোম্পানি টোটালএনার্জিস-এর সঙ্গে মিলে 'বিশ্বের সবচেয়ে বড় সবুজ হাইড্রোজেন ইকোসিস্টেম' তৈরির জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
মাঝেমধ্যে দেখা গেছে, আদানি ও ভারত সরকারের সম্পর্কে যতটা না নির্মাণের, তারচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণের। ২০১৮ সালে ভারত সরকার নিয়মকানুন শিথিল করার পর আদানি ছয়টি মুনাফা অর্জনকারী বিমানবন্দরের অপারেটর হয়। গৌতম আদানি অবশ্য সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
তবে সংসদে বার্ষিক বাজেট পড়ার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জে ঘটে যাওয়া তোলপাড়ের কোনো উল্লেখ করেননি। মোদিও আদানির বিষয়ে মুখ খোলেননি। অন্যদিকে দুই বিনিয়োগ ব্যাংক ক্রেডিট সুইস ও সিটিগ্রুপ জানিয়েছে, তারা আর ঋণের পরিবর্তে আদানিদের বন্ড গ্রহণ বন্ধ করবে না।
এদিকে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরও আদানি এন্টারপ্রাইজের এফপিও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে গোষ্ঠীটি। গৌতম আদানি বলেন, 'আমাদের স্টকের দাম দিনভর ওঠানামা করেছে। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদ মনে করছে, এই এফপিও নিয়ে অগ্রসর হওয়া নৈতিকভাবে ঠিক হবে না।'
সব মিলিয়ে হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনের ধাক্কায় আদানির সাম্রাজ্য এখন টালমাটাল, সেইসঙ্গে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে মোদি তথা সরকারের সঙ্গে তার সুসম্পর্কও।
- সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস