গৌতম আদানী কে? কেনই বা তিনি এত বিতর্কিত?
স্টক মার্কেটে কারচুপি এবং জালিয়াতির অভিযোগ ভারতীয় টাইকুন গৌতম আদানীর সম্পদ প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ এই ধনী গত দুই সপ্তাহে ভারতে থাকা তার কোম্পানিগুলো থেকে ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ খুইয়েছেন।
বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস নড়ে যাওয়ায় আইনপ্রণেতারা তার ব্যবসা নিয়ে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন। আদানী কে, কীভাবে তার ব্যবসা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে এবং তারপর কী কী ঘটেছে তা জেনে নেওয়া যাক।
গৌতম আদানী কে?
ভারতের অন্যতম বড় কংলোমিরেট প্রতিষ্ঠান আদানী গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান গৌতম আদানী। ৬০ বছর বয়সী কলেজ ড্রপআউট গৌতম আদানীর বেড়ে ওঠা গুজরাটে, ঠিক যেখানে বেড়ে উঠেছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৯৮৮ সালে বাবার কাপড়ের ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে নিজেই বিভিন্ন পণ্য বেচাকেনার ব্যবসা দাঁড় করান তিনি, তার ব্যবসার জগতে পদার্পন এ সময়েই।
ফোর্বস ম্যাগাজিন আদানীকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ধনী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এক প্রতিবেদনের জেরে তার এই সম্পদের পরিমাণ অকল্পনীয় হারে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তার বিরুদ্ধে স্টক মার্কেট জালিয়াতি এবং ঋণে ডুবে থাকার অভিযোগ আনে।
কোন কোন খাতে আদানী গ্রুপ কাজ করে?
আদানী গ্রুপের কাজের ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, গ্যাস সরবরাহ, গ্রিন এনার্জি, ডেটা সেন্টার, অ্যাগ্রি-লজিস্টিকস, ভোজ্যতেল, শক্তি উৎপাদন ও সরবরাহসহ আরও অনেককিছুই। ২০২২ সালের মার্চে শেষ হওয়া সবচেয়ে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বছর অনুযায়ী তাদের ঐ বছরের রেভিনিউ ছিল ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
গ্রুপটি ভারতের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর অপারেটর। এছাড়াও ভারতের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সমুদ্রবন্দর গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দর নিয়ন্ত্রণ করে তারা। গ্রুপটির অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ভারতের স্টকমার্কেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সোচ্চার আন্দোলনকারীদের চক্ষুশূল অস্ট্রেলিয়ার বিতর্কিত কারমাইকেল কয়লাখনির মালিকও এই আদানী গ্রুপ।
সময়ের সাথে সাথে গ্রুপটি অ্যাকুইজিশন অথবা কোলাবোরেশনের মাধ্যমে আরও বড় হচ্ছে। অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন আগেই গত জানুয়ারিতেই ইসরায়েলের হাইফা বন্দর কিনে নেওয়া কনসোর্টিয়ামের মূল প্রতিষ্ঠান ছিল এই আদানী গ্রুপ। গত বছরের জুন মাসেও ফরাসি কোম্পানি টোটাল এনার্জিসএসই-র সাথে একত্রিত হয়ে ভারতে গ্রিন হাইড্রোজেন এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের জন্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার চুক্তি করে আদানী গ্রুপ। এর আগে মে মাসে সুইস সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানি হোলসিমের সমস্ত ভারতীয় সম্পদ ১০.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নিয়ে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে গ্রুপটি।
কেন আদানীর উত্থান বিতর্কিত?
আদানীর এই উত্থান হঠাৎ করেই হয়েছে, যার পেছনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমর্থন রয়েছে। মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই আদানীর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। গুজরাটের জমি কম দামে পেতে এই সম্পর্ককে কাজে লাগান আদানী।
পুরো দেশজুড়ে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও কয়লাখনির কন্ট্রাক্ট পেতেও রাজনীতিবিদদের সাথে সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়েছে আদানী গ্রুপ, যেটি তাকে একেবারেই কম সময়ের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীতে পরিণত করেছে।
ফোর্বসের ডেটা অনুযায়ী, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কয়েকদিন আগে আদানীর সম্পদের পরিমাণ ছিল ২.৮ বিলিয়ন ডলার। এ বছরের জানুয়ারির ২৪ তারিখে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার সম্পদ আকাশছোঁয়া ১২৬.৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। এবং এরপর থেকেই পড়তে থাকে তার সম্পদের পরিমাণ।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ কী এবং তাদের রিপোর্টে কী উঠে এসেছে?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফরেনসিক ফাইন্যানশিয়াল রিসার্চ প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইকুইটি, ক্রেডিট এবং চুক্তিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে। কর্পোরেট খাতে দুর্নীতি বা অন্যান্য ঝামেলা খুঁজে বের করে তারা এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে শর্ট সেলিং করে তারা। পুঁজিবাজারের ভাষায় শর্ট সেলিং হলো একটি কোম্পানির শেয়ারের বিরুদ্ধে বাজি লাগানোর কৌশল।
যেমন ধরুন, আপনি নিজ এলাকার স্টক ব্রোকার এজেন্সির থেকে একটি কোম্পানির শেয়ার কিনলেন, এরপর সেগুলো বিক্রি করলেন বর্তমান বাজারমূল্যেই, বা ১০০টাকায়। অর্থাৎ, যে দামে কিনেছেন সে দামেই বিক্রি করলেন। কিন্তু, ভবিষ্যতে যদি শেয়ারের দাম কমে ৮০ টাকা হয়, তাহলে সরাসরি পুঁজিবাজার থেকে সেটা কিনে বিক্রি করে দিলেন এলাকার ওই ব্রোকারের কাছে। এতে আপনার সাকুল্যে লাভ হলো শেয়ারপ্রতি ২০ টাকা করে।
পুঁজিবাজারে শর্ট পজিশন হলো, স্বল্পমেয়াদে কোনো কোম্পানির শেয়ার কতখানি কমবে তা নির্ধারণের কৌশল। সাধারণত আগামী কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য এটা নিরূপণ করা হয়।
এর আওতায় বিনিয়োগকারী আগে থেকেই অনুমান করে ফেলেন যেকোনো নির্দিষ্ট স্টকের দাম কমবে। আর সেটা কাজে লাগিয়েই মুনাফা করেন। বিশ্লেষণ কাজে লাগিয়ে এই ধরনের বিনিয়োগকারীরা আন্দাজ করেন; বুঝে যান যে আগামী কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যেই সেই শেয়ারের দামে পতনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আদানী গ্রুপের বিরুদ্ধে 'বছরের পর বছর ধরে স্টক মার্কেটে কারচুপি এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতির' অভিযোগ আনে।
দুই বছর ধরে তদন্ত করেছে বলে দাবি করেছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ, যার মধ্যে গ্রুপটির হাজার হাজার ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ, ছয়টি দেশে আদানী গ্রুপের মালিকানাধীন জায়গা পর্যবেক্ষণ এবং আদানী গ্রুপের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার রয়েছে।
শর্ট-সেলার প্রতিষ্ঠানটি আদানী গ্রুপের বিরুদ্ধে যে যে অভিযোগ এনেছে সেগুলো হলো:
• মূল তালিকায় থাকা আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর 'যথেষ্ট পরিমাণ ঋণ' রয়েছে এবং এরমধ্যে কয়েকটি ঋণের জন্য তাদের স্টকের শেয়ার বন্ধক রেখেছে। স্টকমার্কেটের তালিকায় থাকা সাতটির মধ্যে পাঁচটি কোম্পানিরই 'কারেন্ট রেশিও' ১ এর নিচে, যেটি নেয়ার-টার্ম লিকুইডিটি প্রেশার নির্দেশ করে।
• আদানি গ্রুপ তাদের রেভিনিউ এবং স্টকের দাম বাড়িয়ে দেখানোর জন্য বিভিন্ন ট্যাক্স হ্যাভেন দেশগুলোতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগায় এবং একইসাথে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ঋণযোগ্য হিসেবে প্রদর্শন করে।
• গ্রুপটির 'আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কার্যত অস্তিত্বহীন' ছিল। আদানীর প্রধান ব্যবসাগুলোর চিফ ফাইন্যানশিয়াল অফিসার (সিএফও) পদে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে গ্রুপটির মূল প্রতিষ্ঠান আদানি এন্টারপ্রাইজে আট বছরে পাঁচজন সিএফও হয়েছেন, যা প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টিংয়ের জন্য একটি বিপদ সংকেত।
• আদানি এন্টারপ্রাইজ এবং আদানি টোটাল গ্যাসের অডিটর হলো শাহ ধান্দারিয়া নামক একটি ছোট ফার্ম, যার কোনো বর্তমান ওয়েবসাইট নেই। একইসাথে এর অংশীদার মাত্র চারজন এবং কর্মচারী মাত্র ১১ জন। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, আদানী গ্রুপের 'জটিল অডিট করতে এই কোম্পানি সক্ষম বলে মনে হয় না'। শাহ ধান্ধারিয়ার অডিট কর্মকর্তা, যারা যথাক্রমে আদানি এন্টারপ্রাইজ এবং আদানি টোটাল গ্যাসের বার্ষিক অডিটে স্বাক্ষর করেছেন, তাদের বয়স ২৩-২৪-এর মতো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'তারা কেবল তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেছে, যারা কোনোভাবেই দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তির কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব যাচাই করার এবং হিসাব করার মতো অবস্থায় ছিল না।"
• প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে, আদানির পরিবারের সদস্যরা মরিশাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বেশ কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপের মতো ট্যাক্স-হেভেন দেশগুলোতে অফশোর শেল তৈরি করতে সহযোগিতা করেছে। যার মাধ্যমে ঐ জাল কোম্পানিগুলোর জাল ডকুমেন্ট দেখিয়ে অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। প্রতিবেদনে ভারত সরকারের পূর্ববর্তী জালিয়াতির তদন্তেরও উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে মানি লন্ডারিং, করদাতার তহবিল চুরি এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, যার অর্থসম্পদের পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলার।
আদানী অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে কী বলেছে?
আদানী গ্রুপের বক্তব্য অনুযায়ী হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টটি 'খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে' করা হয়েছে। আড়াই বিলিয়ন ডলার শেয়ার বিক্রির ঘোষণার কয়েকদিন আগে, যেটি ভারতের সবচেয়ে বড় সেকেন্ডারি পাবলিক শেয়ার বিক্রির ঘটনা, আদানী গ্রুপের সুনাম নষ্ট করার জন্য এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। আদানী গ্রুপ অভিযোগ জানিয়েছে যে, প্রতিবেদনটির 'মূল উদ্দেশ্য' হলো এই শেয়ার বিক্রিকে বন্ধ করা।
রিপোর্টটি প্রকাশ হওয়ার পর কী কী হয়েছে?
আদানীর শেয়ার পুরো বিক্রি হয়ে গেলেও আদানী গ্রুপ হঠাৎ করেই এই শেয়ারগুলোকে বাতিল ঘোষণা করে, যার ফলে আদানীর শেয়ারের দাম আরও কমতে থাকে। এর ফলে আদানীর প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ১১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার গায়েব হয়ে গিয়েছে, সাথে আদানীর নিজস্ব সম্পদও কমে গিয়েছে।
সেকেন্ডারি শেয়ার বিক্রি বাতিল করার পর আদানী ঘোষণা দিয়েছে বাজার স্থিতিশীল হওয়ার পর তারা তাদের ক্যাপিটাল মার্কেটের কৌশল পুনরায় রিভিউ করবে। তবে এটি কবে হবে সে ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়নি, কারণ গ্রুপটির স্টকের দাম আরও নিচের দিকে নেমেই চলেছে। স্টক মার্কেট এজেন্সি মুডি সতর্ক করে জানিয়েছে গ্রুপটিকে তাদের মূলধন তুলতে বেগ পেতে হতে পারে।
এদিকে ভারতের প্রধান বিরোধী দলের নেতারা আন্দোলনে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে আদানী গ্রুপের চুক্তি বাতিল করতে, একইসাথে প্রতিষ্ঠানটির ওপর তদন্ত চালানোর দাবিও করেছে তারা।
এরপর কী হতে পারে?
রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় মার্কেট রেগুলেটররা শেয়ারের দামে ধ্বস পর্যবেক্ষণ করছেন এবং আড়াই বিলিয়ন ডলারের শেয়ার বিক্রিতে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়েছে কি না তাও পরীক্ষা করে দেখছেন।
বিনিয়োগকারীদেরকে শান্ত করার জন্য আদানী গ্রুপ ইতিমধ্যেই গত সোমবার ২০২৪ সালের ম্যাচুরিটিতে লক্ষ্য রেখে ১.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রিপেমেন্ট করেছে। তবে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা দেখে এটি কতদূর যাবে তা বলা যাচ্ছে না।
যদিও আদানীর মোট সম্পদ দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, তারপরও সে এখনো বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার হাতে এখনো ভারতের বড় বড় খাতের বড় বড় ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ২৩ হাজার কর্মীর বিশাল এই গ্রুপটি খুব সহজেই যে হারিয়ে যাচ্ছে না, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।